21546

04/20/2025 আনার খুনের পরিকল্পনায় সাবেক দুই এমপি ও দুই বড় ব্যবসায়ী!

আনার খুনের পরিকল্পনায় সাবেক দুই এমপি ও দুই বড় ব্যবসায়ী!

রাজ টাইমস ডেস্ক :

২৪ মে ২০২৪ ১০:২৪

স্বর্ণ চোরাচালানে আর্থিক লেনদেনে বিরোধের কারণেই খুন হয়েছেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীন। খবর ইত্তেফাকের। 

যদিও শাহীনের সঙ্গে ওই বৈঠকে বৃহত্তর যশোরের সাবেক দুইজন এমপি ও দুইজন বড় ব্যবসায়ীও ছিলেন। এই চারজনই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৪ সালে আজীম এমপি হওয়ার পর থেকে স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ একাই নিয়ে নেন। বেশ কিছুদিন আজীম একাই পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ভাগ দিতেন না কাউকে।

শত শত কোটি টাকার এই চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বন্ধু আজীমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আখতারুজ্জামান শাহীন। ভারতের যে ফ্ল্যাটে আজীমকে হত্যা করা হয়েছে, সেটিও আখতারুজ্জামানের ভাড়া করা।

বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারকে কিভাবে হত্যা করেছে, এরপর লাশ গুমের রোমহর্ষক বর্ণণা দিয়েছে খুনিরা। কিলিং মিশনের প্রধান আমানুল্লাহ গ্রেপ্তারের পর বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণণা দিয়েছেন। আমানুল্লাহর ভাষ্যমতে, আখতারুজ্জামান তাকে ৫ কোটি টাকার চুক্তিতে সাংসদ খুনের দায়িত্ব দেয়। পরে আমানুল্লাহই ভাড়া করেন মোস্তাফিজুর রহমান ফকির ও ফয়সাল আলীকে।

এই দুজনের বাড়ি খুলনার ফুলতলায়। পরে এদের দু’জনের মাধ্যমে জিহাদ ও সিয়াম নামের আরও দু’জনকে ভাড়া করা হয়। সিয়ামের দায়িত্ব ছিল লাশ গুম করা। আর আজীমকে ওই ফ্ল্যাটে আনতে ব্যবহার করা হয়, শিলাস্তি রহমান নামে এক নারীকে। শিলাস্তি বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রয়েছে বলে জানা গেছে। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে।

তার বাবা থাকেন পুরনো ঢাকায়। শিলাস্তি একাই উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতেন। সেখানে শাহীনসহ অনেকেরই যাতায়াত ছিল। শিলাস্তি ডিবি পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, খুনের সময় সে ওই ভবনের নিচ তলার একটি ফ্ল্যাটে ছিলেন। দোতলার ফ্ল্যাটে খুন হয়েছে। খুনিরা আগেই সেখানে অবস্থান করছিল। শিলাস্তি জানিয়েছে, আজীম ফ্ল্যাটে ঢোকা মাত্রই খুনিরা তার উপর আক্রমণ করে।

যে ফ্ল্যাটে আজীমকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে ৩০ এপ্রিল শাহীনের সঙ্গে উঠেছিলেন আমানুল্লাহ ও শিলাস্তি। ঘটনার ছক কষে আখতারুজ্জামান ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। অন্যরা ফ্ল্যাটে থেকে যান। খুনের পর ১৫ মে শিলাস্তি ও আমানুল্লাহ আকাশপথে ঢাকায় চলে আসেন। ১৭ মে ঢাকায় আসেন মোস্তাফিজুর, পরদিন ফেরেন ফয়সাল।

জিহাদের অবস্থান এখনো শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। তবে জবের নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা সিআইডি। সেই-ই জিহাদ কিনা তা সনাক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। কলকাতা সিআইডি বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের জানিয়েছে, খুনিরা যে ট্যাক্সিতে ব্যাগ নিয়ে উঠেছিল সেই ট্যাক্সি চালককে তারা আটক করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ব্যাগ উঠানোর কথা জানিয়েছে। ব্যাগগুলো ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা তিনি শুনেছেন বলে সিআইডিকে জানিয়েছে।

আখতারুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে। তবে সূত্র জানিয়েছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। জানা গেছে, এমপি আজীম ও আক্তারুজ্জামান শাহীনের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডিসহ আন্তর্দেশীয় বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার তথ্য রয়েছে। কিলিং মিশনের প্রধানের ভাষ্যমতে, ১২ মে সাংসদ কলকাতায় যাওয়ার পর কৌশলে ওই নারীকে দিয়ে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নেওয়া হয়। ১৩ মে সেখানে আনোয়ারুলকে হত্যা করা হয়। পরে লাশ কয়েক টুকরা করে ব্যাগে ভরে সরানো হয়।

এই হত্যার ঘটনা সম্পর্কে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি প্রধান) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কালীগঞ্জের তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের হত্যাকান্ডটি পারিবারিক, আর্থিক নাকি অন্য কোনো কারণে, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে ডিবি নিবিড়ভাবে ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে। ইতিমধ্যে ভারতের দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনার তদন্তে বাংলাদেশে এসেছেন। তারা গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ঢাকার গুলশান ও ধানমন্ডির দুটি বাসায় এক-দুই মাস ধরে সাংসদকে হত্যার পরিকল্পনা হয়। ঢাকায় ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় খুনি আমানুল্লাহর পরামর্শে হত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় কলকাতাকে। এই হত্যাকান্ডের প্রধান হোতা আমানুল্লাহর প্রকৃত নাম শিমুল ভুঁইয়া।

