11671

05/07/2025 ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ চলতি বছরে

ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ চলতি বছরে

রাজটাইমস ডেস্ক: 

২৯ অক্টোবর ২০২২ ২২:৩২

লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু। অক্টোবর শেষ হতে চললেও এর বাড়বাড়ন্ত কমার লক্ষণ নেই। রাজধানী থেকে প্রায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসজনিত রোগটি। দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়েছে চলতি বছর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে এ অক্টোবরেই। প্রায় প্রতিদিনই হাজারের কাছাকাছি রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে আক্রান্তের লিভার ও রক্তনালিতে। খবর বণিক বার্তা ।

সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়েই ভাইরাসটির বাহক এডিস মশার বিস্তার ঘটে। তবে এখন এপ্রিল-মে মাসেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যাচ্ছে। যদিও সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকে শুরুতেই এডিস মশা নির্মূল, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, রোগী ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসা সেবা দেয়ার। কিন্তু এবার সংশ্লিষ্ট বিভাগের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে ডেঙ্গুকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বলে অভিযোগ কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। শুধু তা-ই নয়, কাগজে-কলমে কাজ দেখিয়ে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে না এলে অবস্থার উন্নতি হবে না বলেও মনে করছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, দেশে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছে প্রায় ৩৫ হাজার রোগী। আর মৃত্যু হয়েছে ১২৮ জনের। এডিস মশা বাড়ায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রায় ৫৪টি জেলায়। এর প্রকোপ দেখা গিয়েছে গতকালও, একদিনেই প্রাণ হারিয়েছে মোট পাঁচজন। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ৪৪০ জন ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। সব মিলিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত রাজধানীর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে সাড়ে ২৪ হাজার ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সেবাকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছে ১১ হাজারের মতো ডেঙ্গু রোগী। মৃতদের মধ্যে ঢাকার ৭৩ জন ও অন্যান্য জেলায় ৫৫ জন। এর মধ্যে চলতি অক্টোবরেই মৃত্যু হয়েছে ৭৫ জনের এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৯ হাজার ১৭০ রোগী। এছাড়া গত সেপ্টেম্বরে দেশে ৯ হাজার ৯১১ আক্রান্ত ও প্রাণ হারায় ৩৪ জন। আগস্টে ৩ হাজার ৫২১ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৭১ জন আক্রান্তের মধ্যে নয়জন মারা গেছে। জুনে ৭৩৭ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে একজনের। জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কোনো ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু না হলেও এ পাঁচ মাসে ৩৫২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। আর সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩১ হাজারের বেশি রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

দেশে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালে। ওই বছর দেশের সবক’টি জেলায়ই আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয় লক্ষাধিক রোগী আর প্রাণ হারায় প্রায় ২০০ জন। তবে সরকারি এ তথ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা না নেয়া রোগী ও মৃতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতি ২০১৯ সালের মতো না হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া রোগীর হিসাব সঠিক নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য ২০টি সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি রাজধানীর ৩৩টি বেসরকারি হাসপাতালকে নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে আক্রান্তদের ভর্তি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ১২৩টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান থেকেই কেবল ভর্তি রোগী ও মৃত্যুর খবর হিসাব করা হয়। অথচ এর বাইরে অসংখ্য রোগী বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছে, যার কোনো তথ্যই সরকারের কাছে নেই। ফলে প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করছেন রোগতত্ত্ববিদরা।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ২০১৯ সালে ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ছড়িয়েছে ৫৮ জেলায়। আর ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পড়া মানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। কেননা জেলাগুলোতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ বা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো জনবল নেই, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগও কম। এমনকি জেলা হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের এ বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা নেই। বাসিন্দাদের মধ্যেও সচেতনতা কম। ফলে দেখা যাচ্ছে, একক জেলা হিসেবে কক্সবাজারে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তার মানে ওই জেলার ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা সফল হচ্ছে না।

কীটতত্ত্ব ও রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস বা অন্য কোনো মশাবাহিত রোগ কোথাও মহামারী আকার ধারণ করলে সেখানে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হয়। যাকে বলা হয় ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। অর্থাৎ যে বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী রয়েছে তার চারপাশে ৫০০ মিটার ধরে এমনভাবে কার্যক্রম চালাতে হবে যেন একটি এডিস মশাও বেঁচে না থাকে। আবার চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঢাকার হাসপাতালগুলো যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রাখলেও রাজধানীর বাইরের অবস্থা তেমন ভালো নয়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ রোগী ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকার বিভাগ মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আর কীটতত্ত্ববিদ ও রোগতত্ত্ববিদরা এ নিয়ে গবেষণা করেন। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

জানা যায়, প্রতি বছরই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ২০১৫ সালে তিন হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজারের মধ্যে ১৪, ২০১৭ সালে তিন হাজারের মধ্যে আট, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে ২৬, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জনের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যায়। ২০২০ সালে দেড় হাজার ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যায় ১০৫ জন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিতরা বিজ্ঞানমনস্ক নন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এডিস মশার জীবনচক্র জানতে হবে। এটা না বুঝে অযথা ফগিং করা হলে তেমন কাজ হবে না। মশা যেখানে ডিম পাড়ে সেখানে নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। তা নাহলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার তার দায়িত্বের কেবল ৫ ভাগ পালন করে। আমাদের যত শহর আছে সেখানে স্থানীয় সরকার স্বাস্থ্যসেবা দেবে বলে ‘নগর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ নামে একটা আইন আছে। এ আইনের কারণে স্বাস্থ্য বিভাগ শহরগুলোতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছে না। তাই এক্ষেত্রে এক দেশ, এক স্বাস্থ্য—এ নীতিতে এগোতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগই যেন স্বাস্থ্যসেবা দেয়। কারণ স্থানীয় সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া সম্ভব না। নগরায়ণ বাড়ছে। আগে ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করত, এখন ৬৭ ভাগ। সামনে ৫০ ভাগ হবে। আইন করে শহরের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে দিতে হবে।

ডেঙ্গু আক্রান্তদের জটিলতা নিয়ে এ চিকিৎসক বলেন, ডেঙ্গু রোগীর নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে। আর এটি নির্ভর করে ডেঙ্গুর জটিলতার ওপর। যদি ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে যায় তাহলে মাল্টি অর্গান অ্যাফেক্টেড হতে পারে। দুর্বলতা দেখা দেয়া এখানে কমন। এছাড়া কিডনি, লিভার, ব্রেনসহ অনেক ধরনের জটিলতা দেখা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য আমরা সারা দেশে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। ঢাকায় হাসপাতালে শয্যা সংকট দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। করোনার জন্য আলাদা করে প্রস্তুত হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গুর জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়েও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে নেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]