10915

05/14/2024 রাবি ক্যাম্পাসে আতঙ্কের নাম ছাত্রলীগ

রাবি ক্যাম্পাসে আতঙ্কের নাম ছাত্রলীগ

রাজটাইমস ডেস্ক

৩০ আগস্ট ২০২২ ১৯:৪৫

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ত্রাসের অপর নাম ছাত্রলীগ। অব্যাহত তাদের বেপরোয়া আচরণে ভয়ার্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে সাধারণ শিক্ষার্খভদের মাঝে। পরিস্থিতি সামলাতে নেই কোন কার্যকর পদক্ষেপ। খবর যুগান্তরের।

প্রতিটি হলে হলে ছায়া প্রশাসন চালাচ্ছে ছাত্রলীগ। সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, ভর্তি বাণিজ্য, ছিনতাই, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে টাকা আদায়-এসবই হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল শাখা ছাত্রলীগের কতিপয় নেতার রোজনামচা। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরোক্ষ প্রশ্রয়ে হাল আমলে ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড আরও গতি পেয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, ছাত্রলীগে এ পদধারীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করে সংগঠন পরিচালনা করলেও তাদের অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক অথবা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারে না। আবাসিক হলগুলো থেকে তাদের উচ্ছেদও করতে পারছে না।

জানা যায়, গত এক বছরের কম সময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অর্ধশতাধিক ছোট-বড় অপরাধমূলক ঘটনা ঘটিয়েছে ক্যাম্পাসে। তবে এসব অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-কেউই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ভুক্তভোগীদের মধ্যে কেউ ভয়ে আপস করেছেন আবার কেউ ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন। এ কারণে রাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছাত্রলীগ আতঙ্ক বিরাজ করছে।

২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর ছাত্রত্ব নেই এমন নেতাকর্মীদের নিয়ে রাবি ছাত্রলীগের ২৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা হয় কেন্দ্র থেকে। ওই সময় কমিটির সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহম্মেদ রুনুসহ অধিকাংশরই ছাত্রত্ব ছিল না। এক বছরের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর। তবে সাড়ে চার বছরের বেশি সময় আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া রাবি ছাত্রলীগ কমিটির অধিকাংশ নেতাকর্মী এখনো হলে হলে অবস্থান করছেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি সিট বাণিজ্য আর শিক্ষার্থীদের তুলে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে টাকা আদায় করার জন্যই তারা ক্যাম্পাস ছেড়ে যায় না।

এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিই চলতি বছরের মার্চে ১৭টি হলে কমিটি গঠন করে। অভিযোগ রয়েছে, হল শাখার দায়িত্ব পাওয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অধিকাংশেরই ছাত্রত্ব নেই। তবুও তারা হলে হলে অবস্থান নিয়ে সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত রয়েছে। অধিকাংশ হলে প্রশাসন থাকলেও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাই ছায়া প্রশাসন পরিচালনা করছেন।

১৭ আগস্ট হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আল-আমিন পরীক্ষা দিয়ে বেরুনোর পরপরই তাকে অপহরণ করে মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা ও রাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত। আল আমিনকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩৩১নং কক্ষে নিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। তার এটিএম কার্ড দিয়ে ৪৫ হাজার টাকা তোলা হয়। ওইদিন আল আমিন ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। ২৫ আগস্ট কুরিয়ারে প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ পাঠান তিনি। রোববার পর্যন্ত আল আমিন ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি।

৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের হবিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ২০তলা ভবনের ঠিকাদারের কাছে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। ১১ আগস্ট হবিবুর রহমান হল সংলগ্ন সেলিমের দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ খানের বিরুদ্ধে। ১৭ আগস্ট হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজোয়ান গাজি মহারাজকে ডেকে নিয়ে লাঠি ও রড দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ ওঠে রাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মুশফিকুর রহমান প্রান্ত, মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজ আলম সাকিব, এসএম হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শামীম শিকদারসহ আরও কয়েক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।

