বাংলার বর্ষা উৎসব

রাজ টাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৬ জুন ২০২২ ০৬:১৩; আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ২২:১৮

বাংলার বর্ষার প্রতীক কদম ফুল।  ছবি: সংগৃহীত

বৃষ্টি নিয়ে, বর্ষা ও বর্ষাকাল নিয়ে গান কবিতার শেষ নেই। বাঙালির কাছে বর্ষাকাল মানেই যেন উৎসব। গ্রামের বাড়িতে টিনের চালে ঝুম ঝুম বৃষ্টি শব্দ যেন মনের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। উচাটন বা আনমনা করে দেয় ক্ষণিক সময়ের জন্য। আর বর্ষাকালে ভুনা খিচুড়ির স্বাদ তো অনন্য। বাঙালির বৃষ্টি বিলাশ নতুন কিছু নয়। শাহ আবদুল করিম লিখেন, বর্ষা যখন আইতো, গাজির গান হইতো, রঙে ঢঙে গাইতো আনন্দ পাইতাম। এভাবে বর্ষার সাথে সারা বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মিশে রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা ও কুশিয়ারাতে যখন পানির ঢল নামে তখন এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। এ অঞ্চলে তখন ঝিলমিল ঝিলমিল ময়ূরপঙ্খি নাও সাজিয়ে নৌকাবাইচ হয়, সারি গান হয়। বৃষ্টিকে ঘিরে আরো অসংখ্য উৎসব হয়।

ধামাইল উৎসব

দেশ বিভাগের পূর্বে সিলেট অঞ্চলে বর্ষাকালে অবসর সময়ে মহিলারা একসঙ্গে বসে হাঁসি, ঠাট্টা, ও গল্প গুজব করতেন। গুজবে মত্ত থাকার এ মুহূর্তটাকে বলা হতো ধুম্বইল। আর এই আড্ডা একসময় নাচে গানে রূপ নিত, এটাকে বলা হত ধামাইল। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ধামাইল গানের প্রচলন রয়েছে। রাধারমণ দত্ত ধামাইল গানকে বেশি জনপ্রিয় করেন। তাছাড়াও শাহ্ আব্দুল করিম, প্রতাপ রঞ্জন তালুকদার, ভরত চন্দ্র সরকার, শিখা রানী দাস, সুনীল চন্দ্র সরকার প্রমুখ শিল্পী ধামাইল গান রচনা করেছেন । ধামাইল নাচের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে এ নাচ স্ত্রীসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এরপর প্রতি বর্ষায় তারা আয়োজন করে ধামাইল গানের উৎসব। এতে অংশ নেয় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার লোকশিল্পীরা। ধামাইল আসরের পাশাপাশি থাকে কিসসা পালা, লোকনৃত্য, গাজীর গীত, সিমিস্যা গান ও পুঁথিপাঠের আসর।

নৌকা বাইচ

মোঘল আমল থেকে বাংলার ভাটি অঞ্চলে প্রশাসনিক অন্যতম উপায় ছিল নৌশক্তি। বারো ভুঁইয়ারা নৌবলে বলিয়ান হয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় নদনদীর উপস্থিতি প্রবল। নৌকা বাইচ এদেশের লোকালয় ও সংস্কৃতির এক সমৃদ্ধ ফসল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে। প্রতি বর্ষায় সুরমা নদীতে এই নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সুনামগঞ্জের কালনী নদীতেও আরেকটি বড় নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি বর্ষাকালে বাংলাদেশের প্রতিটা অঞ্চলেই এমন নৌকা বাইচের আয়োজন করে থাকে। নৌকা বাইচে এক সুরে নৌকার প্রতিযোগীরা গান গায়। এসব গানে থাকে প্রকৃতির কাছে সাহস সংগ্রহের আবেদন। সেইসাথে নৌকার গতি অনুসারে অনেকে নৌকার সুন্দর সুন্দর নামও ঠিক করেন। যেমন ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, সাইমুন, তুফান মেল, ময়ূরপঙ্খি, অগ্রদূত, দীপরাজ, সোনার তরী ইত্যাদি।

যাত্রা পালা

বর্ষাকালে বাংলাদেশের নিচু অঞ্চল, হাওরগুলো পানিতে ফুলে ফেঁপে সাগর হয়ে যায়। আর ভাটি অঞ্চলের মানুষ বর্ষাকালে পানিবন্দী। আর ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্ষাকালে কয়েক গ্রাম মিলে আয়োজন করে যাত্রাপালা। ভাটি অঞ্চলের বিনোদনের উৎস বিভিন্ন ধরনের যাত্রাপালা। তবে কালের আবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই গভীর রাতে হাজারো নির্ঘুম দর্শকের সামনের যাত্রাপালার আবেদন দিন দিন কমে আসছে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত পালাগুলোর মধ্যে রয়েছে সিরাজ-উদ-দৌলা, সোহরাব-রুস্তম, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, রূপবান ইত্যাদি। মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে যাত্রা দেখতে আসে মানুষ। সারারাত ধরে ঢুলু ঢুলু চোখে কুপির আলোতে দেখে রঙিলা স্বপ্ন।

গীত পরিবেশন

ভাটি অঞ্চলে গীত পরিবেশনের আসর বসে কৃষকের বাড়ির উঠোনে। বর্ষার উৎসবের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী বিষয় হিসেবে মধ্যযুগের মনসা। অবিরল বৃষ্টিপাতের মধ্যে প্রস্ফুটিত বর্ষার অন্যতম ফুল কদম। ছাতিম আর গাবফুলের মদির সুগন্ধ বাংলার মানুষকে সৃষ্টিশীল মানবিক করে তোলে। গ্রামের নারীদের সৃজনশীলতার একটা অন্যতম সময় এই বর্ষাকাল। বর্ষায় সহজে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে দৈনন্দিন কাজ করা যায় না। বর্ষায় গ্রামের নারীরা নকশি-কাঁথা সেলাই করতে বসেন। এটি সারা বাংলার ঘরে ঘরে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ রচনা করে। সেলাইয়ের ফোঁড়ে, ফোঁড়ে পুরনো কাপড়ের পরতে পরতে উঠে আসতে জীবনের কথকতা। এটিও বাংলাদেশের বর্ষার উৎসবের একটা অত্যন্ত প্রাণময় এবং বর্ণিল অংশ।

বর্ষার উৎসবের সাথে যুক্ত হয় বর্ষার উপযোগী রকমারী মুখরোচক সব খাবার। এর মধ্যে অন্যতম ভোজন-রসিক বাঙালির পাতে দেয়ার জন্য সুগন্ধী চিনিগুড়ি চালের ভুনা খিচুড়ির সাথে কলাপাতায় মোড়ানো পদ্মার ভাপা ইলিশ। সরষে বাটা ইলিশ, কাঁচা তেঁতুল দিয়ে নতুন বর্ষার জলের চকচকে চেলা অথবা পাবদা মাছের ঝোল। শেষ পাতে পায়েস অথবা চন্দ্রপুলী পিঠা! আষাঢ- শ্রাবণ জুড়ে চাই বৃষ্টি দেহে- মনে।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top