দেওরাজের নরবলি, যূপকাষ্ঠ ও একজন মহান সাধক

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ২৬ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩২; আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২২ ০৫:০৪

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের যে কোনো জেলার ইতিহাসের চেয়ে রাজশাহীর ইতিহাস অনেক বেশি আকর্ষণীয়। সেই মহাকাল গড় রাজ্য, দেওরাজের শাসন-শোষন, কালো জাদুর চর্চা, নরবলি— এককথায় নির্যাতন ও শোষনের চরম পর্যায়ে চলে যাওয়া একটা জনপদ বলতে যা বোঝায়, তার সমস্ত উপাদানই ছিলো সেই সময়কার রাজশাহীতে।

তখনকার সময়ে কৃষিকাজ আর মাছ ধরা ছিল এই এলাকার অর্থনীতির মূল ভিত্তি। তাই শাসকদের মূল লক্ষ্য ছিল জেলে আর কৃষকদের কীভাবে হাতের মধ্যে রাখা যায়। তার জন্যে বিভিন্ন শাসক অনুসরণ করতো বিভিন্ন রকম পদ্ধতি। তৎকালীন রামপুর বা মহাকালগড় রাজ্যের শাসক ছিলো অংশুদেব চান্দভণ্ডী বর্মভোজ ও অংশুদেব খের্জুর চান্দ নামক দুই ভাই। বিভিন্ন দৈত্য-দানোর উপাসনা, নরবলি চড়ানো আর নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এ রাজ্যকে দেওরাজ্য ও রাজাদের দেওরাজ বলা হতো। দেওরাজের পদ্ধতি ছিলো, প্রতি বছর পূজার সময়ে একজন মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিতো। সেই পূজা কোন সময় হবে বা কী ধরনের বলি দেয়া হবে সেটা নির্ধারন করা হতো গণনার মাধ্যমে।

দেওরাজ্য ছিলো ধর্ম নামের অধর্মের আঁখড়া। অশিক্ষিত যুক্তিহীন প্রজারাও এসব মেনে নিয়েছিলো। পুজা-পার্বণ তো আর প্রতিদিন হয় না, আর একটামাত্র মানুষই তো মরবে। তাই প্রতিবার পূজার ঘোষনা কানে যেতেই শিউরে উঠতো প্রতিটি প্রজার অন্তরাত্না। ঢেরা পিটিয়ে শুরু হতো বলির উপযুক্ত নরের অন্বেষণ। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজনকে মনোনীত করা হতো। এই প্রক্রিয়াটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাঁপ ছেড়ে বাচতো সবাই। যাক, আপদ বিদায় হলো, আরো কিছুদিন সবাই মিলে নিরাপদে থাকা যাবে। শুধু কান্নার রোল উঠতো একটা পরিবারে।

এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো। সেসময় এর তাৎপর্য হয়তো কেউ সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু এখন আমরা বুঝি এই সামান্য ঘটনা কতটা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিলো এই জনপদে। একবার পূজার আগে বলির জন্য সাব্যস্ত হলো নাপিত-পরিবারের এক ছেলের নাম। তাকে বলি দেয়া হলো সেইবার। এরপর যখন আবার পুজার ক্ষণ এলো, দেখা গেলো এবারও গণনায় তোলা হয়েছে সেই একই ঘরের মেজো ছেলেকে। সেবার সেই পরিবারের প্রতিক্রিয়া কী ছিলো বা তারা প্রতিবাদ করেছিলো কি না, তা ইতিহাসে লেখাজোখা না থাকলেও এটা জানা আছে যে, সে বছরেও কোনো বিঘ্ন ছাড়াই সুসম্পন্ন হয়েছিলো পূজা ও নরবলি। এভাবেই চলে আসলো পরবর্তী পুজার ক্ষণ। আমাদের সম্ভাব্যতার অংক কি বলে? সেই পরিবারের কারো আবার বলির শিকার হওয়ার সম্ভাব্যতা কি খুব বেশি? না। কিন্তু পরের বছর দেখা গেলো এবারও বলির উপযুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে সেই একই নাপিত-বাড়ির তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এবং তাদের শেষ সন্তানটি।

পরপর দুই ছেলেকে বলির যূপকাষ্ঠে তুলে দেয়ার পর শেষ সন্তানকে বলির জন্য সাব্যস্ত হতে দেখে পিতার মনের ভেতর জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের ছাইচাপা আগুন। বলি দেওয়ার দিন যতই সামনে আসতে থাকে, সে ছটফট করতে থাকে। যদি কোনোভাবে এই ছেলেটিকে পিশাচ রাজার হাত থেকে বাঁচানো যায়! কিন্তু একজন প্রবল প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে সামান্য এক দরিদ্র নাপিত কীইবা করতে পারে?

