04/22/2025 গাজায় গণহত্যা : জাতিসঙ্ঘের আদালতের রায় মানতে কতটুকু বাধ্য ইসরাইল
রাজ টাইমস ডেস্ক :
২৭ জানুয়ারী ২০২৪ ১৯:৪৪
জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ আদালত গাজায় গণহত্যা বন্ধে ইসরাইলকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেছে, যদিও তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে বলেনি।
এরআগে, গত ২৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে মামলা করেছিল। ইসরাইল অভিযোগটি ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দেয়।
নেদারল্যান্ডসের হেগে শুক্রবারের শুনানিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিজের (আইসিজে) বিচারক এই মামলায় প্রথমবারের মতো কোনো নির্দেশ জারি করলো। কিন্তু মূল যে অভিযোগ- ‘গণহত্যা’, সেটির রায় আসতে দীর্ঘসময় এমনকি কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে।
যদিও আদালত ইসরাইলকে দক্ষিণ আফ্রিকার দাবি অনুযায়ী গাজায় সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে বলেনি, তারপরও আদালতের এই আদেশ যারা এ মামলার পক্ষে ছিল তাদের জন্য বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক, ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।’
আর ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেন, এই রায় প্রমাণ করে ‘কোনো রাষ্ট্রই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
কিন্তু এটিকে দক্ষিণ আফ্রিকা বা ফিলিস্তিনিদের জন্য সম্পূর্ণ বিজয় বলা যায় না। কারণ প্রশ্ন উঠছে ইসরাইল আদালতের এ আদেশ মানবে তো?
জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ আদালত গাজার পরিস্থিতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়মূলক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আইসিজে দেখতে পায় যে এটি বিচারের আওতায় পড়ে এবং মনে করে যে সম্ভবত ১৯৪৮ সালের জেনেভা কনভেনশন মানা হয়নি, যাতে করে গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণ অপূরণীয় ক্ষতির হুমকির মধ্যে আছে।
ফলে আদালত ইসরাইলের কাছে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে, যার বেশির ভাগই আসলে দক্ষিণ আফ্রিকা যে ৯টি ‘সাময়িক পদক্ষেপ’ গ্রহণের আবেদন জানিয়েছিল তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
আদালত ১৭ জন বিচারকের মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আদেশ দেয় যে ইসরাইল প্রশাসনকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা, তাদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক আঘাত, গাজার বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের জন্মগ্রহণে বাধা দেয়া এসব কিছু এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে।
একইসাথে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, জনগণকে গণহত্যায় প্ররোচনা দেয়া ‘ঠেকাতে ও শাস্তির আওতায় আনতে’ ইসরাইলের আরো বেশি চেষ্টা করা উচিত।
এছাড়া গাজার মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় ‘জরুরি ও কার্যকরী’ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
অস্ত্রবিরতির কথা উল্লেখ না থাকলেও যে সমস্ত দাবি-দাওয়া ইসরাইলের কাছে তোলা হয়েছে সেগুলো যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে গাজায় চলমান ইসরাইলের সামরিক অভিযানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
যদিও ইসরাইল বরাবরের মতোই গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে, বরং তাদের যুক্তি যে ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলার জন্য হামাসই দায়ী।
তারা বলছে, গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও শরণার্থী শিবিরের ভেতর ও নিচে ঢুকে হামাস তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, ফলে ইসরাইলের পক্ষে বেসামরিক লোকদের হত্যা এড়ানো একরকম অসম্ভব করে দিয়েছে।
