2900

04/24/2024 বিরিশিরি

বিরিশিরি

রুমানা নাসরিন

১৩ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:০৩

বিরিশিরি ভ্রমণ
------------------------
দেশের প্রায় সবগুলো পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখা হলেও কিভাবে যেন বিরিশিরি যাওয়া হয়ে উঠেনি। একবার ঈদের ছুটিতে প্রোগ্রাম করেও দীর্ঘ যানজটের সংবাদে শেষ মুহুর্তে বাতিল করতে হলো।
এবছর মার্চ মাসে করোনা সংক্রমণের পর থেকে বলতে গেলে গৃহবন্দিত্ব চলছে। বাচ্চারাও ঘরে বসে বসে হাঁপিয়ে উঠছে। একদিনের জন্য হলেও কোথাও নিরাপদে বেড়িয়ে আসা যায় কিনা ভাবছি। এমনি সময় আমাদের পারিবারিক বন্ধু ফোন করে তাঁর নেত্রকোনার সদ্য নির্মিত বাড়ীতে আমন্ত্রণ জানালেন। এমনকি এও বললেন যে, ওনাদেরও বিরিশিরি যাওয়া হয়ে উঠেনি। আমরা গেলে একসাথে যাবেন। ভাবীও ফোন করে কথা বললেন। করোনা পরিস্থিতির কথা ভেবে ইতস্তত করতে তাঁরা বললেন, ওদিকে নাকি করোনার অস্তিত্বই নেই। শহরতলীতে তাঁদের বাড়িটাও একদম নিরিবিলি। একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। দক্ষিণ দিকে দশ মিনিট হাঁটলেই বিশাল গুঁজা বগির বিল। আর পূর্বদিকে মগরা নদীর ঠিক ওপারে কবি নির্মলেন্দু গুণের তৈরি "কবিতা কুঞ্জ।"
সবকিছুর বর্ননা শুনে এবং তাঁদের আন্তরিকতায় শেষ পর্যন্ত এক বৃহস্পতিবার ভোর ছ'টায় ঢাকা থেকে একটা মাইক্রো নিয়ে আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম।
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে মাত্র এক ঘন্টায় গাজীপুর চৌরাস্তা পৌঁছে গেলাম। ওখান থেকে আমাদের সফরসঙ্গী হলেন দুই পরিবারেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু জহুরুল ভাই ও ভাবী।
খুব ভোরে বের হওয়ার কারনে সারাপথে কোনো যানজটের সম্মুখীন হতে হয় নি। সাড়ে ন'টায় ময়মনসিংহ পৌঁছে আমরা বিখ্যাত শশীলজ দেখার জন্য নামলাম। তার আগে গাড়িতে বসেই পাউরুটি কলা সিদ্ধ ডিম দিয়ে নাস্তা করে নিয়েছি। ফ্লাস্ক থেকে চা পান করে আমরা শশীলজের গ্যেট থেকে টিকেট সংগ্রহ করে ভিতরে ঢুকলাম। একজন কর্মচারী নিজ উদ্যোগে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবকিছু দেখালেন। হুমায়ুন আহমেদের অয়োময় নাটকের শুটিং কোথায় হয়েছে, ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সেট কোথায় করা হয়েছিলো, শশীলজের সামনে বিখ্যাত ভাস্কর্য দেখিয়ে সকলের ছবি তুলে দিলেন উনি। ইতিমধ্যে আমাদের মেজবান মিন্টুভাই বারবার ফোন করে খবর নিচ্ছেন কতদূর পৌঁছেছি তা জানতে। শেষ পর্যন্ত বেলা সোয়া এগারোটায় আমরা নেত্রকোনা শহরের দক্ষিণ সীমানায় মিন্টু ভাইয়ের শহরতলীর বাড়িতে পৌঁছে গেলাম।
