10679

04/28/2025 বিপিসির মুনাফা কোথায় গেল?

বিপিসির মুনাফা কোথায় গেল?

রাজটাইমস ডেস্ক

১১ আগস্ট ২০২২ ১৭:০৯

দেশে আকাশছোঁয়া জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে বিপিসির বিপুল মুনাফা কোথায় গেল সে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এত বেশী মূল্যবৃদ্ধির কেন যৌক্তিকতাো খুঁজে পান না তারা। খবর টিবিএসের।

থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-র বিপুল মুনাফা দিয়েই দেশে জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়তো এড়ানো যেত। কিন্তু, সেপথে না হেঁটে সরকার বিপুল খরচের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে আপামর ভোক্তার কাঁধে। এর ধারাবাহিক প্রভাব পড়বে- পরিবহন, কৃষি উৎপাদনসহ সকল খাতে। মূল্যস্ফীতি তাতে আরও বাড়বে।

বুধবার (১০ আগস্ট) আয়োজিত এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সরকারকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তও পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।

রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে 'জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেত কি?'- শীর্ষক আলোচনায় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'শুধু দরিদ্র আর অতি-দরিদ্র নয়, নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষকেও এখন সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে'।

সিপিডি জানিয়েছে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি ছিল প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। যার অভাবে বিশ্ববাজারে যখন অপরিশোধিত জীবাশ্ম তেল (ক্রুড অয়েল) এর দাম কমতে শুরু করেছে, তখন দেশে আকস্মিকভাবে জ্বালানি তেলের এত বেশি দাম বাড়ানো হয়েছে।

সিপিডির মতে, ভর্তুকি কমানো মানেই তার বোঝা ভোক্তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া নয়। এর মাধ্যমে অপচয় কমানো হয়।

ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, এরমধ্যেই বাজে রূপ নেওয়া মূল্যস্ফীতিকে তেলের এই দর বৃদ্ধি আরও উস্কে দেবে। এজন্য সরকারকে খোলা বাজারে নিত্যপণ্য বিক্রয় (ওএমএস) কর্মসূচির মাধ্যমে- সারাদেশের দরিদ্র ও সীমিত আয়ের পরিবারগুলিকে জরুরি সহায়তা দিতে হবে।

অভিষ্ট জনগোষ্ঠী যাতে এই কর্মসূচির সুবিধা পায়, তা নিশ্চিতে বিপণন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এখন ব্যবসা পরিচালনার খরচ বাড়বে; এতে করে ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলির জন্য টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা সরকারের দেওয়া প্রণোদনা প্যাকেজ এবং ঋণ পরিশোধের বর্ধিত সুযোগ পেয়ে অনেক দিক থেকে উপকৃত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোট ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ পাননি।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ফাহমিদা উল্লেখ করেন, 'সরকারি হিসাবে মূল্যস্ফীতি এখন সাড়ে ৭ শতাংশ; কিছু কিছু পণ্যের দাম ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে, মূল্যস্ফীতিকে আরও শক্তিশালী করবে জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি'।

'সাধারণ মানুষই এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হবে। অনেক মানুষ এখনও করোনা মহামারির আভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অনেককে সঞ্চয় ভেঙে চলতে হচ্ছে। এই অবস্থায় দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা না করে, তাদের ওপর আরও বোঝা চাপানো হয়েছে'।

তিনি বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ানোর সময়, স্বল্প-আয়ের মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবটা বিবেচনা করা হয়নি।

ভর্তুকি অপচয়কে উৎসাহিত করে। আবার একইসাথে দরিদ্র ও স্বচ্ছল মানুষ সকলেই এর সুবিধা পায় উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'আমরা সরকারকে ভর্তুকি উঠিয়ে নিতে বলছি, তা আইএমএফ-এর শর্ত হোক বা না হোক। কিন্তু এটা ধাপে ধাপে করতে হবে'।

আলোচনায় অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডাররা বলেছেন, এই মূল্যবৃদ্ধিতে চাষাবাদের খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। পোশাক শিল্পের জন্যও অনেক সমস্যা তৈরি হবে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমরা সরকারকে জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বলে আসছি। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, আকস্মিকভাবে মূল্যবৃদ্ধি করতেই হবে।

'এমন সময়ে এই দাম বাড়ানো হয়েছে, যখন মানুষ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে অরক্ষিত। তারপরও জ্বালানির দাম এত অস্বাভাবিক উচ্চ হারে বাড়ানো হয়েছে, আমরা যার পেছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না'।

তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির এই সংকটকালে সরকার জ্বালানির ওপর আরোপিত কর প্রত্যাহার করতে পারতো। কিন্তু, তা না করে 'মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষভাবে কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে'।

এই সিদ্ধান্তকে 'চরম বৈষম্যপূর্ণ' উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে ধনীদের কিছুই হবে না; কিন্তু দরিদ্রদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হবে।

বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ)-র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, জ্বালানি তেল ব্যয়বহুল হলেও–গ্যাস সংকটের কারণে ইতোমধ্যেই কারখানা পর্যায়ে এর ব্যবহার বেড়েছে।

'নতুন দামে ডিজেল কিনে আমাদের পক্ষে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতাদের সাথে নতুন করে পোশাকের দাম নিয়ে আলোচনার অবস্থাতেও নেই আমরা। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাবের কারণে গত দুই মাস ধরে পোশাকের বিক্রি কমেছে রপ্তানি বাজারে। এই অবস্থায়, জ্বালানির এই মূল্যবৃদ্ধি আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে'।

এর পরোক্ষ প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, এতে শহরে জীবনযাপনের ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। অনেক শ্রমিক গ্রামে ফিরে যাবে। এতে আমাদের শিল্প বন্ধ হবে।

বিপিসি লোকসানে, সত্যিই?
সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রতি বিঘা জমিতে ধান চাষের খরচ এক হাজার টাকা বাড়বে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকরা বিপুল লোকসানের মধ্যে পড়বে। তাই কৃষকদের চাষাবাদে উৎসাহিত করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে, সরকারকে ধান ও চাল ক্রয়ের উচ্চ মূল্য ঘোষণা করতে হবে'।

তিনি জানান যে, দেশে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, যার ৭৫ শতাংশ ডিজেলচালিত। সরকারের প্রতি, কৃষকদের আগের মূল্যেই তেল সরবরাহের আহ্বান জানান আনোয়ার ফারুক।

'কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশ বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে'- যোগ করেন তিনি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, শহরে প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া আড়াই টাকা নির্ধারণ করা হলেও বিভিন্ন পরিবহন তিন থেকে সাত টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে।

'আমরা প্রায় ৩০০-৩৫০ মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখেছি- জ্বালানির দাম বাড়ানোর পর শহরে যাতায়াত খরচ বেড়েছে গড়ে ৭০ থেকে ২০০ টাকা'।

মানুষ যাতে স্বস্তিতে জীবনযাপন করতে পারে তা নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু, আমাদের জরিপে দেখা গেছে মানুষ এখন প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে- যোগ করেন তিনি।

সিপিডি'র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-র সঞ্চিত আমানত দিয়েই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো যেত।

তিনি বলেন, 'ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার মানে ভোক্তার ওপর দায় চাপানো নয়, অপচয় কমানো'।

বিপিসির গত সাত বছরের মুনাফা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'এ টাকা কোথায় গেল? তাদের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। এটা আইএমএফের জন্যও যদি করা হয়, তাহলেও ভোক্তার ওপর না চাপিয়ে আরও কিছুদিন চালিয়ে নেওয়ার আর্থিক সক্ষমতা বিপিসির ছিল'।

মূল খবরের লিঙ্ক

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]