দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিয়ে শনিবারের বিশেষ আয়োজন

রাজনীতিতে ক্ষীণ হয়ে আসছে জামায়াতের প্রভাব

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ৭ জানুয়ারী ২০২৩ ২২:১২; আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ২২:০২

ছবি: বণিক বার্তার

দেশে নব্বই-পরবর্তী সময়ে প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। খবর বণিক বার্তার। 

কখনো এককভাবে ক্ষমতায় আসতে না পারলেও একসময় জাতীয় নির্বাচনের ফল নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে দলটিকে। তবে কয়েক বছর ধরে দেশের রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি দলটি। সামনের দিনগুলোয়ও দলটির হারানো প্রভাব ফিরে পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের প্রভাব এখন দিনে দিনে ক্ষীণ হয়ে আসছে বলে মনে করছেন তারা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনোই এককভাবে ক্ষমতায় যেতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী। যদিও নব্বই-পরবর্তী রাজনীতিতে বড় প্রভাবক হিসেবে সবসময়ই বিশ্লেষকদের আলাদা মনোযোগ পেয়েছে দলটি। তাদের ভাষ্যমতে, নেতৃস্থানীয়দের অভিজ্ঞতা ও সাংগঠনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছিল জামায়াত। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতায়ও এসেছিল দলটি। তবে দলটির প্রভাবে ভাটা পড়তে দেখা যায় ২০১৩ সাল থেকে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ কয়েকজন নেতার ফাঁসি কার্যকর হলে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে জামায়াতে ইসলামী।

ওই সময় থেকে দলটির প্রকাশ্য রাজনৈতিক উপস্থিতিও দিনে দিনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠতে দেখা গেছে। এ অবস্থা থেকে দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনাও এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছেন না দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষকরা। ইউরোপিয়ান ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের এক পেপারে এ-সংক্রান্ত এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান দিনে দিনে ফিকে হয়ে আসছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে শীর্ষ নেতাদের বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়টিই তাদের দুর্বল হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। ফলে আর্থিকভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। এখন কেবল অলৌকিক কোনো কিছুর মাধ্যমেই দলটির ফিরে আসা সম্ভব।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির সাবেক সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনগণের মধ্যে তাদের সে রকম বড় কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু তারা মেথডিক্যালি চলে বিধায় সহজেই সমাজ থেকে উঠে যাবে না। এ ধরনের দলগুলো প্রাণশক্তি খুঁজে পায় দক্ষিণপন্থী অন্যান্য দল থেকে। বিশেষ করে বিএনপি এ দলগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে, যে পৃষ্ঠপোষকতার পরিণতিতে জামায়াত রাজনীতিতে ফিরে এসেছিল। আমি তাদের খুব খাটো করে দেখতে চাই না। তাদের বড় দল হিসেবে অবস্থান আপাতত খর্ব হয়েছে। কিন্তু এটিই শেষ কথা না। তাদের সে অবস্থাটি সংকুচিত হয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনেও তা দেখা যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে ওরা নিষ্ক্রিয় নয়।’

মওলানা আবুল আ’লা মওদুদীর হাত ধরে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম। প্রথমদিকে নিজেকে সামাজিক সংগঠন হিসেবেই দাবি করত জামায়াত। ইসলামিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে সমাজের পরিবর্তনকে নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে দাবি করত দলটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক থেকে রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয় জামায়াত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় দলটি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এরই সূত্র ধরে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে সব ধরনের ইসলামিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৭ সালের পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে আবারো সক্রিয় হয় জামায়াতে ইসলামী। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর সুবাদে এ দেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ পায় দলটি। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ২০০১ সালে সরকারে ঠাঁই পায় জামায়াত। তবে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর দলটির অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে এমন একটি সাধারণ সমীকরণের সময় এখনই আসেনি। কেননা এ ধরনের রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি বিশ্বাসভিত্তিক, যুক্তিভিত্তিক না। এখন দলটি আর্থিকভাবে দুর্বল হলেও সমর্থকদের বিশ্বাস বা চিন্তার জায়গা যে বন্ধ হয়ে গেছে, তা তো নয়।’

জামায়াতের রাজনৈতিক উপস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ার শুরু ২০১৩ সালে। সে সময় দলটির অন্যতম নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মুখে সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে পরিবর্তন আনা হয়। আদালতে ঘোষিত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মুহাম্মাদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলীর মতো জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের। দলটির আজীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া সাবেক আমির গোলাম আযমের মৃত্যু হয় কারাগারেই। দলের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুই জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তিকে খর্ব করে তুলেছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

দলটির অর্থনৈতিক শক্তিকে পর্যুদস্ত করে তোলে মীর কাসেম আলীর মৃত্যু। তাকে বলা হতো দলটির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। জামায়াতের তহবিলের বড় একটি অংশের জোগান আসত মীর কাসেম আলীর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। তার গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ডের পর জামায়াত ঘরানার প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় বন্ধ বা দলটির হাতছাড়া হয়ে পড়েছে। ভঙ্গুর হয়েছে দলটির আর্থিক সক্ষমতাও।

দলটির বর্তমান নেতারাও রাজনীতিতে সেভাবে সরব হয়ে উঠতে পারছেন না। বর্তমান আমির ডা. শফিকুর রহমানও এখন কারাগারে। দলের অনেক নেতাকর্মী রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বা দলবদল করেছেন। নাগরিক ঐক্য ফোরামের সমন্বয়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সাংগঠনিকভাবে অবস্থাটা কেমন তা না জেনে বলা যায় না। বিএনপি-জামায়াতের জোট তো নেই। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন যে কেউ করতে পারে। জামায়াতও একই প্রোগ্রাম দিয়ে আন্দোলন করতে পারে। এরশাদের বিরুদ্ধে যখন আমরা পাঁচ দল আন্দোলন করেছি তখনো জামায়াত এভাবেই আন্দোলন করেছে। গণতন্ত্রহীনতা এ ধরনের শক্তিকে আরো বেশি শক্তি জোগাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এ রকম অবস্থা তাত্ত্বিকভাবে বিরাজ করছে, এটা শুধু বাংলাদেশে নয়।’



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top