দোতলায় আমাদের থাকার রুমের ব্যবস্থা দেখে সবাই মুগ্ধ। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নীচে নামতে হলো কিছু মুখে দিতে। হরেক রকমের ঝাল ও মিষ্টি পিঠা ছাড়াও হাঁসের মাংস ভূনা ও রুটি খেতে হলো অসময়ে। তারপর ভাবীর হাতের অসাধারণ চা পান করে আমাদের ক্লান্তি নিমেষে উধাও।
নেত্রকোনায় সেদিন শৈত্য প্রবাহ শুরু হয়েছে। শীতে হিহি করে কাঁপছি সবাই। সোয়েটার মাফলার কানটুপি বের করা হলো। গরম পানিতে গোসল করার কিছুক্ষণ পরই আবার দুপুরের খাবারের জন্য ডাক এলো। টেবিলে বসে বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া। কতো রকমের যে মাছের আয়োজন করেছেন তা দেখে লজ্জাই লাগলো। তার সাথে আবার গরুর ও দেশী মুরগির মাংস ভূনা। ভাবীর রান্না অসাধারণ। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে সবাই একটা ঘুম দিলাম। সন্ধ্যার পরপর মাটির চুলা জ্বালিয়ে পিঠা উৎসবের পর হবে ভাটি অঞ্চলের এসময়ের অন্যতম সেরা গানের শিল্পী সোহেল রানা এবং তাঁর সঙ্গীদের গানের আয়োজন। শ্রোতা আমরা জনা দশেক লোক। করোনার ভয়ে আর কাউকে আসার সুযোগ দেয়া হয় নি।
বিকেলে চা খেয়ে আমরা মগরা নদী নৌকায় পাড়ি দিয়ে ওপারে গিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম কবি নির্মলেন্দু গুণের তৈরি "কবিতা কুঞ্জ।" নদীর তীর ঘেঁষে ছোট্ট একতলা দালানে মনের মতো করে কবি সাজিয়েছেন তাঁর স্বপ্নগুলো। পরিদর্শন বইতে অনুভূতি লিখে আমরা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এলাম।
রাত ন'টা থেকে শুরু হলো গানের অনুষ্ঠান। এক একটা গান যেন হৃদয়ের সব জায়গায় কাড়া নাড়ে। শিল্পী সোহেল রানার অসাধারণ কন্ঠ এবং গায়কী। উকিল মুন্সী, শাহ আব্দুল করিম ও রাধারমণের গানই বেশি হলো। রাত বারোটায় "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম" গানের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ করতে হলো। কারন পরদিন খুব ভোরে ভ্রমণের মূল আকর্ষণ বিরিশিরি দেখতে বের হবো সারাদিনের জন্য।
পরদিন ভোর পৌনে সাতটায় ঢাকা থেকে আসা ছয়জনের সাথে মিন্টু ভাই ও ভাবী যুক্ত হয়ে আমরা আটজন বিরিশিরি রওয়ানা দিলাম। সোমেশ্বরী নদীর তীরে দুর্গাপুর খেয়াঘাটে মিন্টুভাইর পরিচিত এক ছাত্র গাইড হিসেবে আমাদের সাথে যুক্ত হবে।
অতো সকালে রাস্তা একদম ফ্রী থাকায় বত্রিশ কিলোমিটার পথ এক ঘন্টা বিশ মিনিটে দুর্গাপুরে পৌঁছে গেলাম।
লোকজনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে খেয়াঘাট থেকে একটু আগে নিরিবিলি নামের একটা রেস্তোরাঁয় নাস্তা করতে বসলাম। দোতলায় রেস্তোরাঁ। তৃপ্তি সহকারে নাস্তা করে আমরা পায়ে হেঁটে সোমেশ্বরী নদীর বালুকাময় ঢাল বেয়ে ইঞ্জিন চালিত বড়ো আকারের খেয়া নৌকায় উঠে বসলাম। জনা বিশেক লোক ও গোটা দশেক মোটরসাইকেল সহ নৌকা ছেড়ে দিয়ে পাঁচ মিনিটে ওপারে পৌঁছে গেলো। কিছুটা বালুর মধ্য দিয়ে হেঁটে পাকা রাস্তায় উঠে দেখি সাড়ি সাড়ি ভাড়ার মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা অপেক্ষমান। ওদের এখান থেকে চার পাঁচ ঘন্টার জন্য রিজার্ভ করে নিতে হয় সবকিছু ঘুরে ফিরে দেখিয়ে আবার এখানে পৌঁছে দেয়ার জন্য।
