প্রফেসর মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকীর অবসরগ্রহণ ও রাজশাহী কলেজস্মৃতি

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৮ জুলাই ২০২২ ০০:৫৪; আপডেট: ৮ জুলাই ২০২২ ০১:০০

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকীর সাথে লেখক মাহফুজুর রহমান আখন্দ।


মাহফুজুর রহমান আখন্দ

কর্মজীবনের ইতি টানলেন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী স্যার। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শেষ করছেন তাঁর ধারাবাহিক শিক্ষকতার ক্যারিয়ার। জুলাই ২০২১ থেকে পিআরএল শুরু করেছেন। আগামীকাল ২৯ জুন পুরোপুরিভাবে শেষে হচ্ছে তাঁর ক্যারিয়ারের আলোকিত সময়। আজ মঙ্গলবার রাজশাহী ত্যাগ করলেন তিনি। চলে গেলেন একান্ত নিরবে। তিনি নিরবে চলে গেলেন, আমার মতো অনেকেরই বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় শিক্ষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী। ক্লাসের পাঠ থেকে শুরু করে আমার এম.ফিল এবং পিএইচ.ডি গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন তিনি। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনেও তিনি আমার অভিভাবক। জীবনের বাঁক-মোহনায় তাঁর বুকেই ঠাঁই খুঁজতাম। আজ তিনি চলে গেলেন তাঁর নিজ ঠিকানা চট্টগ্রামে। আমার বিভাগীয় শিক্ষকবৃন্দ, সহকর্মী, ছাত্র-সহকর্মী, অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক-কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ ছাত্র-ছাত্রীদের স্নেহ-ভালোবাসায় সিক্ত আমি। তবুও স্যারের বিদায়ে বুকের ভেতরটা খালি খালি মনে হচ্ছে।

মাহফুজ সময় হবে? আগামীকাল রাজশাহী কলেজে যাবো। ফোনে এমন প্রস্তাবে বুকে ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো। অনেকগুলো কাজ। চাপা সিডিউল। কোনো হিসেব নিকেশ না করেই বললাম, জি স্যার। যাবো ইনশাআল্লাহ। কেনো যাবো, কখন যাবো কোনো প্রশ্নই মনের মধ্যে আসেনি। শুধু ভেবেছি, স্যার বিদায় নিচ্ছেন। আর মাত্র দুটো দিন। একসাথে কিছুটা সময় থাকতে পারলে সে আমার সৌভাগ্য। স্যার অবশ্য নিজে থেকেই বললেন, সকাল ১০টার দিকে যাবো। দুপুরে হয়তো ওখানেই খেতে হবে। তখন ভাবলাম, সারাদিনের কর্মসূচি। বললাম, জি স্যার আসছি ইনশাআল্লাহ।

বলছিলাম প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী স্যারের কথা। কর্মজীবন শেষ করে প্রায় চল্লিশ বছরের স্মৃতিকে পিছনে ফেলে বাস্তবতার টানে তিনি চট্টগ্রামে পাড়ি জমাচ্ছেন। রাজশাহী কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান ড. ইয়াসমিন আকতার সারমিন তাঁর প্রথম পি.এইচডি ফেলো। ভীষণ শ্রদ্ধা করেন স্যারকে। বিভাগীয় সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আবদুল মতিন, ড. আবু নোমান মো. আসাদুল্লাহ, সহকারী অধ্যাপক তোফায়েল আহম্মেদসহ ঐ বিভাগের অনেকই স্যারের সরাসরি ছাত্র এবং প্রিয়পাত্র। তাঁদের আন্তরিক আমন্ত্রণেই মুলত রাজশাহী কলেজের এ সফর।

তারিখটা ২৫ জুন, ২০২২। সোমবার। সকাল দশটায় স্যারের সাথে মিলিত হলাম বিনোদপুর গেটে। অটোতে উঠে রাজশাহী কলেজে পৌঁছে গেলাম গুরু-শিষ্য। অনেক কথা। অনেক গল্প। কলেজে পোঁছেই পদ্মপুকুরের ঘ্রাণ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম তার পাদপীঠে। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ নিচতলাতেই। ঢুকে পড়লাম। সালাম দিলাম। সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। মনে হলো সকলেই প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। বসলাম। গল্প জমে উঠলো। চা পর্ব শেষ করে কলেজ চত্বর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে ইসলামের ইতিহাসের পুরো টিম।

