1084

03/15/2025 জলবায়ু পরিবর্তনে নানা দুর্যোগে বাংলাদেশ

জলবায়ু পরিবর্তনে নানা দুর্যোগে বাংলাদেশ

রাজটাইমস ডেস্ক

২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৭:০৭

দেশে ক্রমাগত বন্যার নাকালে বিপর্যস্ত ও দিশেহারা মানুষ। বিশেষ করে নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা নাভিশ্বাস উঠেছে। ঘরবাড়ি, ফসলি জমি এমনকি স্কুল ও হারাতে হয়েছে প্লাবনে। চলতি মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলে চতুর্থ আর পূর্বাঞ্চলে পঞ্চম দফা বন্যা চলছে। উভয় অঞ্চলে সর্বশেষ বন্যাটি শুরু হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর। এটি আরও কয়েক দিন চলতে পারে।

মৌসুমের প্রথম বন্যা দেখা দেয় চলতি বছরের জুনের প্রথমদিকে। উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে এই বন্যা দেখা দেয়। সেই থেকে তিন মাস ধরে মানুষ বন্যার সঙ্গে বসবাস করছে। এর মধ্যে ২৭ জুন থেকে এক নাগাড়ে দেড় মাস বন্যাকবলিত ছিল দেশের উত্তর, পূর্ব এবং মধ্যাঞ্চল।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিই বন্যা সৃষ্টির প্রধান কারণ বলে মনে করেন জলবায়ু ও বন্যা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেছে। এর প্রভাবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে।

বিশ্বের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের বিষয়ে অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন। তারা বলেছিলেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার হবে। চলতি বছর দফায় দফায় বন্যা, মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাত, অতিবৃষ্টি, নজিরবিহীন জোয়ারে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনা এবং গত কয়েক বছরের বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগ পরিস্থিতি তাদের কথার সত্যতাই প্রমাণ করে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও দেশের সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে যায়। এতে নানা ধরনের দুর্যোগ বেড়ে যায়। এবারের কয়েক দফা বন্যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যায়। এর কারণ হচ্ছে- আবহাওয়ার দুটি সিস্টেম সক্রিয় হলে পৃথিবীতে ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে যায়। এর একটি হচ্ছে ‘এল-নিনো বা লা-নিনো’, আরেকটি হচ্ছে ‘ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশন’ (এমজেও)। এবার এর কোনোটিই সক্রিয় নয়। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন, দীর্ঘমেয়াদি, রেকর্ড ভঙ্গকারী আর ভয়াবহ বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আছে। এবারের বন্যার প্রকৃতি আর গত কয়েক বছরের বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য দুর্যোগের রেকর্ডও সেটাই প্রমাণ করছে।

দেশের সরকারি বন্যা পরিসংখ্যান হিসাব অনুসারে কয়েক দফা বন্যায় এবার দেশের ৩৫টি জেলা কবলিত হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় ৮ জেলা জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানিতে ডুবে বন্যার মুখোমুখি হয়। জুনের মাঝামাঝি প্রথমে তিস্তায় বন্যা হয়। বড় আকারের বন্যা শুরু হয় ২৭ জুন। সবমিলে এবার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, আপার মেঘনা, পদ্মা অববাহিকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি অববাহিকায় এবার বন্যা হয়েছে। এগুলোর প্রথম তিনটিতে বন্যা মধ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি রূপ লাভ করছে। শেষের বা চলতি বন্যা স্বল্পমেয়াদি হতে পারে।

এবারের বন্যাকে তুলনামূলক ও ভয়াবহ উল্লেখ করে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এবার এখন পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রে চার দফা আর মেঘনা অববাহিকায় পাঁচ দফা বন্যা হয়েছে। তিস্তায় ছোটখাটো আরও দু-একটি বন্যা হয়েছে। এবারের বন্যা তুলনামূলক দীর্ঘ এবং ভয়াবহ। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, গাইবান্ধায় ফুলছড়ি পয়েন্টে যমুনা ও পদ্মায় গোয়ালন্দ পয়েন্টে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রবাহিত হয়।

অন্যদিকে, এই বছর তিস্তায়ও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পানি প্রবাহিত হয়।

বুয়েটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে সম্প্রতি বুয়েটের ছয় গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের বন্যার ওপর একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণায় জানানো হয়, ইতোমধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এ কারণে বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় যদি প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করা যায় এবং এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে বন্যা কী পরিমাণ বাড়বে, সেটা নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন।

পরপর বন্যা লেগে থাকার সম্ভাবনা জানিয়ে গবেষণায় আরো জানানো হয়, গঙ্গা অববাহিকায় বন্যা ২৭ শতাংশ বাড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় তা বেড়ে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং মেঘনা অববাহিকায় ৩৮ শতাংশ বেশি হতে পারে। এই বেশি মানে-এবার যেমন ৪ থেকে ৭ বার হয়েছে ৩ মাসে, তখন হয়তো বন্যা লেগেই থাকবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে শুধু বন্যা নয় আর ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকার কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে আছে, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, তীব্র দাবদাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। এবার মৌসুমের আগাম আগমন ঘটে। এবারের মৌসুম অনেক বেশি সক্রিয়। এ কারণে বৃষ্টিপাত বেড়েছে। সাধারণ আরব সাগরের দিক থেকে আসা পশ্চিমা বায়ু এবং বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে ওঠা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ুর সংমিশ্রণে ভারতের পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনা ঘটে। আম্পানের পরপরই এক সপ্তাহের ব্যবধানে আরব সাগরে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড় নিসর্গ। এ দুই ঘূর্ণিঝড়ের পর যে বৃষ্টিপাত প্রবণতা শুরু হয়, সেটি এখনও চলছে।

২০০৭ সালের পর থেকেই দেশের জলবায়ু পরিবর্তন বিরূপ আকার ধারন করে। ২০১৯ সালে এক বছরেই বুলবুল এবং ফণী নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ছিল তীব্র দাবদাহ। রেকর্ড শৈত্যপ্রবাহের ঘটনাও গতবছর ঘটেছে। ২০১৮ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় তিতলি। ওই বছর আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় পূর্বাঞ্চল। ছিল বজ্রপাতের প্রকোপ এবং কালবৈশাখীর ছোবল। এছাড়া অস্বাভাবিক তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ তো ছিলই। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। সিলেট অঞ্চলে দুটি বন্যা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার কারণে উত্তরাঞ্চলে একই বছর বন্যা হয়। ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত হানে। এর আগে ‘মহাসেন’, ‘আইলা’, ‘সিডর’ হয়ে গেল। ২০০৭ সালের পর মাত্র ১০ বছরে ৫-৭টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। অথচ এর আগে ১৯৯৮ সালে এবং তার আগে ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় হয়। অপরদিকে পাহাড় ধস ঘটানোর মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বজ পাত বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের দেশ বাংলাদেশ। টর্নেডোর মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বড়টি বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা নিরসনে বৈশ্বিক সহযোগিতার বিকল্প নাই জানিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের বড় কর্তব্য হচ্ছে দুর্যোগের প্রতি বিশ্বের নজর আকৃষ্ট করার পদক্ষেপ নেয়া। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় গঠিত জাতিসংঘের অভিযোজন তহবিল থেকে অর্থ আদায়ে সোচ্চার হওয়া। খবর-যুগান্তর

  • এসএইচ

 

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]