04/22/2025 ছয় প্রতিষ্ঠান গিলছে তুরাগ, চলছে দখলের মহোৎসব!
রাজটাইমস ডেস্ক:
১৫ জানুয়ারী ২০২৪ ১০:৪২
রাজধানীর দিয়াবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়ে আশুলিয়া পর্যন্ত গেছে বেড়িবাঁধ সড়ক। এই সড়কের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে তুরাগ। বই-পুস্তক কিংবা মানুষের মুখে এখনো এটি একটি ‘নদ’। কিন্তু বাস্তবে অনেক আগেই খালে রূপ নিয়েছে তুরাগ। বেড়িবাঁধ ধরে হেঁটে চললে চোখে পড়ার কথা নদের নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিন্তু এখন সারি সারি শিল্পকারখানা ছাড়া চোখে পড়ে না আর কিছুই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নদ দখল করে, কোথাও আবার আংশিক দখল করে গড়ে উঠেছে এসব প্রতিষ্ঠান। বালু ফেলে ভরাট করা হচ্ছে দেদার। খবর দৈনিক কালবেলা।
প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই মেতেছে দখল উৎসবে। ফলে রং হারিয়েছে নদ। স্থানীয়রা বলছেন, এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এক সময়ের প্রমত্তা নদটি হয়তো কালের বিবর্তনে কেবলই ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ঢাকা নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা চারটি নদীর অন্যতম তুরাগ। সরকারি তথ্যমতে, এই নদের দৈর্ঘ্য ৬২ কিলোমিটার। গভীরতা ১৩.৫ মিটার। নথিপত্রে তুরাগের প্রস্থ ৮২ মিটার হলেও বাস্তবে কোথাও কোথাও তা ২০-২৫ মিটারে নেমে এসেছে।
তুরাগ তীরের দিয়াবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে রুস্তমপুর বোট ঘাট পর্যন্ত দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। এর মধ্যেই রয়েছে অন্তত ছয়টি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের রেডিমিক্স কারখানা। সবকটি কারখানাই গড়ে তোলা হয়েছে তুরাগ নদের জায়গা দখল করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পুরোটাই নদের একেবারে ভেতরে। কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের মালপত্র লোড-আনলোডের সময় বর্জ্য পড়ছে নদে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিয়মিত বালু ফেলে ভরাট করে ধীরে ধীরে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে এসব কারখানা। এর ফলে কমে যাচ্ছে নদের প্রস্থ। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা বিআইডব্লিউটিএর অনুমতি নিয়েই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানী এবং এর আশপাশের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কংক্রিটের মিশ্রণ তৈরি করা হয় এসব কারখানায়। এসব কংক্রিট মিক্স করার সময় পানি তোলা হয় তুরাগ থেকে। এখানে মেশিনের সাহায্যে খোয়া, বালু আর সিমেন্ট মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর সেগুলো গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় নির্ধারিত স্থানে।
তুরাগে বংশ পরম্পরায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছে সুবল চৈতন্যের পরিবার। সুবলও এক সময় মাছ ধরতেন। কিন্তু দিন বদলেছে, নদে মাছ নেই। তাই বেছে নিয়েছেন রাজমিস্ত্রির কাজ।
তিনি বলেন, ‘জীবনটা কাটাইলাম এই নদে মাছ ধইরা। ২০-২৫ বছর আগেও নৌকা বোঝাই করে মাছ নিয়ে হাটে যাইতাম। ওই আমলে এক দিনে ৩০-৪০ হাজার টাকার মাছও ধরেছি। আট-দশজনে একলগে গাঙে যাইতাম। উৎসব উৎসব ভাব থাকত। নদ থেকে মাছ ধরেই নদেই রাইন্ধা খাওয়া। আর এখন সেই পানিতে হাত দিতেও ভয় করে। গন্ধে নাক বন্ধ রাখি। চোখের সামনে নদডারে খাইয়া ফেলল!’