রাজশাহী কলেজ মানেই ইতিহাসের ইতিহাস। বরেন্দ্র বাংলায় শিক্ষা বিস্তারে যেমন সুনাম তেমনি সৌন্দর্যের নান্দনিকতাও নজরকাড়া। ব্রিটিশ বাংলার দৃষ্টিনন্দন বিল্ডিংগুলো এখনো মাথা উঁচু করে আছে। নতুন ভবনগুলোও বেশ মনোরম। সাজানো গোছানো সবুজের মায়ায় স্নাত ভালোবাসার ক্যাম্পাস। প্রশাসন ভবন, হাজী মোহাম্মদ মহসীন বিল্ডিং, ফুলার ভবন, অধ্যক্ষ মহোদয়ের বাসভবনসহ পুরো ক্যাম্পাস দেখা হলো ঘুরেফিরে। সাথে সাথে চর্চিত হলো ইতিহাস। প্রতিটি ভবন আর বৃক্ষের ইতিহাস। দৃষ্টিনন্দন বিল্ডিং, সবুজের স্নিগ্ধতা এবং ইতিহাসের রসালো গল্প। সদ্যবিদায়ী অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. হাবিবুর রহমান স্যারের কারিশমাটিক নেতৃত্বের প্রসঙ্গও এড়ায় নি আলোচনায়।
সবমিলিয়ে সময়গুলো সমৃদ্ধির নিশানাই বয়ে বেড়ালো।

ফটোসেশান সংস্কৃতি আমাদের পিছু ছাড়েনি। যেখানেই দাঁড়িয়েছি সেখানেই ক্লিক, ক্লিক। বিভাগীয় প্রভাষক সারোয়ার হোসন চেহারায় একটু বড়সড় হলেও বেশ প্রাণচঞ্চল মানুষ। তার ফটোক্লিক দেখে বেশ দক্ষ মনে হলো। আমি একটু প্রশংসা করতেই তার সহকর্মীরা জানালেন, ফটোগ্রাফিতে তাঁর প্রশিক্ষণ আছে। সুনামও কুড়িয়েছেন ফটোগ্রাফি করে। তার বদান্যতায় তরতাজা হয়ে বেঁচে থাকলো স্মৃতির আকাশ।

ক্যাম্পাস এনজয় শেষে জোহরের নামাজ হলো কলেজ মসজিদে। অনেক পরিচিত মুখের দেখা মিললো। বিভাগে ফিরেই মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন। ডাল ভাতের ডাক পড়লো। ডালভাত মানে সাদাভাতের সাথে বড় সাইজের ট্যাংরা মাছ, কাঠুয়াডাটার সবজি, রুই মাছ, গরুর গোশত, ডাল সাথে দই-মিষ্টি। রান্নাটা ঘরোয়া মনে হলো। জানা গেলো বিভাগের স্টাফ আসাদ ভাইয়ের মিসেস রান্না করেছেন। সত্যি অসাধারণ রান্না। খাওয়াটা একটু বেশিই হলো। তবে সাদাভাত এবং ঘরোয়া রান্না বলে কোন সমস্যা হয় নি।

বিভাগে আয়েশী ঢঙে বসলাম। কিন্তু ঘোষণা এলো, কাজটা সেরেই ফেলি। দেখলাম চেয়ার সাজানোর আয়োজন। ফুল এবং উপহার সামগ্রীও হাজির করা হচ্ছে। বোঝা গেলো আয়োজনটা বেশ পরিকল্পিত। সাজানো গোছানো।

বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. ইয়াসমিন আকতার সারমিনের সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। সঞ্চালনা করলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল মতিন। কথা বলার অসাধারণ কৌশল তাঁর। বাগ্মিতা এবং উপস্থাপনায় নান্দনিকতার সুবাস। লেখাপড়াকেও দারুণ অনুসন্ধিৎসু এবং পরিশ্রমী। ভূমিকাতেই প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী স্যারকে উপস্থাপন করলেন স্বকীয় ঢঙে। আবদুল মতিন স্থানীয় ইতিহাস বিষয়ে গবেষণা করার কারণে তিনি প্রফেসর ছিদ্দিকী স্যারের গবেষণাকর্ম সম্পর্কে যুৎসই বিবরণ দিলেন। ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করা হলো স্যারকে। উপহার হিসেবে সময়কে ধারণ করেই চমৎকার একটি ঘড়ি পরিয়ে দেয়া হলো স্যারের হাতে।