সবাই বলে দিয়েছিলো তিনটার মধ্যে ওপারে অর্থাৎ দুর্গাপুরে ফিরে লাঞ্চ করতে। কারন এপারে কোথাও ভালো রেস্তোরাঁ নেই। বিরিশিরি চীনা মাটির পাহাড়ের কাছাকাছি গোটা দুই রেস্তোরাঁ থাকলেও তা মানসম্মত নয়। কিন্তু আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম খাওয়ার জন্য ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত না করে এপারে যা পাওয়া যায় তাই খেয়ে ধীরে সুস্থে সবকিছু ঘুরে দেখবো।
গাইড আমাদেরকে দুটো অটোতে করে প্রথমেই নিয়ে গেলো জিরো পয়েন্টে বিজিবি ক্যাম্পের গ্যেটে। তাদের অনুমতি নিয়ে নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকা ভাড়া করে কাকচক্ষু জলের সোমেশ্বরী নদী দিয়ে আমরা এগুতে লাগলাম দুই দেশের সীমানা চিহ্নিত লাল পতাকা ও সীমানা পিলারের দিকে। ঐ পাশে টিলার উপর বিএসএফ এর সীমানা চৌকি, আরেকদিকের সীমানায় কাঁটা তাঁরের বেড়া। নদীর তীরে এক এক জায়গায় গোলাপি রঙের পাথরের পাহাড়। অনেকে আমাদের সীমানা পেড়িয়ে ভারতীয় অংশে চলে গেলেও আমরা লগি বৈঠা বাওয়া ছেলেটিকে নিষেধ করলাম ওদিকে যেতে। আধা ঘণ্টার মতো চমৎকার নৌবিহার শেষে আমরা ঘাটে ফিরে এলাম। জনপ্রতি ভাড়া বিশ টাকা। আমরা ছেলেটিকে তিনশো টাকা দেয়ায় খুশি হলো। এরপর একদম কাছেই কমলা বাগান। আসলে একসময় এখানে কমলা বাগান থাকলেও এখন দু-একটি গাছ অবশিষ্ট আছে। তা দেখার জন্য আবার অনেক উঁচু টিলায় হেঁটে উঠতে হবে। তাই কেউই আগ্রহ দেখালো না। এরপর আমরা অটোতে চড়ে পৌঁছলাম ১৯১২ সনে প্রতিষ্ঠিত সাধু যোসেফের আখড়ায়। অনুমতি নেয়ার পর গ্যেট খুলে দিলো। পাকা রাস্তা বেয়ে মাঝারি উচ্চতার টিলায় হেঁটে উঠতে একটু কষ্ট অনুভূত হয়। ওখান থেকে দক্ষিণ দিকের দৃশ্য খুব সুন্দর। ভারতের পাহাড়, তার উপরে কাঁটা তাঁরের বেড়া স্পষ্ট দেখা যায়। একদম উপরে সমতল গাছপালা বেষ্টিত একটা জায়গায় ঢোকার আগে চমৎকার একটা গ্যেট। তারপর বামদিকে মূল আখড়া। এবং তার পূর্বদিকে বেশ কয়েকজন সাধুর ভাস্কর্য। সকলে মিলে ছবি তুলে আবার নীচের দিকে হেটে নামলাম। এবার আমাদের গন্তব্য পিসিআই পাহাড়। প্রায় মিনিট পনেরো অটো চালিয়ে পিসিআই পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের নামিয়ে দিলো। নামে পাহাড় বললেও এটা বেশ উঁচু একটা চীনা মাটির টিলা। তার অর্ধেকের বেশি কেটে নিয়ে গেছে কোনো এক সময়ে। এখন এসব পাহাড় খনন সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। সাজেকের কাংলাক