বেড়িবাঁধ সড়ক ধরে আশুলিয়ার দিকে এগোলে ইস্টার্ন হাউজিং। এর থেকে কয়েকশ গজ সামনে ‘মাইশা কনস্ট্রাকশন’র একটি রেডিমিক্স কারখানা। বিশাল আয়তনের এই প্রতিষ্ঠানটি তুরাগ নদের সীমানা পিলারের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে। গুগল ম্যাপেও এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব তুরাগ নদের ভেতরে।
সরেজমিন দেখা যায়, মাইশা কনস্ট্রাকশনের ভেতরে একাধিক সীমানা পিলার রয়েছে। কিছু পিলার বালুতে ঢাকা পড়া। গড়িয়ে গড়িয়ে নদে পড়ছে বালু-পাথর-খোয়া। যদিও টেলিফোন আলাপে মাইশা কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম দাবি করেন, ওই জায়গার মালিক তাদের প্রতিষ্ঠান। এ সময় তার হাত থেকে ফোন নিয়ে মাইশা কনস্ট্রাকশনের এমডি পরিচয় দিয়ে একজন বলেন, ‘আমরা বিআইডব্লিউটিএর থেকে অনুমিত নিয়ে কারখানা চালাচ্ছি। আমাদের পরিবেশেরও ছাড়পত্র আছে।’
তিনি আরও দাবি করেন, ‘নদের ভেতরেও তার আরও ৩০ ফুট ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গা রয়েছে।’
নদ ভরাটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা নদ ভরাট করছি না। এটি আগে থেকেই এরকম ছিল।’
মাইশা কনস্ট্রাকশনের পাশেই করিম গ্রুপের রেডিমিক্স কারখানা। এটি তুরাগ নদের সীমানা পিলার ছেড়ে একেবারে ভেতরে ঢোকানো। নদের পাড় ধরে করিম রেডিমিক্সে গিয়ে দেখা যায়, বালু-পাথর ফেলে ঢেকে ফেলা হয়েছে অনেক জায়গায় সীমানা পিলার। কোথাও কোথাও এ কারখানা ৪০-৫০ ফুটের মতো নদের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর ধারাবাহিকভাবে মাটি-বালু পড়তে থাকায় ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে তুরাগ নদ।
এ নিয়ে কথা বলার জন্য গত দুদিনে একাধিক করিম রেডিমিক্সের টিঅ্যান্ডটি নম্বরে ফোন করা হলেও অভ্যর্থনা ডেস্ক থেকে কর্তৃপক্ষের কাউকে দেওয়া হয়নি।
করিম রেডিমিক্স থেকে আর একটু সামনে এগিয়ে গেলে দেখা মেলে একটি কারখানার ভেতরের বিশাল কমর্যজ্ঞ। লম্বা লম্বা মিক্সার মেশিন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে গেটের নিরাপত্তারক্ষী জানান, এটি ‘দ্য স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড (এসইএল)’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের রেডিমিক্স কারখানা। ভেতরে ঢুকতে চাইলে অনুমতি মেলেনি। এরপর নদের পাড় ধরে এই রেডিমিক্সের কারখানার কাছে গিয়ে দেখা যায়, এটিও তুরাগ নদের অনেকটা ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে। এই রেডিমিক্সের ভেতরেও তুরাগ নদের অনেক সীমানা পিলার দেখা যায়। দুই-তৃতীয়াংশ জায়গাই নদের।
মেইন রোড থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দিয়ে নেওয়া হয়েছে সরু রাস্তা। এরপর অনেকটা তুরাগ নদের ভেতরে তৈরি করা হয়েছে এই রেডিমিক্সের কারখানা। এই কারখানার কারণে তুরাগ নদের প্রস্থ কমে ২০-২৫ মিটারে চলে এসেছে।
এসইএলের ম্যানেজার বজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা নদের জায়গা দখল করিনি। আমরা আমাদের মালিকানাধীন জায়গায় প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছি। এই জায়গা আমাদের নিজেদের।’
আদালত তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন জানিয়ে বজলুর রহমান আরও বলেন, ‘নদ আরও দেড়শ ফুট দূরে।’
নদের জায়গা কীভাবে তাদের হলো—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘আপনার কাছে বলতে হবে কেন? আপনি কে? দেশে আইন আছে, তারা দেখবে। আপনি কাভারেজ করেন। আপনাদের কি আর কিছু কাভারেজ করার নেই। করেন ওটা, এ ব্যাপারে আমি কথা বলব না।’
এসইএলের পরই পথ বিল্ডার্স নামের আরও একটি প্রতিষ্ঠানের রেডিমিক্স কারখানা। এই কারখানাটি প্রায় পুরোপুরিই তুরাগ নদের ভেতরে গড়ে তোলা হয়েছে। বেড়িবাঁধের সড়ক ধরে আরেকটু এগোলে বিরুলীয়া ব্রিজ। এরপরই রয়েছে ‘বোট ক্লাব’। বোট ক্লাব পার হয়ে সামনে গেলে রুস্তমপুর বোট ঘাটে ‘ক্রাউন সিমেন্ট’ কোম্পানির আরও একটি রেডিমিক্স কারখানা। এই কারখানাটিও গড়ে তোলা হয়েছে তুরাগের অনেকটা জায়গা দখল করে। বোট ঘাট হয়ে এই কারখানার পেছনের অংশে প্রবেশ করতেই দেখা যায় কারখানার ভেতরে একাধিক সীমানা পিলার। মিক্সার মেশিন বসানো হয়েছে নদের সীমানা পিলারের ভেতরে। যদিও নিরাপত্তারক্ষীর বাধার কারণে বেশি ভেতরে প্রবেশ করা যায়নি।
এই কারখানার বাইরে ৭ থেকে ৮টি বাল্কহেড ভিড়িয়ে রাখতে দেখা গেছে। এসব কারখানা থেকে শ্রমিকদের মাথায় করে বালু ও খোয়া নামাতে দেখা যায়। নদের পাড় দিয়ে পেছনে গিয়ে দেখা যায়, এই কারখানা থেকে বর্জ্য গড়িয়ে গড়িয়ে নদে পড়ছে। এ ছাড়া ময়লার স্তূপ দেখা যায় নদের পাড়ে।
বিস্তারিত জানতে ক্রাউন সিমেন্টের নম্বরে ফোন দিলে মকবুল হোসেন নামের একজন রিসিভ করেন। ক্রাউন সিমেন্টের ঊর্ধ্বতন কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কারণ জানতে চান। বিস্তারিত বলা হলে তিনি বলেন, ‘আপনি ভালো করে গিয়ে দেখেন নদের ভেতরে আমাদের কারখানা না।’
কারখানার ভেতরে বিআইডব্লিউটিএর পিলার রয়েছে—এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন।
সরেজমিন তুরাগ তীর ঘুরে দেখা গেছে, এই পাঁচটি ছাড়াও আরো একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নদী দখল করে মিক্সার কারখানা গড়ে তুলেছে। শুধু এসব বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানই নয়, বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা ছোট নানা প্রতিষ্ঠান নদের জায়গা দখলে নিয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে বিপুলসংখ্যক ইটভাটা ও ছোট ছোট কারখানা।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ‘আপনারা যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম বলছেন, সেগুলো আগে থেকেই ছিল। আমরা এরপর এসব প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই সীমানা পিলার দিয়েছি। কিছু প্রতিষ্ঠান নদের পাড় ব্যবহারের জন্য সরকারকে ভাড়া দেয়। তবে ওখানে নদ ভরাট হয়েছে বলে বিষয়টি আমাদের নলেজে নেই। এখন কেউ নদ ভরাট করার চেষ্টা করলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করি উৎখাত করার জন্য। সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে এ বিষয়ে। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।’
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান কামরুন নাহার আহমেদ বলেন, ‘বেড়িবাঁধের তুরাগ নদের পাড়ে তো আমরা কয়েকবার গিয়েছি। মাইশা কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা চলছে। বাকিদের বিষয়েও আমরা দেখব। আমাদের যে টিম আছে, তাদের পাঠাব।