15883

05/09/2025 নির্বাচনকালীন গণমাধ্যম: আশঙ্কা ও ভিসা নীতি

নির্বাচনকালীন গণমাধ্যম: আশঙ্কা ও ভিসা নীতি

রাজ টাইমস ডেস্ক :

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২২:২৫

নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা দূর অতীতে কদাচিৎ প্রত্যাশিত মানের হলেও নিকট অতীত কার্যত হতাশা জাগানিয়া৷ বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে পরিবর্তন আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি৷ তবে বিরুদ্ধমতও রয়েছে৷

তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, সরকারি বিজ্ঞাপন পায় এরকম জাতীয় এবং আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা এখন ৫৭৬টি৷ সারা দেশে এমন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে ১২৯টি৷ টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারে আছে ৩৯টি৷ আর তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল মোট ১৮২টি৷

১৭ কোটি মানুষের এই দেশে বাজার বিবেচনায় গণমাধ্যমের এই আকারকে অনেকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মনে করেন৷ তারপরও নির্বাচনের আগে আরও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে বলে জানা গেছে৷ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আবেদনও প্রক্রিয়াধীন আছে৷

নির্বাচনের আগে তারা অনুমোদন পাবে কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত নয়৷ এছাড়া অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়৷

কিন্তু গণমাধ্যম অনেক বিস্তার লাভ করলেও তারা গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কতটা ভূমিকা রাখছে?

মোটা দাগে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়৷ তখন অবশ্য গণমাধ্যম এত বিস্তৃত ছিল না৷ অনলাইন তখনো আসেনি৷ আর টেলিভিশন বলতে একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি)৷ সরকারের পক্ষে একপেশে প্রচারের কারণে তখন অবশ্য বিটিভিকে সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স বলা হতো৷

এখনো তার ‘চরিত্রে' বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ ওয়ান ইলেভেনের সময় সংবাদমাধ্যম যেমন বিরাজনীতিকরণের ভূমিকায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়ে কাজ করেছে, আবার গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য ভূমিকা রাখা গণমাধ্যমও ছিল অনেক৷ এরপর থেকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তনের কথা বলেন বিশ্লেষকরা৷

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘এরশাদের পতনের আগে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো চারদিন বন্ধ ছিল৷ এটা এরশাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে৷ জিয়াউর রহমানের সময় সাংবাদিক সম্পাদকরা গ্রেপ্তার হলেও তারা সত্য প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু এখন গণমাধ্যমের প্যাটার্ন পরিবর্তন হয়ে গেছে৷’

তার কথা, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে৷’

বিশ্লেষকরা বলছেন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা সুষ্ঠু ও অংশহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে দৃশ্যত তেমন কার্যকর ছিল না৷ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অনেকটা বিটিভির মতো সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷ স্বাধীন সাংবাদিকতা সার্বিকভাবে চাপের মুখে আছে৷ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ মনে করেন, ‘গত এক যুগ ধরে গণমাধ্যম চাপে আছে৷ সরকারে দিক থেকে বাধা আছে, আবার মালিক পক্ষের দিক থেকেও বাধা আছে৷

মালিকরা তো পার্টিজান হয়ে গেছে৷ এখন সামনের ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচনের জন্য মিডিয়ার যে ভূমিকা রাখা দরকার, তারা তা পারবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে৷ ড. ইউনূসের বিপক্ষে যখন ৫০ জন সম্পাদক বিবৃতি দেয়, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি কেমন৷’

তার কথা, ‘মুক্ত সাংবাদিকতায় বাধা এরশাদের বা তার আগেও ছিল৷ কিন্তু তখন গণমাধ্যমের মুক্ত সাংবাদিকতার চেষ্টা ছিল৷ এখন চেষ্টাও নেই৷ এর সঙ্গে নানা আইন তো আছেই৷ সম্পাদকরা এখন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন৷’

তবে মার্কিন ভিসা নীতির কারণে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন৷