১৯ আগস্ট অর্থনীতি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামছুল ইসলামকে মতিহার হলের ১৩২নং কক্ষে ডেকে নিয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহাসহ তার সহযোগীরা মারধর করেন। পরে গলায় ছুরি ঠেকিয়ে তার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। ২১ আগস্ট ক্যাম্পাসের খাবার হোটেল মালিক মানিক হোসেন বাবুর কাছ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠে জিয়া হল শাখার সভাপতি রাশেদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক রাকিবের বিরুদ্ধে।

১৮ ফেব্রুয়ারি মাদার বখ্শ হলের ১৫৩ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী মহিবুল্লাহর বিছানাপত্র বাইরে ফেলে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহিদ হাসান সোহাগ। পরে হলের আবাসিক শিক্ষক গিয়ে বিষয়টি সমাধান করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি জিয়াউর রহমান হলে সিট দখলে ব্যর্থ হওয়ায় হলের মূল ফটকে তালা লাগায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে শহিদ শামসুজ্জোহা হলে আবাসিক ছাত্রদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার থেকে ১২০ প্যাকেট খাবার লুট করেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি চিরন্তন চন্দ ও সাধারণ সম্পাদক মোমিন ইসলাম। ১২ এপ্রিল শেরেবাংলা হলের ১২৯ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী আকিব জাভেদকে হল থেকে বের করে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে রাতুল। দিনভর বাইরে থাকার পর হল প্রশাসন তাকে ২৪২ নম্বর কক্ষে তুলে দেন। ১৬ মে শহিদ হবিবুর রহমান হলের ৪২৬ নম্বর কক্ষে আবাসিক শিক্ষার্থী জাবের হোসেনকে হলছাড়া করতে নির্যাতন করেন ছাত্রলীগের কয়েক নেতাকর্মী। ১৮ মে ২৩৬ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী নুর আলমকে রাতভর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন ছাত্রলীগের কর্মী স্বদেশ শেখ ও তার পাঁচ সহযোগী।

২ জুন শামসুজ্জোহা হল থেকে শরিফুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। তবে পরদিন তাকে হলে তুলে দেন প্রাধ্যক্ষ। এ ঘটনায় সেদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রাধ্যক্ষকে শাসিয়ে যান। ১৪ জুন রাত সাড়ে ১১টায় লতিফ হলের ২০৪ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী সজিব কুমারের বিছানাপত্র ফেলে দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১৬ জুন সোহরাওয়ার্দী হলে এক শিক্ষার্থীকে সিটে তুলতে হল গেটে তালা দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি শামীম ওসমান। ১৮ জুন মাদার বখ্শ হলে অবস্থানরত আবাসিক শিক্ষার্থী সালমান আহমেদের বিছানাপত্র নামিয়ে দিয়ে হলটির ২২৮ নম্বর কক্ষে তালা দেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউর রহমান। ২৩ জুন নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী মুন্না ইসলামকে মারধর করে বের করে দেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

২৫ জুলাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের ভেতরে জিম্মি করে ১৬ হাজার টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে বঙ্গবন্ধু এবং জিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আলফাত সায়েম জেমস ও রাকিবুল ইসলাম, আইবিএ শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক অমিত সাহা এবং তামিমসহ আরও দুইজন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে। ২৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে আসা চারজনের একজন বায়জিদ খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তিনি রাবি শাখা ছাত্রলীগের সংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের নির্দেশে ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি দিয়েছেন স্বীকারোক্তি দেন রাবি প্রশাসনের কাছে। একই দিন রাত সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মমতাজউদ্দিন একাডেমিক ভবনের সামনে লতিফ হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন ও মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি পারভেজ হোসেনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি ও তার বন্ধুদের মারধর করেন।

ক্যাম্পাস ও হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অপকর্মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু যুগান্তরকে বলেন, হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। কোনো অভিযোগের সত্যতা থাকলে রাবি শাখা ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করতে পারে মাত্র।

রাবির হলে হলে ছাত্রলীগের ছায়া প্রশাসন পরিচালনা প্রসঙ্গে প্রক্টর প্রফেসর ড. আসাবুল হক বলেন, কোনো লিখিত অভিযোগ পেলেই সত্যতা যাচাই করতে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে থাকি। তদন্ত প্রতিবেদন সিন্ডিকেটে যাবে, এর আগেই ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তরা এসে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কিছু করার থাকে না।

মূল খবরের লিঙ্ক

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]