রক্তে কেনা বাংলা ভাষা

ড. মোহাম্মদ সাদিকুল ইসলাম স্বপন | প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:১২; আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:০৫

‘তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল
রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ, উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে
তীরের ফলার মতো
নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার:
বাঙালা বাঙালা’-
পৃথিবীতে যতগুলো নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দিয়েছেন ভাষা তার অন্যতম। ভাষা আছে বলেই মানুষ আজ এত সুন্দরভাবে কথা বলে, তেলাওয়াত করে, গান গায়, কবিতা আবৃত্তি করে, অভিনয় করে, মনের অভিব্যক্তি অন্যের সাথে বিনিময় করেন। ভাষা যে শুধু ভালো কাজে ব্যবহার হয় এমনটা বলা যাবে না, কারণ এই ভাষা নিয়েই আবার যুদ্ধ হয়, বিগ্রহ হয়, হয় দন্ধ-ফ্যাসাদ। বাংলা ভাষার ইতিহাস অন্ততঃ আমাদের তাই বলে, এই ভাষার জন্যই যুদ্ধ সংগ্রাম করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে মূল্যবান জীবন। পিচঢালা কালো পথ রক্তে রাঙানোর বিনিময়ে অর্জিত এই ভাষা; প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা ‘আমরি বাংলা ভাষা।’


পৃথিবীতে ভাষার ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষা নিয়ে লিখা হয়েছে অনেক ইতিহাস। যে ইতিহাসের আলো দেশের সিমানা পেরিয়ে বিশ্বকে করেছে আলোকিত, যে আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে বীর বাঙালীর রক্ত দানের বিরত্তগাঁথা কতকথা। পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার বিরল সম্মান, যা ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপি পালিত হয়ে থাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে। যাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই মর্যদা সেই মহাৎপ্রাণ আবুল বরকত, রফিক, শফিক, জাব্বার, সালামসহ নাম না জানা ভাষা শহীদদের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা পরপারে যেন শান্তিতে থাকেন তাঁরা।


বাংলা ভাষার মর্যদা লাভে আমরা গৌরাবান্বিত হই, বিশ্বের পঞ্চমতম বৃহত্তর ভাষার অধিকারি আমরা। রক্তের দামে কেনা আমার এ ভাষা, এটি শুধুই কি একটি ভাষা? আমার মনে হয় না; এটি শুধুমাত্র একটি ভাষা, এটি একটি নেয়ামত, একটি চেতনা, একটি স্বপ্নের বীজ। এ ভাষার জন্য কত লড়াই-সংগ্রাম, কতো সাধনা, কতো মায়ের স্বপ্নভঙ্গ, কতো বনের ভাই হারানোর বিচ্ছেদ বেদনা, কতো বধুর স্বামী হারানোর যাতনা। তাই এটিকে শুধু একটি ভাষা হিসেবে দেখলে চলে না।


অমর একুশের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধানে গৌরবের সাথেই স্থান বাংলা ভাষা স্থান পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংবিধানে সন্নিবেশিত হলেই কি ভাষা তার যথাযথ মর্যদা পেয়ে গেল? ভাষা অন্দোল ও বিজয় এবং ভষায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের মধ্যে দিয়েই সব পেয়ে গেলাম? বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের সিড়িতে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি। কিন্তু বাংলা ভাষার সম্মান ও যথাযথ মমার্থ কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? নানা প্রশ্ন বাংলা ভাষা প্রেমি, শিক্ষক ও গবেষকদের মনে আজ অতৃপ্তি তৈরী করেছে। রাষ্ট্রভাষার অর্থ শুধু সাংবিধানিক স্বীকৃতি, প্রতিবছর ঘটা করে শহীদ দিবস পালন, একুশের স্মৃতিচারণ, শহীদ মিনারে পুস্প অর্পণ, প্রভাতফেরি, ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা বা বিশাল করে বই মেলা? আসলে তা নয়, বাংলা ভাষার তাৎপর্য হলো দেশের প্রশাসনিক, শিক্ষার সর্বস্তর, বিচার ব্যবস্থার সর্বপর্যায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার সর্বাত্নক ব্যবহার। একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার আগেও আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতাম, সাহিত্য রচনা করতাম, নাটক করতাম, গান গাইতাম, এমনকি স্বপ্নও দেখতাম। স্বাধীনতা অর্জনের কিছুকাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার বিভিন্ন স্তরে ব্যবহারে ও এর প্রতি একটা আবেগ ছিলো, কিন্তু স্বাধীনতার উম্মাদনা ধীরে ধীরে কমতে থাকলে বাংলা ভাষার প্রতিও যত্ন কমতে থাকে। আর তা বুঝতে কোন গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না একটু চোখ কান খোলা থাকলেই বিষয়টি পানির মতো সহজ। রক্ত দিয়ে কিনা ভাষার প্রতি এমন অবহেলা কেন?
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক,সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। বাংলা ভাষার ব্যবহার কমতে থাকে। প্রয়োজন অপ্রয়োজনে ইংরেজি ভাষার ব্যববহার বাড়তে থাকে।