বাংলাদেশে গণমাধ্যম সংখ্যায় এবং আকারে বড় হলেও তাদের প্রো-পিপল ভূমিকা কমে গেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক খান৷ বেসরকারি টেলিভিশনগুলো সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে৷

আর দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদে পত্রিকাগুলোও একই ভূমিকা রাখছে বলে তিনি মনে করেন৷ তার কথা, ‘সাংবাদিকরাও এখন আর ভালো প্রতিবেদন না করে কেউ কেউ যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থ আয়কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন৷ বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের বিলাসী জীবন দেখলেই বোঝা যায় সাংবাদিকতা কোন দিকে গেছে৷’

তিনি বলেন, ‘জিয়া থেকে এরশাদের সময় সাংবাদিকরা চেষ্টা করেছেন বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে৷ কিন্তু এখন আর সেরকম হয় না৷ গত দুইটি নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবল নয়৷ সামনের নির্বাচনেও এর পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না৷’

‘মার্কিন ভিসা নীতিও গণমাধ্যমকে বদলাতে পারবে না৷ কারণ, যারা গণমাধ্যমকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছেন, তারা অ্যামেরিকায় যাবেন না৷ তাদের সেই প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না,’ বলেন এই অধ্যাপক৷

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মাগুরার উপ-নির্বাচন, এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের আন্দোলন৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং ২০০৬ রাষ্ট্রপতি সালে ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷

এই বিষয়গুলো নিয়ে বেসরকারি গণমাধ্যম সঠিক ভূমিকাই রেখেছিল৷ কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা সেরকম নয়৷

অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক খান মনে করেন, ‘কর্পোরেট মিডিয়ার এখন নানা স্বার্থ৷ আর সেটা সরকারের সঙ্গে যুক্ত৷ ফলে গণমাধ্যম এখন আর আগের ভূমিকায় নেই৷ সামনেও এর পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না৷’

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখন রাজনৈতিকভাবেও বিভক্ত৷ তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, নেতা৷ শ্যামল দত্ত বলেন, ‘রাজনৈতিক আদর্শ গণমাধ্যমের থাকতে পারে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আছে৷ সেখানেও গণমাধ্যম এখন কর্পোরেটদের দখলে৷ কিন্তু তারপরও সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়৷’

শওকত মাহমুদ বলেন, ‘রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা এক জিনিস আর বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ খবর পরিবেশন আরেক জিনিস৷ এটা আমরা আগে ফলো করেছি৷ রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার জায়গায় সাংবাদিকতা রেখেছি৷ কিন্তু এখন একাকার হয়ে গেছে৷’

বাংলাদেশে একসময় দলীয় সংবাদপত্র ছিল৷ বাংলার বাণী ও দিনকাল তার বড় উদাহরণ৷ কিন্তু এখন সেই অর্থে সরাসরি দলীয় মালিকানায় সংবাদমাধ্যম নেই৷ তারপরও কেন এই অবস্থা? আর্টিক্যাল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক প্রধান ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘এখন ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ নিজেদের লোকদের সংবাদমাধ্যম, পত্রিকা, টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া হয়৷

প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য আলাদা ব্যবসাও দেয়া হয়৷ দলের মালিকানায় সংবাদমাধ্যম থাকার চেয়ে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এই সময়ে৷ এর বাইরেও আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের ভাগ বাটোয়ারার বিষয়৷ আছে নানা কৌশলে চাপ৷’

ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘এরসঙ্গে এখন সম্পাদকরা সুবিধা নেওয়ার চিন্তায় থাকেন৷ জিয়া এরশাদের আমলে এরকম সুবিধাদি অনেক কম ছিল৷ ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে চেষ্টা ছিল স্বাধীন সাংবাকিতার৷ এখন সেটাও নেই৷’

‘আমি সামনে ভালো কিছু দেখছি না৷ নির্বাচন নিয়ে আমার সংশয় আছে৷ মার্কিন ভিসা নীতিতে সাংবাদিকদের কেউ কেউ ভয় পেতে পারেন৷ কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যম তেমন কাজ করবে বলে মনে হয় না৷’

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]