1194

09/19/2024 উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে পর্যাপ্ত সুবিধা পান না শিক্ষকরা

উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে পর্যাপ্ত সুবিধা পান না শিক্ষকরা

রাজটাইমস ডেস্ক

৫ অক্টোবর ২০২০ ১৪:০৬

আজ (০৫ অক্টোবর) বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি সরকারীভাবে পালন না করা হলেও শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে দিবসটি পালন করে থাকেন।

শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রসঙ্গ আসতেই চলে আসে উচ্চ শিক্ষার কথা। সরকারি কলেজের একজন প্রভাষক এমফিল-পিএইচডির মতো ডিগ্রি অর্জন করলে চারটি ইনক্রিমেন্ট পাবেন। এটা ২০০৮ সালের পে-স্কেলে নির্দেশনা ছিল। ওই পে-স্কেল অনুযায়ী একই ধরনের ডিগ্রির জন্য সহকারী অধ্যাপক ৩টি, সহযোগী ২টি এবং অধ্যাপকরা একটি ইনক্রিমেন্ট পেতেন। ২০১৫ সালের পে-স্কেলে এ সুবিধা তুলে দেয়া হয়েছে।

ঠিক একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশের বেসরকারি কলেজগুলোতেও। বেসরকারি কলেজে এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রেও ২০১০ সালের নীতিমালায় ইনক্রিমেন্ট দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নীতিমালায় এ বিধান তুলে দেয়া হয়েছে। এরফলে শিক্ষকরা গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। ক্লাস করানো আর পরীক্ষা নেয়ার মধ্যেই অবগাহন করছেন এসব শিক্ষক। এছাড়া মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে কম-বেশি প্রণোদনার ঘাটতি আছে।

দেশের শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশার কথাই শোনালেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিক্ষকরা কেমন আছেন সেটা বোঝার জন্য শিক্ষকের প্রণোদনা আর সুযোগ-সুবিধার দিকে তাকানোর চেয়ে সামান্য দিবসটির দিকে তাকালেই সহজে অনুমান করা যাবে। বিশ্বব্যাপী আজকে দিবসটি উদযাপন করা হলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ নিয়ে কোনো কর্মসূচি নেই। তিনি বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের এবং উন্নত আয়ের দেশে পৌঁছাতে চাই। এজন্য সময় ঘোষণা করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে এগিয়ে নিতে এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) বাস্তবায়নের জন্য বলেছে জাতিসংঘ। সেটার সঙ্গেও আমরা একমত। কিন্তু এসব লক্ষ্য অর্জনের প্রধানতম উপায় শিক্ষায় জনশক্তির উন্নয়ন। কিন্তু শিক্ষককে যদি এগিয়ে আনার কর্মসূচি না থাকে তাহলে চক-ডাস্টার নিয়ে ক্লাসে যাওয়া আর ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার একদল কর্মী পাওয়া যাবে, শিক্ষক নয়।

উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনে বর্তমানে শিক্ষকদের চেয়ে অশিক্ষকরা এই সুবিধা বেশী পান তা সুস্পষ্ট।  বিশেষ করে এ ডিগ্রির জন্য শিক্ষকদের প্রণোদনা ও আর্থিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। দিনে দিনে এ সুবিধা কেড়ে নেয়া হচ্ছে। উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এর সিংহভাগই পান সরকারি আমলারা। শিক্ষক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) পায় খুবই কম। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অধীনেও উচ্চতর শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। সেখানেও আমলাদের প্রাধান্য আছে।

শিক্ষকদের মধ্যে ইনক্রিমেন্ট সুবিধা কমিয়ে দেওয়ায় তারা উচ্চতর ডিগ্রীতে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক সভাপতি ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আইকে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। তিনি বলেন, ২০১৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষকদের মধ্যে এমফিল-পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এ ডিগ্রির বিপরীতে বর্তমানে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে এই ডিগ্রিটা নেয়া বেশি প্রয়োজন শিক্ষকদের। কিন্তু সরকারিভাবে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের যে ব্যবস্থা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আছে তাতে শিক্ষকদের সুযোগ খুবই সীমিত। অথচ যাদের শুধু সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একটি ডিপ্লোমা বা প্রফেশনাল ডিগ্রি দরকার তাদের জন্য এতে সুযোগ বেশি রাখা হয়েছে। এসব মিলে শিক্ষকদের আগ্রহে কিছুটা ভাটা দেখা যাচ্ছে। অনেকের মনও খারাপ থাকে। এ অবস্থায় জ্ঞানের প্রতি যাদের অসীম আগ্রহ আছে শুধু তারা বর্তমানে এ ডিগ্রির জন্য দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকেন।