তাদের দাবি সাধারণ লোকদের সতর্ক করে দিতে ও ঝুঁকি এড়াতে তারা যা যা করার সবই করছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি আদালতের এই রায়ের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ইসরাইলের অগাধ শ্রদ্ধা আছে, একইসাথে আমাদের নিজেদের মাতৃভূমি রক্ষার ব্যাপারেও আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’
ইসরাইলের ইহুদি নাগরিকদের মধ্যে একটা বিশ্বাস সর্বজনীন যে তাদের সেনাবাহিনী ‘বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক বাহিনী’।
কিন্তু গত অক্টোবর থেকে ইসরাইলিদের সামরিক অভিযানের ফলে গাজার ২৩ লাখ অধিবাসীর ৮৫ শতাংশই এখন বাস্তুচ্যুত।
যারা যুদ্ধ থেকে পালিয়েছে তারা আশ্রয় নিয়েছে জরাজীর্ণ, উপচেপড়া আশ্রয়কেন্দ্রে, যেখানে তেমন কোনো স্বাস্থ্যসেবা বা মানবিক সাহায্য নেই বললেই চলে।
আইসিজের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের জোয়ান দনোঘু তার বক্তব্য শুরু করতেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে গাজার জরুরি অবস্থা আদালত সবচেয়ে বেশি আমলে নিয়েছে এবং ইসরাইলের মামলা খারিজ করে দেয়ার চেষ্টা সফল হয়নি।
জোয়ান দনোঘু গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিরা যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে তার একটা সারাংশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশেষ করে শিশুদের কষ্ট ‘সবচেয়ে বেশি হৃদয়বিদারক’।
তবে গণহত্যার ব্যাপারে এটিই আদালতের চূড়ান্ত রায় নয়। সে রায় আসতে সামনে কয়েক বছরও লেগে যাতে পারে।
কিন্তু যেসব পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে সেগুলো মূলত গাজার ফিলিস্তিনি জনগণের সুরক্ষার কথা ভেবে করা হয়েছে, একইসাথে বিচারকরা দক্ষিণ আফ্রিকার মূল যে অভিযোগ সেটা নিয়েও কাজ করবে।
আদালত বলেছে, ইসরাইল কী কী ব্যবস্থা নিল সেটা এক মাসের মধ্যে তাদের জানাতে হবে।
এখন ইসরাইলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। আইসিজের রায়ের আইনি বাধ্যবাধকতা আছে, কিন্তু সেটা প্রয়োগে বাধ্য করার কোনো ক্ষমতা নেই তাদের। ইসরাইল চাইলে বিচারকদের অবজ্ঞাও করতে পারে।
ইসরাইল পাল্টা যুক্তি দেখাতে পারে যে তারা আদালতের চাহিদা পূরণে এরইমধ্যে কাজ করছে।
কিন্তু যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয়– যেটির এখনো কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না– তারপরও ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগটি থেকেই যায়, যে মামলার ব্যাপারে আইসিজে মনে করে এটির বিশ্বাসযোগ্যতা আছে এবং আরেকটু বিশ্লেষণ করে দেখা যায়।
ইসরাইল- যে রাষ্ট্রটিই শূন্য থেকে সৃষ্টি এবং যেখানে গণহত্যার জঘন্যতম উদাহরণ আছে, তাদেরকেই এখন আদালত রায় না দেয়া পর্যন্ত আইনি ছায়ার নিচেই থাকতে হচ্ছে।
গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইল গাজায় আক্রমণ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ২৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
নিহতের বেশির ভাগই হলো নারী ও শিশু। এছাড়া আহত মানুষের সংখ্যা সহস্রাধিক। এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ইসরাইলের ওপর হামাসের অতর্কিত আক্রমণের পর।
দীর্ঘদিনের নির্যাতন, অবৈধ বসতি স্থাপনসহ বিভিন্ন কারণে গত ৭ অক্টোবর হামাস ইসরাইলে হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছিল। হামলাকারীরা সেদিন প্রায় ২৫০ জনকে পণবন্দী করে গাজায় নিয়ে যায়।
ফিলিস্তিনকে জোরালোভাবে সমর্থন করে আসা দক্ষিণ আফ্রিকা আদালতের কাছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ৯টি বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেছিল।
যার মাঝে ছিল, গাজায় সামরিক তৎপরতা বন্ধ করা, যেটিকে ‘গণহত্যা’ বলছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
আন্তর্জাতিক আদালতের এই রায় ইসরাইল কতটা মেনে চলবে সেটি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় থাকলেও এটি তার আন্তর্জাতিক মিত্রদের ওপরও নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি