12338

04/27/2024 প্রবৃদ্ধির পথে দেশের এভিয়েশন খাত

প্রবৃদ্ধির পথে দেশের এভিয়েশন খাত

রাজটাইমস ডেস্ক

৩০ নভেম্বর ২০২২ ২১:১২

দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলেও চাঙা ভাব দেখা যাচ্ছে দেশের এভিয়েশন খাতে। মধ্যপ্রাচ্য রুটেই করোনা পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৮ শতাংশ। খবর বণিক বার্তার।

চলতি সপ্তাহেও ২৬ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাতদিনে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাবে ২৮৫ ফ্লাইট।

কভিড-পরবর্তী বিধিনিষেধ ও উড়োজাহাজ চলাচলে নিয়মনীতি শিথিল হওয়ার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে এখন ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মহামারীর প্রাদুর্ভাব কমে আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোয় এখন শ্রমিকের চাহিদাও বেশি। এছাড়া ওমরাহ করতে যাওয়া যাত্রীও বেড়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোয় যাতায়াতের অন্যতম গেটওয়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এরই ধারাবাহিকতায় মধ্যপ্রাচ্য রুটে ফ্লাইটের সংখ্যায় বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে।

সিভিল এভিয়েশন ও অফিশিয়াল এয়ারলাইনস গাইডস (ওএজি) ডাটাবেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় মধ্যপ্রাচ্য রুটে চলাচলকারী ফ্লাইটের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ-মধ্যপ্রাচ্য রুটে চলাচল করছে ২৮৫ ফ্লাইট। এর মধ্যে ঢাকা-দুবাই রুটে চলাচল করছে ৪৮টি। দোহা, জেদ্দা, দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়া, এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই, ইউএস-বাংলাসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন এয়ারলাইনস সংস্থা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বিরতিহীন ফ্লাইট পরিচালনায় শীর্ষ ১০ এয়ারলাইনসের মধ্যে দুটি সংস্থার সর্বোচ্চসংখ্যক ফ্লাইট চলাচল করছে ঢাকা রুটে। এয়ার অ্যারাবিয়ার ২৪০ ফ্লাইটের ২৭টি চলাচল করছে শারজাহ-ঢাকা রুটে। সাউদিয়ার দক্ষিণ এশিয়ায় মোট ফ্লাইটের সংখ্যা ১২৭। এর মধ্যে ২৩টি চলছে জেদ্দা-ঢাকা রুটে।

মূলত প্রবাসী শ্রমিকদের চলাচলকেই মধ্যপ্রাচ্য রুটে উড়োজাহাজের ট্রাফিক বাড়ার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (এটিএবি) সভাপতি এসএন মনজুর মুরশেদ (মাহবুব) বণিক বার্তাকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইটগুলোয় চলাচল বাড়ার কারণ হচ্ছে বাংলাদেশী যাত্রীদের ৬০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক। আবার প্রবাসে থাকা মোট বাংলাদেশীর ৭০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। তাদের আসা-যাওয়া বেশি হলে ফ্লাইটও বাড়ে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে যাওয়ার ক্ষেত্রেও মধ্যপ্রাচ্য হয়ে যেতে হয় বাংলাদেশীদের। সব মিলিয়েই মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইট বাংলাদেশ থেকে বেশি। মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রীদের যাতায়াত চাহিদা বাড়লেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এ সুবিধা নিতে পারছে না। এর কারণ হলো বিমানের ব্যবসার নীতির সঙ্গে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক চর্চার মানদণ্ডের মধ্যে এখনো পার্থক্য রয়ে গিয়েছে।

একই পর্যবেক্ষণ দেশের এভিয়েশন খাতসংশ্লিষ্টদেরও। তাদের ভাষ্যমতেও বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইটের চাহিদা ও সংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ প্রবাসী শ্রমিকরা। মধ্যপ্রাচ্যের কভিড-পরবর্তী শ্রম চাহিদা পূরণ করতেই বিপুলসংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় আসা-যাওয়া করছেন। বিশেষ করে সৌদি আরব, ওমান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) এখন শ্রমিকের চাহিদা বেশি। দেশগুলোয় এখন প্রচুর অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। এর প্রেক্ষাপটেই প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে। ফলে ফ্লাইটও বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এয়ারলাইনসগুলো এখন ফ্লাইট বাড়াচ্ছে। এমনকি ভারতের এয়ারলাইনসগুলোও বাংলাদেশ থেকে যাত্রী নিয়ে মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রী পরিবহন করছে।

বিমান বাংলাদেশের এমডি ও সিইও দপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন সংস্থার উপমহাব্যবস্থাপক মো. আনোয়ারুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শ্রমবাজারগুলোয় কাজের সুযোগ বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাত্রী গমন বেড়েছে। পাশাপাশি ওমরাহ ও হজের জন্যও যাত্রী বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে উড়োজাহাজ চলাচল উন্মুক্ত হওয়ার কারণেই ফ্লাইট বেড়েছে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ৯ লাখ ৪৮ হাজার শ্রমিক। তাদের প্রায় সাড়ে ৫ লাখ বা ৬০ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও বিপুলসংখ্যক শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। সে অনুযায়ী প্রধান এসব শ্রমবাজার থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে একেবারেই বিপরীত চিত্র।

তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ২১ শতাংশ। ১৫ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে। কুয়েত থেকে আহরণ কমেছে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এছাড়া ওমান থেকে ৪১ দশমিক ৫৬ ও কাতার থেকে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ হারে রেমিট্যান্স আহরণ কমেছে।

চলতি অর্থবছরেও এ ধারা বজায় রয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সৌদি আরব থেকে আসা রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ইউএই থেকে অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৭ কোটি ৬ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ কোটি ৮৪ লাখ ডলার। এর আগে জুলাই-আগস্টেও দেশটি থেকে প্রতি মাসে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি ডলারের ঘরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, নতুন করে অভিবাসী হওয়া বাংলাদেশীদের উপার্জিত অর্থ যাচ্ছে কোথায়, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। জ্বালানি তেলসহ চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সুবিধাভোগী হলো সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও এসব দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শ্রমবাজারগুলোয় বাংলাদেশীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছেন। নতুন করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী এসব দেশে অভিবাসীও হয়েছেন। এর পরও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া রহস্যজনক।

শুধু শ্রমিক নয়, মধ্যপ্রাচ্যমুখী ফ্লাইটগুলোয় এখন অভিজাত-ধনীদেরও যাতায়াত বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যমুখী বাংলাদেশী ধনীদের জন্য সম্প্রতি উচ্চমূল্যের ‘প্রথম শ্রেণী’র আসন চালু করেছে তিন এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে দুবাইভিত্তিক এমিরেটস দিনে দুটি ফ্লাইটে প্রথম শ্রেণীর সেবা দিচ্ছে। আর প্রতিদিন একটি ফ্লাইটে প্রথম শ্রেণীর সেবা দিচ্ছে কুয়েত এয়ারলাইনস। বাংলাদেশীদের জন্য প্রথম শ্রেণীর চেয়েও বিলাসবহুল ‘কিউ সুইট’ সেবা চালু করেছে কাতার এয়ারওয়েজ। অভিজাত এ বিমান চলাচল সংস্থাটির কিউ সুইটেও কোনো আসন ফাঁকা থাকছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এটিএবির মহাসচিব আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবে আমাদের শ্রমিক যাতায়াতটা বেশি। দেশটিতে যখন ভিসার সংখ্যা বেশি থাকে তখন ফ্লাইটও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে জেদ্দা ও মদিনা পয়েন্টে ওমরাহ। মধ্যপ্রাচ্যমুখী যাত্রীদের ৭০ শতাংশই যাচ্ছে সৌদি আরব। গত চার-পাঁচ মাসে সেখানে ওমরাহ করতে গিয়েছে আনুমানিক ৫০ হাজারের মতো মানুষ। সৌদি সরকার যেভাবে ওমরাহ উন্মুক্ত করেছে তাতে সংখ্যাটা আরো বাড়বে।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমের মতে, শুধু যে শ্রমিক চলাচল বেড়েছে তা নয়। বাংলাদেশীদের ওমরাহ ও হজযাত্রাও অনেক বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যমুখী ফ্লাইটের বেশির ভাগই যাচ্ছে জেদ্দা-মদিনায়। এমিরেটস, কাতার, কুয়েত এয়ারওয়েজ, গালফ এয়ার—সব এয়ারলাইনসই ওমরাহ যাত্রী বহন করছে। প্রতিদিনই বেশি পরিমাণে যাত্রী যাচ্ছে। ভিসা প্রক্রিয়াও সহজ হয়েছে। সব মিলিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট বেড়েছে। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোয় শিক্ষার্থীরাসহ যে যাত্রীরা যাচ্ছেন তারা সবাই ট্রানজিট পাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন অনেকে। যেহেতু আমাদের দেশ থেকে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর গেটওয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সে কারণেও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট চলাচল অনেক বেড়েছে।

বিদেশী এয়ারলাইনসগুলো এর সুবিধা নিলেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস তা কাজে লাগাতে পারছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগের তুলনায় বিমানও ভালো করছে। কিন্তু বিমানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও রুট প্ল্যানিং ভালো না। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের এয়ারলাইনসগুলো ঢাকা থেকে দুবাই নিয়ে, দুবাই থেকে অন্যান্য গন্তব্যে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বিমান শুধু পয়েন্ট টু পয়েন্ট করছে যেমন ঢাকা-দুবাই-ঢাকা বা ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা। বাণিজ্যিক এয়ারলাইনসের ব্যবসায় পয়েন্ট টু পয়েন্ট যাত্রী বহন করে লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। বাণিজ্যিক ও পেশাদারির ভাবনা বিমানে এখনো তৈরি হয়নি। সব মিলিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে ফ্লাইট বেশি হওয়ায় যে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা, তা বিমান বাংলাদেশ ধরতে পারছে না।

টিবিএসের প্রতিবেদনটির লিঙ্ক

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]