আখতারুজ্জামান শাহীনের বাংলোবাড়িতে উচ্চ পদস্থদের আসা-যাওয়া:

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে চল্লিশ বিঘা জমির ওপর এমপি আজীমের খুনের মূল পরিকল্পনাকারী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আখতারুজ্জামান শাহীনের একটি বাংলোবাড়ি আছে। তিনি কোটচাঁদপুর পৌর মেয়র শহিদুজ্জামান সেলিমের ছোট ভাই। প্রতিবছর তিনি দেশে ৬ মাস অবস্থান করেন। আখতারুজ্জামান শাহিন এমপি আনোয়ারুল আজীমের বাল্যবন্ধু এবং মাদক, স্বর্ণ ও হুন্ডির ব্যবসায়িক পার্টনার।

কোঁটচাদপুর মডেল থানার অফিসার্স ইনচার্জ সৈয়দ আল মামুন জানান, রিসোর্টের ভেতরে সুইমিং পুল, চা বাগান, গরু-ছাগলের ফার্ম, জার্মান শেফার্ড কুকুর, গলফ কোর্স ও বিভিন্ন ফলের বাগান রয়েছে। আছে কঠোর নিরাপত্তা, সিসি ক্যামরাসহ তারকাটা বেষ্টনি। শাহীন দেশে অবস্থানকালে এই রিসোর্টে সুন্দরী নারীদের আনাগোনা দেখা যায়। এ সময় রিসোর্টে ভিআইপিরা সময় কাটাতে আসেন।

এই রিসোর্টে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্থানীয় লোকজন জানান, গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে শাহীনসহ আরো কয়েকজনকে এই বাড়িতে দেখা যায়। ধারনা করা হচ্ছে এই রিসোর্টে বসেই হত্যার ছক কষে থাকতে পারে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা। বিমানবন্দর থেকে সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ পাচার করার সঙ্গে কাস্টমস, প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতারা সেখানে যাতায়াত করতেন।

তাদের জন্য সেখানে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা থাকত। কারা কারা সেখানে যাতায়াত করতেন এবং স্বর্ণ চোরাচালানের নেপথ্যে কারা জড়িত তাদের সনাক্তকরণে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান চালাচ্ছে।

সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুর এলাকা থেকে ১২ কেজি ৯৫০ গ্রাম স্বর্ণ আটক করে তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর। চোরাকারবারিরা নিশ্চিত হয় যে, দর্শনা শ্যামপুরের সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম স্বর্ণগুলো ধরিয়ে দিয়েছে। ওই ঘটনায় টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হন সাইফুল।

তিনি নিজেও স্বর্ণ চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটে যুক্ত ছিলেন। ওই হত্যা মামলায় আনারসহ আসামি করা হয় ২৫ জনকে। কুষ্টিয়ার চরমপন্থি নেতা মুকুল, শাহীন রুমী, ঝিনাইদহের চোরাকারবারি পরিতোষ ঠাকুর, আনারসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ এরপর তিনি ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত হন।

স্বর্ণ চোরাচালানের অন্যতম রুট মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা:

দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ পাচারের অন্যতম রুট ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা গেদে বর্ডার। এই অঞ্চলের মাদক,স্বর্ণ হুন্ডি চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন আজীম ছাড়াও সাবেক দুই জন সংসদ সদস্য ও দুই বড় ব্যবসায়ী। এরা অল্প দিনের ব্যবধানে এরা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

এরা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুবাই ও সিংগাপুর থেকে সোনার বার হিসেবে নিয়ে আসে। শাহাজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট বিমান বন্দর দিয়ে ছাড় হওয়ার পর তাদের অর্ধশতাধিক সুন্দরী নারী ও পুরুষ লেবার হিসেবে বাস ও ট্রেন যোগে ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বর্ডার দিয়ে ভারতে পাচার করে।

বিভিন্ন সময় বিজিবি ছোটখাট চালান আটক করলেও বড় বড় চালান নিরাপদে ক্ষমতার দাপটে পাচার করে দিয়েছেন। প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা পুলিশ ও ক্ষমতাধর সাংবাদিকদের অর্থ দিয়ে নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা চলে। তারা এতই ক্ষমতাধর যে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। মুখ খুললে হয় খুনের স্বীকার না গুম হতে হয়।

গত ১৭ জানুয়ারি বাঘাডাঙ্গা গ্রামে প্রকাশ্য ‘স্বর্ণ চোরাচালান তথ্য প্রদান করায়’ গুলি করে দুজনকে হত্যা করা হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ওই গ্রামের শামীম ইসলাম (৩৫) ও মন্টু মন্ডল (৫০)। এই ঘটনায়ও একজন সাবেক এমপির নাম শোনা যায়। এই জোড়া খুনের ঘটনায় স্থানীয় মহেশপুর থানায় পৃথক ভাবে দুটি হত্যা মামলা দায়ের করে নিহতের পরিবার।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]