আলোচনার পালা শুরু হলো। বিভাগীয় প্রভাষক সারোয়ার হোসেন কথা শুরু করলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হবার কারণে প্রফেসর ছিদ্দিকী বিষয়ে তাঁর আগ্রহটা একটু বেশিই ছিলো। বললেনও সাবলীল ভাষায়। প্রভাষক দেলোয়ার হোসেন, সহকারী অধ্যাপক মানিক হোসেন এবং সহযোগী অধ্যাপক সোহেলা পরভীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। তারাও ভালোবাসার পরশ মাখিয়ে কথা বললেন, অভিনন্দিত করলেন। শ্রদ্ধা জানালেন। সহকারী অধ্যাপক
তোফায়েল আহম্মেদ রাবি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ছিদ্দিকী স্যারের ছাত্র। আমি বিভাগের যোগদানের পরপরই তোফায়েল আহম্মেদকে পেয়েছিলাম তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিসেবে। দারুণ চঞ্চল এবং মেধাবী ছাত্র সে। তার বন্ধু মুহাম্মদ কায়সারও একই চরিত্রের ছিলো। সে এখন নির্বাচন কমিশনে চাকরি করছে। ওদের সাথে আমারও অনেক স্মৃতি জড়িত। যা হোক, তোফায়েল তাঁর বক্তব্যে ছিদ্দিকী স্যারের সাথে আমার প্রসঙ্গেও বেশকিছু কথা বলেলন। সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু নোমান ছিদ্দিকী স্যারের ছাত্র এবং আমার সহপাঠি বন্ধু। তার কথার মধ্যেও প্রফেসর ছিদ্দিকীর গবেষণালব্ধ জ্ঞানের পরিধি উঠে আসে। ভীষণ রসিকতা করে বক্তব্য রাখলেন সহযোগী অধ্যাপক মোসলেম উদ্দীন মন্ডল। ছিদ্দিকী স্যার কর্মজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে ফিরে যাচ্ছেন বলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। রাজশাহীতে কেনো তিনি আবাসন গড়েন নি এটি তাকে বিস্মিত করেছে। প্রফেসর আবদুল্লাহিল কাফির কন্ঠেও প্রফেসর ছিদ্দিকীর গবেষণা কর্মের প্রশংসা উচ্চারিত হয়। ছিদ্দিকী স্যারের সবচেয়ে কাছের ছাত্র এবং প্রথম এম.ফিল ফেলো হিসেবে হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার স্বপ্নের প্রতিটি সিঁড়িতে। অনেক কথা বলার থাকলেও আবেগতাড়িতভাবে তেমন কিছুউ বলা হয়ে ওঠেনি। সভাপতির বক্তব্যে শিল্পী আপাও অনেক কথা বলেছেন। শিল্পী আপা মনে ড. ইয়াসমিন আকতার সারমিন। অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে প্রফেসর ছিদ্দিকী ইতিহাসের অনেক বাঁকমোহনারকে চিত্রিত করেন। লেখাপড়ার বিকল্প কোন পথে নেই বলেও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

অসাধারণ আয়োজন শেষে আবারো আড্ডা। ঘড়ির কাঁটা প্রায় পাঁচটা ছুঁই ছুঁই করছে। কারো কোনো তাড়া চোখে পড়লো না। সবাই মুগ্ধ হয়ে ঘিরে রেখেছেন ছিদ্দিকী স্যারকে। অবশেষে আমিই স্যারকে ঘড়ির দিকে ইশারা করলাম। সেই সকাল থেকে বিভাগের সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি উপস্থিত আছেন। ছিদ্দিকী স্যারও বিষয়টি আমলে নিয়ে আমাকে উঠার পরিবেশ তৈরিতে ইংগিত দিলেন। সভা ভংগ হলো। সবাই বাইরে এলাম। পদ্মপুকুরের দক্ষিণ পাড়ে আবারো ফটোশেসন। তারপর বিদায়ের পালা। শিল্পী আপা তাঁর গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন আমাদের। আমরাও সবাইকে আল্লাহ হাফিজ জানালাম। সবাই বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন আমাদের বিদায় পথে। পদ্মপুকুরের মিষ্টি হাওয়ার পরশ ছুঁয়ে এগিয়ে চললো আমাদের গাড়ি। মনে হলো, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো!

(লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।)



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top