সে জানতো, তত দিনে দিল্লিতে মোগল শাসনের পত্তন হয়েছে, আরবের কণ্টকাকীর্ণ শুষ্ক জমি পেরিয়ে মুসলিম শাসকরা ক্রমে এগিয়ে আসছে ভারতের উর্বর মাটির দিকে। হিন্দু রাজারা তা নিয়ে বিলক্ষণ দুশ্চিন্তায় ছিলো। মুসলিম-বাহিনীকে যদি কোনোভাবে এই দেওরাজের ভূমিতে আনা যায়, বলি-অনুষ্ঠানের আগেই, একমাত্র তাহলেই হয়তো বাঁচানো যাবে তার শেষ সন্তানকে। এই আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখতেই অতি গোপনে সে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলো এক মুসলিম সাধকের সাথে। তার কানে গিয়েছিলো , এই সাধক অত্যন্ত দয়ালু মানুষ। তার কাছে যদি এই অত্যাচারের কাহিনিটা সে খুলে বলতে পারে, তাহলে তিনি নিশ্চই কোনো মুসলিম রাজার দরবারে তা পৌছে দেবেন।

এই ভেবেই যোগাযোগ করে সে কোনোভাবে পৌছে গেলো মুখঢাকা সেই সাধকের দরবারে। তুরকান শাহ হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিম শাসকদের নজর কেন্দ্রীভূত ছিলো মহাকাল গড়ের দিকে। তুরকান শাহ ছিলেন বড়পির আবদুল কাদের জিলানির বংশধর। তাঁকে এই অত্যাচারী ভ্রাতৃদ্বয়ই প্রায়-নিরস্ত্র অবস্থায় শহিদ করে ইসলামপ্রচারের অপরাধে। তাই বড়পির আবদুল কাদের জিলানির নির্দেশে এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের বিশেষ দায়িত্ব নিয়েই বর্তমান বাঘা উপজেলায় আস্তানা গেড়েছিলেন ছদ্মবেশী মুসলিম সাধক। নাপিতের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন তিনি। ঠিক হলো সন্ধ্যায় পদ্মার তীরে আসবেন তিনি, সেখানেই বিস্তারিত কথা বলবেন সেই নাপিতের সাথে। এরপর যা করার তা করা হবে। কথা বলে নাপিত কিছুটা আশস্ত হয়ে ফিরে এলো সেই দরবার থেকে, তবুও মনের ভেতর দুশ্চিন্তার মেঘ। কারণ, ঠিক পরের দিন সকালেই যে বলির অনুষ্ঠান!

সেদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই এক নিঃসহায় পরিবারকে দেখা গেলো উদ্ভ্রান্ত চেহারায় পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখন সেই সাধক আসবেন, উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তাদেরকে। ক্ষণে ক্ষণে চকচক করে ওঠে নাপিত পিতার চোখ, আবার পরক্ষণেই চেহারা মিইয়ে যায় দুশ্চিন্তায়। কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে অনেক রাত তো হলো, কোথায় সেই সাধক?

অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর নাপিত বুঝতে পারলো আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বৃথা। কেউ আসবে না তাদেরকে বাঁচাতে। যা করার নিজেকেই করতে হবে। হয় পুরো পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে, ধরা পড়লে সপরিবারে মরতে হবে, আর নাহলে নিজেরাই নিজেদেরকে শেষ করে দিতে হবে। অন্তত আর কোনো ছেলেকে বলির যন্ত্রে তুলে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। হতাশ, নিরুপায়, বিব্রত সেই নাপিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো। মনস্থির করলো সপরিবারে পদ্মার নদীতে ঝাপ দেবে তারা। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যেতে লাগলো উত্তাল পদ্মার স্রোতের অভিমুখে। কোমর থেকে গলা পানি পর্যন্ত এগিয়েছে তারা, ঠিক এমন সময় সে সামনে থেকে একটা ডাক শুনতে পেলো, ‘ভয় নাই! ভয় নাই!’ হঠাৎ ডাক শুনে চমকে উঠে ঝট করে সামনে তাকালো লোকটি।

আরেটু সামনে এগোতেই দেখতে পেলো কুমির আকৃতির একটা অবয়ব। একটা নৌযান। তার ভেতর থেকে একটা হাত তার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেওয়া হলো, প্রচণ্ড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে একে একে তারা উঠে আসলো সেই নৌযানে। নাপিত বাঘায় আস্তানা গড়া যে সাধকের কাছে গিয়েছিলেন, কথা বলার পুরোটা সময় তার মুখ কাপড়ে ঢাকা ছিলো। কিন্তু এখন কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলো, ইনি আসলে সেই সাধক, যার সাথে সে কথা বলেছিলো।

তখনো নাপিত ও তার স্ত্রী-পুত্রের ভয়ের রেশ কাটেনি, ঘটনার আকস্মিকতায় তারা রীতিমতো থরথর করে কাঁপছিলো। সাধক তাদের অভয় দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, তার যেই পুত্রকে বলি দেওয়ার কথা, তাকে অভয় দিলেন, দোয়া করলেন। এরপর বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যাও, তোমার ছেলেকে কেউ বলি দিতে পারবে না, আর খুব শীঘ্রই এই দেওরাজার পতন হবে, নরবলির প্রথা লোপ করা হবে।’

নরবলির প্রথা লোপ করা হয়েছে। দেওরাজ্য আজ বিশ্বের সভ্য শহরগলোর মধ্যে অন্যতম শহর। তবে কালের সাক্ষী হিসেবে এখনও রয়ে গেছে দেওরাজের সেই যুপকাষ্ঠ। 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top