স্বাধীনতার কিছুকাল পর পর্যন্ত বাংলাদেশে একজন আগুন্তক প্রবেশ করলে বুঝতে পারতেন যে তিনি একটা স্বাধীন দেশে প্রবেশ করেছেন যে দেশের পথঘাট, দোকানপাট, সব কিছুর নাম বাংলায় লেখা। ধীরে ধীরে অবস্থা একেবারেই বদলে গেছে। দেশের সবখানে বিশেষ করে ঢাকার ছোট বড় সব বিপনি কেন্দ্রের নাম ও সাইনবোর্ড অধিকাংশই ইংরেজিতে লেখা। ইংরেজির প্রভাবে যেন মনে হয় দেশের ভাষা বদলে গেছে। ইংরেজি দুষনীয় নয় তবে বাংলা বাদ দিয়ে যখন বিদেশী ভাষা আধিপত্য বিস্তার করে তখন এটা কি মনোবৃত্তির পরিচয়ক? এটা কি কোন স্বাধীন আত্মমর্যাদাশীল দেশ, জাতি ও সমাজের পরিচয়-না তার শত শত বছরের পরাধীনতাজনিত হীনম্মন্যতার বর্হিপ্রকাশ? এ এক বিকৃত রুচির পরিচয়ক। আমারা এই মহামারি করোনাকালে গভীরভাবে লক্ষ করছি সবখানে ছোট ছোট স্টিকারে লেখা ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ আবার ‘নো স্মোকিং জোন’ বাড়ির দালানে ঝুলানো ‘টু লেট’ ব্যাপকভাবে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার হচ্ছে অনায়াসে এখানে আমাদের জাতিগত মূল্যবোধ, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি কোন সম্মান ও দায়বোধ না থাকায় একটা বড় কারণ বলেই মনে হয়।


স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের স্বপ্ন ছিলো সর্বপ্রকার শিক্ষা সর্বস্থরে মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত হবে, সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ইংরেজি, আরবী প্রভৃতি ভাষা শেখানো হবে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র ২০-৩০ বছরের শিক্ষার মাধ্যমরুপে ক্রমশ ইংরেজি ভাষা চালু এবং বাংলা ভাষা বর্জিত হতে শুরু করেছিলো যা এখন ৫০ বছরে এসে আরো বেশি নিগ্রহের কবলে। স্বাধীন বাংলাদেশের অনেক ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার নেই, পাকিস্থান আমলেও এমন চিন্তা অকল্পনীয় ছিলো, তাহলে আগুন জ্বলে উঠতো। কিন্তু স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা বর্জনের প্রক্রিয়া এখন প্রায় চূড়ান্ত।

যে শিক্ষার্থী ঘরে বসে টেলিভিষণের সামনে বসে অহরহ হিন্দি ছবি বা ইন্টারনেটে ইংরেজি ছবি দেখছে, সে ইংরেজি বা হিন্দী ভাষায় সেক্স, ক্রাইম, ভায়োলেন্স-এর পাঠ নিচ্ছে, স্কুল কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজির মাধ্যমে যে শিক্ষা লাভ করছে তার মধ্যেও স্বদেশের ঐতিহ্য বা শিকড় বা ঠিকানার সন্ধান নেই। ফলে যে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে তা একাধারে উৎকেন্দ্রিক ও হতভাগ্য কারণ সে তার মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মাধুর্য এবং রস থেকে বঞ্চিত। সে না রইল দেশি না হতে পারলো বিদেশী ফলে সে নিজ দেশে পরবাসি। তার কাছ থেকে সৃজনশীল বা মননশীল কোন কিছুই আশা করা যায়না। আমাদের দেশের মেধাবি শিক্ষার্থীরা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষিত না হবার ফলে মাতৃভাষা বা স্বদেশি সংস্কৃতির বিকাশে তাদের অংশগ্রহণ ও অবদান রাখার পথ বন্ধ। শিকড়বিহীন এক অদ্ভূত প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে আমার স্বাধীন বাংলাদেশে।


বাঙালা ভাষা সর্বস্তরে চালু করতে হবে এই আবেগদীপ্ত দাবিটি ছিলো বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিপূর্ণ এটি কোন হুজুগ নয়। এ আবেগ কয়েক’শ বছরের ভাষাধীপত্যর বিরুদ্ধে বাঙালীর সচেতন বিদ্রোহ। এক কথায় বাঙালী জাতীর পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্টপূর্ণ উপাদানটি হচ্ছে তার বাঙালা ভাষা। ভাষা সংক্রান্ত বাঙালীর অবেগ তার অন্যান্য আবেগ থেকে মুলগতভাবে ভিন্ন। বাঙালীর এ আবেগ যে অত্যন্ত শক্তিশালী ও গভীর এ সত্য ১৯৪৮ এ, ১৯৫২-এ, ১৯৫৪-এ, ১৯৬২-এ,১৯৬৯-এ, এবং ১৯৭১-এ প্রকাশিত। কোন আইনে, অধ্যাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহারের কথা আটকে থেকে যাক আমরা তা চাই না, আমরা চাই বাংলা ভাষা তার মর্যদা ও সম্মানের সাথে ব্যবহারিত হোক।

 

 

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top