11135

04/23/2024 কৃষকের ব্যাংক হিসাব, ১ যুগে গড় সঞ্চয় ৫৭৯ টাকা

কৃষকের ব্যাংক হিসাব, ১ যুগে গড় সঞ্চয় ৫৭৯ টাকা

রাজটাইমস ডেস্ক

২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৫৪

উদ্যোগটা নেয়া হয় প্রায় এক যুগ আগে। কৃষকদের জন্য খোলা হয় ১০ টাকায় বিশেষ ব্যাংক হিসাব। এখন পর্যন্ত দেশে এমন হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় এক কোটিতে। এসব হিসাবে কৃষকের অর্থ জমেছে খুবই সামান্য পরিমাণে। এই এক যুগে ব্যাংক হিসাবগুলোয় গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৭৯ টাকায়। খবর বণিক বার্তার।

এখনো কৃষি আর কৃষককে ধরা হয় দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে। যদিও দেশের কৃষকদের বড় অংশেরই অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর পর তাদের হাতে আর উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। জমছে না সঞ্চয়। কাটছে না আর্থিক দীনতাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন শেষে দেশের কৃষকদের ১০ টাকার বিশেষ ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৮ লাখ ২০ হাজার ৬৯৯। বিপুল এ ব্যাংক হিসাবে সঞ্চয় আছে মাত্র ৫৬৯ কোটি টাকার আমানত। সে হিসাবে দেশের কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে গড় সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫৮০ টাকারও কম। লেনদেন না থাকায় কৃষকদের ব্যাংক হিসাবের বেশির ভাগই সক্রিয় নেই। তবে ব্যাংক হিসাবের একটি অংশ সরকারি ভর্তুকি ও পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের মাধ্যমে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স গ্রহণের মাধ্যমেও সক্রিয় আছে কৃষকদের অল্প কিছু ব্যাংক হিসাব।

প্রতি বছরই কৃষি ও কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দিষ্ট অংকের ব্যাংকঋণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি কৃষকদের জন্য বিভিন্ন বিশেষ প্রণোদনা ও রেয়াতি সুদের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলও ঘোষণা করা হচ্ছে। কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় কৃষিতে বড় অংকের ভর্তুকি দিচ্ছে সরকারও। এসব নীতির সুফল কৃষকদের আর্থিক দীনতা কাটাতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে ভূমিকা রাখলেও কৃষক বরাবরই বঞ্চিত ও উপেক্ষিত থেকেছেন। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব নীতি নেয়া হয়, তার সুফল প্রান্তিক কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি ও সরবরাহ ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে প্রকৃত কৃষক বঞ্চিতই থাকছেন। প্রান্তিক কৃষক নিজেদের ক্ষুদ্র পুঁজি, শ্রম আর ঘামেই শস্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। আবার বিপণন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের কৃষক ইমদাদুল হক দুদু। আবিষ্কার করেছেন দুদুলতা নামে স্থানীয় ধানের জাত। ধান, পটল, কলা ও বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি মিলিয়ে মোট ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেন তিনি। কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে হিসাবও খুলেছেন। তবে কোনোটিই তিনি ব্যবহার করেন না। হিসাবগুলোয় কোনো টাকাও নেই। বণিক বার্তাকে এ কৃষক বলেন, ব্যাংক হিসাব দিয়ে কী করব? কোনো কাজে তো আসছে না। সংসারের ব্যয় নির্বাহেই জীবন শেষ। ব্যাংক হিসাবে টাকা থাকবে কোত্থেকে। উৎপাদিত শস্য বিক্রি করে যা পাই তা পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহের পর আর থাকে না। অনেক সময় ধারকর্জ করেও চলতে হয়।

কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চান্দলা ইউনিয়নের কৃষক মো. আবদুল হান্নানের পরিস্থিতিও ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ১৫০ শতক জমিতে বিভিন্ন ধরনের শাক, সবজি ও শস্য আবাদ করেন তিনি। জানতে চাইলে এ কৃষক বলেন, কৃষি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট আছে। প্রবাসী ছেলে সে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। আর কৃষিকেন্দ্রিক লেনদেনের মধ্যে বিএডিসির কাছে বীজ বিক্রি করেছি, যদিও টাকা এখনো পাইনি। আর সরকারের কাছে ধান বিক্রি করলে অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠায়। রেমিট্যান্স বাদ দিলে হয়তো এখন অ্যাকাউন্টে ৬০০-৭০০ টাকা থাকতে পারে। গত বোরো মৌসুমে আমার প্রায় ৪৫ শতাংশ জমির ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ৬০-৭০ মণ ধান পেতাম এ জমি থেকে। আরো অনেক কৃষকের এমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা তালিকাও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অফিস থেকে মাঝেমধ্যে সার ও বীজ সহায়তা পাই।

কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় বিশেষ ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০ সালে। বিশেষ এ ব্যাংক হিসাবের ৮০ শতাংশই খোলা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকে। কৃষকদের ব্যাংক হিসাবগুলোর বড় অংশেই কোনো লেনদেন নেই। তবে এ হিসাবগুলোর মধ্যে ২৮ লাখ ৩৭ হাজার ৭৯৭টি সরকারি ভর্তুকি প্রদানের কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ৬০ হাজার ব্যাংক হিসাবে ২০০ ও ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে ঋণ দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। ভর্তুকি ও পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার বাইরে থাকা কৃষকদের বেশির ভাগ ব্যাংক হিসাবই অকার্যকর বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, দেশের কৃষকসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ দেশের উন্নয়নের মূল স্রোতের বাইরে পড়ে আছে। এ শ্রেণীর মানুষের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। বিশেষ ভর্তুকি ও প্রণোদনার যেসব কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে দেশের ধনী-গরিবের বৈষম্য আরো বেড়েছে। ব্যাংকগুলো বড়দের ঋণ দেয়ায় ব্যস্ত। কৃষকদের জন্য ব্যাংক হিসাব চালু করার মধ্যেই ব্যাংকাররা দায়িত্ব শেষ করেছেন। কৃষির নামে প্রতি বছর যে ঋণ বিতরণ দেখানো হচ্ছে, সেটিও কৃষক পাচ্ছেন কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। দেশের কৃষক যে ভালো নেই, তাদের সঞ্চয়ের পরিসংখ্যানই সেটির সাক্ষ্য দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুন শেষে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ছিল ৪৯ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। শুধু গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলো ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। একই সময়ে কৃষকের কাছ থেকে ২৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা আদায় করেছে ব্যাংকগুলো। তবে কৃষকের মধ্যে বিতরণকৃত এ ঋণের ৭৫ শতাংশই গিয়েছে এনজিওগুলোর মাধ্যমে। ব্যাংকগুলো এনজিওকে ঋণ দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছে। ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এনজিওগুলো কৃষকের কাছে ২৫-৩০ শতাংশ সুদেও ঋণ বিতরণ করছে বলে জানা গিয়েছে।

নাটোর সদর উপজেলার আহমেদপুর গ্রামের ফলচাষী সেলিম রেজা। উচ্চশিক্ষিত এ সফলচাষীর ‘দৃষ্টান্ত এগ্রো ফার্ম অ্যান্ড নার্সারি’ নামের একটি নার্সারিও রয়েছে। সম্প্রতি কৃষিক্ষেত্রে অবদানের জন্য এআইপি সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। জানতে চাইলে এ কৃষক বলেন, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক কৃষক চাইলেই ব্যাংক থেকে ঋণ পান না। তবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে অনেক ব্যাংক আমাকে ঋণ দিতে চায়। আমার বেশির ভাগ লেনদেন হয় রূপালী ব্যাংকে। নার্সারির চারা বিক্রির টাকা অনেকে ব্যাংক হিসাবে পরিশোধ করেন। কিন্তু কৃষি খাতের কোনো ঋণ আমার নেই। বড় চাষীরা ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ঋণ পেলেও ছোট উদ্যোক্তারা পান না। করোনার সময় রেয়াতি সুদে সরকার ঘোষিত ব্যাংকঋণের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু এ ঋণ আমার পরিচিত কেউ পাননি। কোনো ভর্তুকিও কেউ পেয়েছেন বলে শুনিনি।

দেশের প্রান্তিক কৃষকের অবস্থা খুবই খারাপ বলে জানালেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান ড. মো. আখতারুজ্জামান খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মাঠে গেলে বোঝা যায় দেশের কৃষকরা কেমন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু সরকার সেখানে কোনো ভর্তুকি দেয়নি। কৃষির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কৃষকের দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। কৃষকের জন্য সরকার থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। সমস্যা হলো মাঠ পর্যায়ের কৃষক তার প্রকৃত সুফল ভোগ করতে পারেন না। কেউ কেউ কিছুটা সুফল পেলেও সেটি যৎসামান্য।

প্রান্তিক কৃষকদের বাঁচাতে কৃষি খাতে ভর্তুকি আরো অনেক বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন এ অধ্যাপক। তিনি বলেন, ছোট কৃষকরা কোনো দেশেই দীর্ঘমেয়াদে টিকতে পারছেন না। সবকিছু বড় পরিসরে চলে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র পরিসরে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। এ কারণে তারা বাণিজ্যিকীকরণে যেতে পারেন না। ছোট কৃষকরা শুধু নিজেদের চাহিদা মেটাতে চাষাবাদ করেন। ফলে তাদের সঞ্চয়ের সুযোগ থাকে না। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা ঋণ দিয়ে বলছে, ভর্তুকি দেয়া যাবে না। কিন্তু কৃষককে বাঁচাতে হলে যেভাবেই হোক, যে ফরম্যাটেই হোক ভর্তুকি দিতে হবে। ভর্তুকি ছাড়া ছোট স্কেলের কৃষকদের টেকানো যাবে না। একদিনে পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে না। ভর্তুকি দিলে প্রান্তিক চাষীদের অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নত হবে।

নিউজের লিঙ্ক

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]