2502

05/05/2024 আজ হানাদার মুক্ত রাজশাহী দিবস

আজ হানাদার মুক্ত রাজশাহী দিবস

মহিব্বুল আরেফিন

১৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:০৭

১৮ ডিসেম্বর। বিভাগীয় শহর রাজশাহীর ঐতিহাসিক এক আনন্দঘন মুহুর্তের দিন। এই দিনে স্বাধীনতার সুবাতাস-সুঘ্রাণ উড়ে। অবরুদ্ধ হাজারো মানুষ নেমে এসে রাজশাহীর মুক্ত বাতাসে। অথচ দু’দিন আগে ১৬ ডিসেম্বর মুক্ত পতাকা বাংলার আনাচে-কানাচে পতপত করে উড়তে থাকে।
১৮ ডিসেম্বর সকালে বিধ্বস্ত রাজশাহীর মাদরাসা হাইস্কুল মাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করেন। রাজশাহীকে ঘোষণা করেন ‘পাক হানাদার মুক্ত’ । কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে এই অঞ্চল পরিচালনা জন্য প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধকালে রাজশাহী ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন।

রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দান

সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক শহীদ হওয়ার পর এই ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নেন কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান (বীর উত্তম)। তৎকালীন পৌরসভা ভবনকে কন্ট্রোল রুম করে পরিচালিত হতে থাকে প্রশাসন। একই সাথে শান্তি বজায় রাখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকলকে আহ্বান জানানো হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ননা থেকে জানা যায়, ওই সময় রাজশাহী ছিল ‘মৃত এক নগরী’। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতায় শহরের রাস্তাঘাট ছিল ভয়ার্ত নীরব ও জনমানবহীন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ও তাদের সহযোগী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে মানুষজন তখনও বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, রাজশাহীকে শক্রমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা অনেকগুলো খণ্ড যুদ্ধ ও গেরিলা হামলা চালিয়েছিলেন। এর মধ্যে সাতটি সম্মুখ যুদ্ধ ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের বিপরীতে অনুন্নত থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়েই অসম সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন মুক্তিকামী বাঙালিরা। রাজশাহীতে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছিল পুলিশ লাইনে। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ২৫ মার্চ ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রান্ত হওয়ার পর প্রস্তুতি শুরু করেন রাজশাহী পুলিশ লাইনের সদস্যরা।

পাকিস্তানি সরকারের সব ধরনের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ রাজশাহীর পুলিশ অমান্য করে। ২৬ মার্চ পুলিশ লাইন দখল নিতে পাকিস্তানি আর্মি রাজশাহী পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে। পুলিশ সদস্যরাও বীরত্বের সঙ্গে পাল্টা জবাব দেন। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রাজশাহী পুলিশ লাইনের সদস্যদের লড়াই একটি গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। পুলিশের সহযোগিতা না পাবার অজুহাত তুলে পাকিস্তানি বাহিনী পুলিশ লাইনে হামলা করার পরিকল্পনা করে।

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরীর পাতা (সংগৃহীত)
মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ননা থেকে জানা যায়, ‘কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহরে প্রবেশ করেন এবং অন্যরা রাত ৮টার দিকে। রাত ১২টার দিকে মেজর গিয়াস শহরে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল, তখন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য নাটোরের দিকে পিছু হটতে থাকে। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর সকালে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যারা মিত্র বাহিনীর হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছিলেন তারা শহরে পৌঁছে এবং রাজশাহী কলেজ মাঠে তাঁবু স্থাপন করেন।
এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকার কাছে পৌঁছে যায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিশাল বহর। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে মুখে মুখে। বেতার যন্ত্রের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন অবরুদ্ধ স্বাধীনতাকামী বহু মানুষ। তবুও পাকিস্তানপন্থী অবাঙালিরা দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা করতে থাকে। তবুও বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা স্বাধীনতাকামীরা। স্বজন হারানোর শোক বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে থাকলো চারিদিকে। আত্মগোপন করলো রাজাকার আলবদর ও পাকিস্তানপন্থী অবাঙালিরা। মুখোশ পাল্টিয়ে বেশ কিছু দোসর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী একটি দল সাদা পতাকা উড়িয়ে সাদা পাগড়ি আর আত্মসমর্পণের বার্তা নিয়ে রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে এসে গেল। বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা আর মিত্রবাহিনীকে ফুলের পাপড়ি-গোলাপ পানি ছিটিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। খাদ্য সংকট যাতে না হয়, সে জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করে।

অবাঙালি মহল্লা থেকে উদ্ধার করা হয়। একই সাথে বিভিন্ন টর্চার ক্যাম্প, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয় নির্যাতিত নারী-পুরুষদের। বধ্যভূমিগুলিতে স্বজনদের মরদেহ খুঁজতে থাকে স্বজনরা।
এরই মধ্যে দিয়ে শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে বিধ্বস্ত রাজশাহীর অগ্রযাত্রা।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]