স্বল্প যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তাতেও রয়েছে নানা বৈষম্য। প্রণোদনার ক্ষেত্রেও আছে নানা বঞ্চনা। এমফিল-ডিগ্রি তত্ত্বাবধান করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা দেয়া হয় নামেমাত্র। বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি করতে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেই। ব্যক্তি উদ্যোগে তারা এটা সংগ্রহ করে থাকেন। তবে ইউজিসি বছরে অল্প পরিমাণ অর্থ এ খাতে ব্যয় করে। কিন্তু ডিগ্রি অর্জনের পর এর জন্য বিশেষ কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। সরকারি-বেসরকারি কলেজে এর আগে রাখা ইনক্রিমেন্ট বা আর্থিক সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। হাইস্কুল এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়েও এ ধরনের ডিগ্রির জন্য কোনো সুবিধা দেয়ার বিধান নেই। তবে বেসরকারি হাইস্কুলে বিএড ডিগ্রিসহ যোগদান করলে বেতন স্কেলে এক ধাপ এগিয়ে দেয়া হয়। এ ধরনের শিক্ষকরা ১০ম গ্রেডে বেতন পান। না থাকলে ১১তম গ্রেডে যোগদান করতে হয়। আর যোগদানের ৫ বছরের মধ্যে বিএড করলে একটি গ্রেড এগিয়ে বেতন দেয়া হয়। কিন্তু এমএড ডিগ্রির জন্য কোনো সুবিধা দেয়া হয় না। ফলে এই ডিগ্রি করার ব্যাপারে আর কেউ আগ্রহী হন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেড় বছর মেয়াদি ডিপিএড (ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন) প্রশিক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। তবে এই ডিগ্রি না করলে এর আগে জাতীয় বেতন স্কেলের ১৫তম গ্রেডে বেতন পেতেন। আর ডিপিএড অর্জন করলে বেতন হতো চতুর্দশ গ্রেডে। সম্প্রতি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণবিহীন সব সহকারী শিক্ষকের বেতন ত্রয়োদশ গ্রেডে উন্নীত করা হয়। এতে প্রশিক্ষণ অবমূল্যায়িত হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

যেসব শিক্ষক এমপিল-পিএইচডি ডিগ্রী নিতেন তারা বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ নিয়োগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালায় ‘অভিজ্ঞতা শিথিল’র বিশেষ সুবিধা পেতেন। ২০১৯ সালের নীতিমালায় সেটি তুলে দেয়া হয়েছে। তবে পদোন্নতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি এমফিলের জন্য ১ বছর এবং পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ২ বছরের ‘শর্ত শিথিল’র সুবিধা দেয়ার কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু সরকারের এমপিও নীতিমালায় এটি উল্লেখ নেই। ফলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সুবিধাটি পাচ্ছেন না। শুধু বেসরকারি কলেজ ভেদে যদি অভ্যন্তরীণ নীতিমালা থাকে তাহলে নিয়োগে এটি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আর ছোটখাটো ও মফস্বলের যেসব স্নাতক কলেজে এ নীতিমালা নেই সেখানে অনুসৃত হচ্ছে না। ফলে এ ক্ষেত্রেও উপেক্ষিত হচ্ছে উচ্চতর শিক্ষা।

গবেষণা ছাড়া শিক্ষকতার মূল্য কমে যাওয়ার ও গবেষণায় শিক্ষকদের নিবিষ্ট করতে সরকারি উদ্যোগের বিকল্প নেই বলে জানান অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে শিক্ষকদের প্রধান কাজ দুটি- গবেষণা ও শিক্ষকতা। শুধু শিক্ষকতায় নিয়োজিত রাখতে চাইলে ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ এবং ২০৩০ অর্জন করা সম্ভব হবে না। এসব অর্জন করতে হলে সরকারকে অবশ্যই শিক্ষকদের জন্য কয়েকটি কাজ করতে হবে। তা হচ্ছে, এমফিল-পিএইচডিসহ উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য সমন্বিত নীতিমালা করা; শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণা বাধ্যতামূলক করা; গবেষণার জন্য প্রণোদনা, বৃত্তি ও আর্থিক সুবিধা পুনর্বহালের পাশাপাশি নতুন সুবিধা দেয়া; বিদ্যমান বিভিন্ন ফেলোশিপে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বাড়ানো; স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রির পথউন্মুক্ত ও প্রশস্ত করা।

উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে যাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাটাই যুক্তিসঙ্গত তাদের জন্যই তা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আমি বলছি না যে সরকারি কর্মকর্তাদের উচ্চতর ডিগ্রির পথ বন্ধ করা হোক। সরকারকে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। যার যেই ডিগ্রির প্রয়োজন নেই, শুধু ডিপ্লোমা হলেই চলে- তাকে সেটা দিতে হবে। নইলে অর্থের অপচয় হবে। এটা বন্ধ করা সরকারের দায়িত্ব।

  • এসএইচ

 

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]