11014

04/24/2024 মৃতের সঙ্গে ছবি তোলা ছিল আভিজাত্যের অংশ

মৃতের সঙ্গে ছবি তোলা ছিল আভিজাত্যের অংশ

রাজটাইমস ডেস্ক

৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৫:৪৫

স্বজন হারানোর শোক কাটাতে অনেকেই অনেক কিছু করেন। আবার বিভিন্ন ধর্মানুসারে তাদের আত্মার শান্তির জন্য নানা আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনেকে প্রিয় মানুষকে মনে রাখতে তার লেখা উইলনামা, চুলের তৈরি অলংকার, শোক প্রকাশক আংটি, শোক পোশাক, মৃতের স্কেচ, মৃতদেহের প্রতিমূর্তি, চিঠি ও স্মৃতিচারক চিত্র সম্বলিত কার্ড সংরক্ষণ করতেন।

তবে শোকপালনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও মজার একটি পদ্ধতি ছিল মৃতের সঙ্গে ফটোসেশন। বিংশ শতাব্দীতে এসে এসব আপনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলেও, ভিক্টোরিয়ান যুগে এটি ছিল খুবই স্বাভাবিক চিত্র।

১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৫ বছর ইংল্যান্ড শাসন করেছেন রানি ভিক্টোরিয়া। রানির স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টের মৃত্যুর পর রানি আর কখনো রঙিন পোশাক পরেননি। শুরুতে শোক পালনের জন্যই কালো পোশাক গায়ে জড়িয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি এতোটাই শোকাহত ছিলেন যে, বাকি জীবন আর কখনো রঙিন পোশাক পরেননি।

তখনকার ব্রিটিশদের কাছে এই ঘটনাটি অত্যন্ত শোচনীয় ও একই সঙ্গে আবেগময় এক ঘটনা হিসেবে পরিচিত পায়। মানুষের মাঝে তাই প্রিয়জনের প্রতি শোক প্রকাশের মাধ্যমটাও গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করলো। তখন থেকে স্বজন বা পরিচিত কেউ মারা গেলে কালো পোশাক পরার চল শুরু হয় ব্রিটেনে।

একই সময় থেকেই মৃতের সঙ্গে ছবি তোলা বা ডেথ ফটোগ্রাফির চল শুরু হয়। রানির স্বামীর সঙ্গে তার অনেক ছবি তুলে রাখা হয়েছিল স্মৃতি ধরে রাখতে। সেই কাজটি সবার কাছেই খুব ভালো উপায় বলেই মনে হয়েছিল। ধীরে ধীরে মৃত স্বজনের সঙ্গে ছবি তুলে রাখতে শুরু করেন ইংল্যান্ডবাসী।

এর শুরুটা হয়েছিল ১৮৫০ ও ৬০ এর দশকে। সেসময় ক্যামেরায় ছবি তোলাও বেশ সস্তা ছিল। তাই ছবি তুলে রাখাও ইংল্যান্ডবাসীর ধনী শ্রেণির কাছে খুব বেশি কষ্টের কিছু ছিল না। সেসময় যেহেতু ক্যামেরাতে ছবি তুলে রাখাটা সহজলভ্য হয়ে গেলো মানুষের কাছে, তখন তারা ভাবলো প্রিয়জনদের সমাহিত করার পূর্ব মুহূর্তকার চেহারা স্মৃতিচারণ করতে ছবি তুলে রাখা প্রয়োজন।

তবে সেসময়ে ছবি তোলার সময়ে মানুষদের বেশ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, সামান্য নড়াচড়া করলেই যে ছবির ঝাপসা হয়ে যাবে। ঠিক এ কারণেই পুরনো ছবিগুলোতে দেখা যায় মানুষ চোখ-মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে কিংবা বসে আছে। তাই মৃতদেহের ছবি তোলা অনেকখানি সহজ হয়ে এলো, যে মারা গেছে সে তো আর নড়াচড়া করতে পারবে না। তাই ছবি ঝাপসা হয়ে যাওয়ারও ভয় নেই।

