ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ: এক অবিস্মরণীয় নাম

আবু সুফিয়ান | প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৭:৩১; আপডেট: ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৮:১৪

ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর সম্মানে তৈরি বাংলাদেশের একটি ডাকটিকিট

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রাম যেন একটি সঙ্গীতময় গ্রাম। এই গ্রামেই আয়েত আলী খাঁর জন্ম। বাবার নাম সবদার হোসেন খাঁ। ডাক নাম সদু খাঁ। তিনি ছিলেন আগরতলা রাজ দরবারের সভাবাদক ওস্তাদ কাশেম আলী খাঁর শিষ্য। সদু খাঁর পাঁচ পুত্র ছমির উদ্দিন খাঁ, আফতাবউদ্দিন খাঁ, আলাউদ্দিন খাঁ, নায়েব আলী খাঁ ও আয়েত আলী খাঁ। পাঁচ পুত্রের সর্বকনিষ্ঠ আয়েত আলী খাঁ।

ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ১৮৮৪ সালের ২৬ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামের বিখ্যাত সংগীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১০ বছর বয়সে আয়েত আলী তার ভাই ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর কাছে তালিম গ্রহণ শুরু করেন। টানা সাত বছর এ সাধনা চলে। এরপর তিনি ভারতের মাইহারে গিয়ে অন্য অগ্রজ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে তালিম নেন। প্রথমে তিনি সেতার, এরপর সুরবাহার শেখেন। আয়েত আলীর বাদনে মুগ্ধ হয়ে মাইহারের মহারাজ তাঁর আসন নির্দিষ্ট করেন অগ্রজ আলাউদ্দিন খাঁর পাশেই।

পরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ রামপুরে নিজ গুরু ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে পাঠান আয়েত আলী খাঁকে। অনেক ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষা দিয়ে তিনি ওস্তাদ ওয়াজিরের শিষ্যত্ব লাভ করেন। দীর্ঘ তের বছর তিনি এখানে সাধনা করেন। তারপর গুরুর আদেশে কর্মজীবন শুরু করেন মাইহার রাজ্যে সভাবাদক হিসেবে। সেখানে দুই ভাই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর তত্ত্বাবধানে প্রাচ্য দেশীয় বাদ্যযন্ত্র দিয়ে একটি অর্কেস্ট্রা দল গঠন করেন। তাঁরা প্রমাণ করেন, ভারতীয় কনসার্ট পশ্চিমা অর্কেস্ট্রার চেয়ে কম নয়।

কলকাতার এক সভায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর বাজনা শুনে মুগ্ধ হন। তাকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানান এবং বিশ্বভারতীতে যন্ত্রসংগীত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করার অনুরোধ করেন। আয়েত আলী খাঁ কবিগুরুর অনুরোধ রক্ষা করেন।

আয়েত আলী কেবল একজন সুরস্রষ্টা নন। তিনি একজন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবকও। তিনি 'চন্দ্র সারঙ্গ', 'মনোহরা' ও 'মন্দ্রনাদ' নামক তিনটি বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবন করেন। 'সরোদ' ও 'সুরবাহার' নামক যন্ত্র দুটোর আধুনিক রূপদানের কৃতিত্বও তার। পাশাপাশি সঙ্গীতশিক্ষা প্রসারেও তার অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে দুটি সঙ্গীত কলেজ স্থাপন করেন।

১৯৬০ সালে সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'গভর্নর পদক' লাভ করেন। ১৯৬১ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার তাকে 'তঘমা-ই-ইমতিয়াজ' উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার 'প্রাইড অফ পারফরমেন্স' এবং ১৯৭৮ সালে মরণোত্তর 'বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার' লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ 'স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার' সম্মানে ভূষিত করেন।

ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর ছয় পুত্র ও তিন কন্যা। পুত্ররা হলেন আবেদ হোসেন খান, বাহাদুর হোসেন খান, মোবারক হোসেন খান, শেখ সাদী খান, তানসেন খান ও রুবাইয়াৎ খান। কন্যারা হলেন আম্বিয়া খানম, মমতা আহমেদ ও ইয়াসমিন খানম। তার পুত্রদের সবাই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

১৯৬৪ সালে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হন। এরপর ১৯৬৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর এই কিংবদন্তি মৃত্যুবরণ করেন।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top