10804

04/29/2025 রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা, আশার গুড়ে বালি

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা, আশার গুড়ে বালি

রাজটাইমস ডেস্ক

২৩ আগস্ট ২০২২ ১৮:৪৩

অর্থনীতির আরেক বিষ ফোঁড়ার নাম ঋণ খেলাপী। বছরের পর বছর এই সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারণ করছে। এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা বিগত তিন বছরেও অর্জন করতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। খবর যুগান্তরের।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট অঙ্কে খেলাপি ঋণকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এপিএ করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ব্যাংকগুলোয় বেড়েই চলছে খেলাপি ঋণ। ফলে বছর শেষে মূল্যায়নে দেখা গেছে, ঋণখেলাপির অঙ্ক স্থিতি রাখার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না এফআইডি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এফআইডির এপিএ চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত একাধিক কর্মকর্তা খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেন। তাদের মতে, খেলাপি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা দায়ী। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের বা কঠোর কোনো জবাবদিহির মধ্যে পড়তে হয় না। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও এফআইডিকে খুব বেশি জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না। ফলে এ ধরনের চুক্তি শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, আগামী এক অর্থবছরে খেলাপি ঋণ কতটুকু কমিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থিতিতে আনতে পারবে এর সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা বছরের শুরুতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সংগ্রহ করে এফআইডি। সে লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে এফআইডি। আর সেটি নিয়েই বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) করা হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে। তবে এপিএ চুক্তিতে ঋণখেলাপির সূচক ছাড়া অন্যান্য সূচকও থাকে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো শতভাগ ছাড় দিয়েছে ঋণখেলাপিদের। এ ছাড়ের মধ্য দিয়ে ঋণখেলাপিদের এক ধরনের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একদিকে খেলাপিদের বড় ছাড়, অপরদিকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণের অঙ্ক কমেনি। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে খেলাপি ঋণ স্থিতি রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ চুক্তি (এপিএ) করেছে সেটি কমাতে সফল হয়নি। এর কারণ হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে রেগুলেটরি করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ কীভাবে বৃদ্ধি পায়, সেদিকে নজর দেওয়া হলে দেখা যাবে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে আদায় কঠিন হয়ে পড়েছে। বড় বড় খেলাপির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের অগ্রগতি খুবই কম। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বোর্ড কী করছে সেটিও প্রশ্ন। তবে বোর্ডেই যদি ভূত থাকে তাহলে শর্ষের মধ্যে ভূত তাড়াবে কে। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, খেলাপি ঋণ কমানো এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং করার জন্যই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সবকিছু যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকই করে, তাহলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দরকার ছিল না।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এপিএ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২০২২-এই তিন অর্থবছর খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সেটি অর্জন হয়নি। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের স্থিতি ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এপিএ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে। সেখানে বলা হয়, এই লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে সেক্ষেত্রে এপিএতে মূল্যায়ন সূচক হবে ‘অসাধারণ’। এছাড়া খেলাপি ঋণ যদি ৪১ হাজার কোটি টাকার ঘরে থাকে, সেটি ৯০ শতাংশ অর্জন ধরা হবে, মূল্যায়ন হবে ‘অতি উত্তম’ হিসাবে। আর তাও না হয়ে ঋণ ৪১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঘরে থাকলে সেটিকে ৮০ শতাংশ অর্জন ধরে ‘উত্তম’ হিসাবে মূল্যায়ন করা হবে। আর খেলাপি ঋণ যদি ৪২ হাজার কোটি টাকার ঘরে থাকে, সেটিকে ৭০ শতাংশ অর্জন ধরে ‘চলতিমান’ এবং ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঘরে থাকলে ৬০ শতাংশ অর্জন ধরে ‘চলতি মানের নিম্ন’ হিসাবে মূল্যায়ন করা হবে।

কিন্তু সর্বশেষ (২০২১-২২ অর্থবছর) কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে খেলাপি ঋণের অঙ্ক প্রকাশ করেছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের হচ্ছে ৫৫ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মোট ঋণের ২১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বছরে মোট ঋণ বিতরণ করা হয় ২ লাখ ৫২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।

উল্লিখিত বছর এপিএ-এর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, এফআইডি বিভাগ অসাধারণ, অতি উত্তম, উত্তম, চলতিমান ও চলতি মানের নিম্ন কোনো সূচকই অর্জন করতে পারেনি। এসব সূচকের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে খেলাপির ঋণে অঙ্ক।

২০২০-২১ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এপিএ চুক্তি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই বছর খেলাপি ঋণের স্থিতি ৪০ হাজার কোটি টাকার ঘরে রাখার প্রতিশ্রুতি ছিল এফআইডির। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে এফআইডির প্রতিশ্রুতি ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘরে খেলাপি ঋণের স্থিতি রাখা। কিন্তু ওই বছরে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা।

জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্মসচিব এপিএ-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুখসানা হাসিন যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ মনিটরিংয়ের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও আছে। তবে এফআইডি বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হয়। সেখানে যারা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তাদের সতর্ক করা হয়। তবে সম্প্রতি কয়েকটি বছর করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হওয়া, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে খেলাপি ঋণ বেশি আদায় করা সম্ভব হয়নি। এজন্য খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

প্রসঙ্গত, চলতি ২০২২ সালের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের (সরকারি ও বেসরকারি) মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। তিন মাস আগে মার্চ শেষে খেলাপি ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১১ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১ সালের জুন প্রান্তিক শেষে খেলাপি ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ২৬ হাজার ৫২ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ।

মূল খবরের লিঙ্ক

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]