তবে এর অনেক আগেই শুরু হয়েছিল মৃতের ছবি তোলা। সেটি ছিল পুলিশ কেইসের জন্য। সে ছবিগুলো আদালতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। তবে সেই ছবি তোলাটাই যখন ব্রিটিশরা নিজেদের শোক প্রকাশের মাধ্যম বলে বেছে নেয়। তখন অন্যরা একটু অবাকই হয়েছিল। তবে এই সংস্কৃতি আয়ত্ত করে ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ।

বেশিরভাগ ছবির ক্ষেত্রেই মৃতদেহগুলোকে সুন্দরভাবে সাজানো হতো। যগি কোনো শিশু হতো তাহলে খেলনা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হতো তাকে। মৃতের ছবি তোলার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সাবধানের সঙ্গে করা হতো। মৃতের ফটোগ্রাফি মৃতের বাড়িতে বা মৃতের কক্ষেও করা হতো। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক মৃতদের ছবি বেশিরভাগই কফিনে শোয়ানো অবস্থায় তোলা হতো।

মৃতের ছবিতে আরও সৃজনশীলতা যোগ করতে কখনো কখনো মৃতকে চেয়ারে বসাতো। আবার অনেকে মৃতের ফটোশেসনের সময় মৃতের হাতে বই ধরিয়ে দিতো। বেশিরভাগ সময়ই মৃতের ছবি তোলার সময় ফটোগ্রাফাররা এমন কায়দা ও পদ্ধতি অবলম্বন করে ছবি তুলতেন যেনো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত মনে হয়। আবার মৃতের ছবি তোলার পর যদি তার চোখ বন্ধ থাকতো তাহলে ছবিকে জীবন্ত করতে ফটোগ্রাফাররা নতুন চোখ বসিয়ে দিতেন।

১৮৬০ এর দশকে ইংল্যান্ডে ডিপথেরিয়া, টাইফাস এবং কলেরায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়। বিশেষ করে শিশু মৃত্যু হার ছিল অনেক বেশি। ফলে বেশিরভাগ শিশুরাই কৈশোরে পৌছানোর আগে মারা যেতো। শিশুদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বাবা-মায়েরা তাদের ছবি তুলে রাখতে। অন্য সন্তানদের সঙ্গে তাকে দাঁড় করিয়ে কিংবা শুইয়ে ছবি তুলে রাখতেন।

প্রায় সব পরিবারই তাদের মৃত সদস্যের সঙ্গে ছবি তুলতেন। তাদের মনে হতো এই মানুষটার প্রতিকৃতি না থাকলে হয়তো মানুষটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। একপ্রকার নিজেদের পরিবারের মৃত সদস্যকে নিজেদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে তারা ছবি তুলতো।

প্রথমদিকে এই ধরণের ছবিগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ‘মিররস উইথ ম্যামোরিস’ নামে পরিচিত ছিল। ছবিগুলো পরিবারের বাড়ির দেয়ালে টানিয়ে রাখা থাকতো। কেউ আবার নিজেদের মানিব্যাগে রাখতেন, অনেকে নিজেদের লেকেটের ভেতর স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে রেখে পরিধান করতেন।

মানুষের যেমন শোক পালনের প্রথা শুরু হয়েহিল তেমনি সমাজের আরেকটি গোষ্ঠীও উপকৃত হয়েছিল। সেসময় ফটোগ্রাফারের সংখ্যা বেড়েছিল অনেক। রমরমিয়ে উঠেছিল এই ব্যবসা। তবে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি তা। ১৯৩০ এর দশক থেকে মৃতের ছবি তোলার প্রথা বন্ধ হতে শুরু করে। মূলত সামাজিক পরিবর্তন এই প্রথাকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে হয়। উন্নত বিশ্বে এই প্রথাকে অসুস্থ ও বর্বর প্রথা মনে করতে শুরু করেছিল। এজন্য বেশ কঠোর হাতেই এই প্রথা বন্ধ করা হয়েছিল।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]