পাহাড়ের মতো এটা উঁচু। আঁকাবাকা চিকন এক ফালি পথ বেয়ে তার চুড়ায় ওঠা সম্ভব হলেও নামা বেশ ঝুকিপূর্ণ। তাই মহিলারা কেউ ওঠলাম না। তিনজন পুরুষ ও আমার ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে মেয়ে দুটি ওদের বাবার সাথে উঠতে শুরু করলো। আমরা এসে অটোতে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর সবাই যখন ফিরলো তখন এই শীতল আবহাওয়ায়ও সকলের ঘর্মাক্ত অবস্থা। আমার স্বামী বললেন, না উঠে ভালোই করেছ। নামার সময় আসলেই ভয় করেছিলো।
ততক্ষণে সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। ঐদিন ছিলো শুক্রবার। পুরুষেরা জুমার নামাজে যাবেন। তার আগে চীনা মাটির মূল তিনটি পাহাড়ের কাছে আমাদের পৌঁছে দিয়ে কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত হোটেলে খাবার ব্যবস্থা করে ও মসজিদে নামাজ পড়ে তাঁরা দুটা নাগাদ আমাদের সাথে নির্দিষ্ট জায়গায় দেখা করবেন। গাইড ছেলেটি অমুসলিম। ও সবসময় আমাদের সঙ্গে ছিলো।
এতক্ষণে অটো এসে থামলো ভ্রমণের মূল আকর্ষণ গোলাপি চীনা মাটির টিলা এবং সংলগ্ন নীল জলের লেকের পাশে। প্রথম দর্শনেই সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর দৃশ্য আমাদের দেশে আছে তা না দেখলে বিশ্বাসই হতে চায় না। সকলের মুখ থেকে বারবার শুধু "ওয়াও, অসাধারণ, চমৎকার" এসব শব্দ বের হতে লাগলো। এ জায়গার অপরুপ দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে আধা ঘণ্টা এখানে ঘুরে ফিরে তিনজন পুরুষ বেলা একটায় নামাজ পড়তে গেলেন। ফিরে এসে বাকি একমাত্র সাদা পাথরের টিলা ও সংলগ্ন সবুজ পানির লেক দেখে আমাদের ভ্রমণ সমাপ্ত হবে।
আমরা সবাই অনেক ছবি তুললাম। ডাব কিনে মিষ্টি জল ও ভিতরের শাঁস খেয়ে ক্লান্তি দূর করলাম। তারপর একটা গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেই ওনরা নামাজ পড়ে ফিরে এসে বললেন, খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক ভালো ব্যবস্থা।
এবার সবাই মিলে মিনিট দশেক হেঁটে সাদা পাথরের টিলা দেখতে গেলাম। খুব সুন্দর দৃশ্য। বিশেষ করে ওখানের লেকের পানি গাঢ় সবুজ। মুগ্ধ হয়ে সবকিছু দেখে অনেক ছবি তুলে এবার ফেরার পথ ধরলাম উঁচু নীচু টিলার উপর দিয়ে। কেউ কেউ নিষেধ করলেও আসলে তেমন কষ্টকর কিছু নয়। শেষ মাথায় পৌঁছে অটোতে চড়ে খাবার হোটেলে পৌঁছে দেখি মূল হোটেল খুব ছোট একটা ঘর হলেও সংলগ্ন জমিতে বিয়ের প্যান্ডেলের মতো সুন্দর সাজানো-গোছানো সাময়িক ব্যবস্থা। বেশ খোলামেলা এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সাদা ভাত, দেশী মুরগি ভূনা, কোয়েল ভূনা এবং ডাল চচ্চড়ি দিয়ে পেটপুরে খেয়ে রান্না ও পরিবেশনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা বিদায় নিয়ে এবার খেয়াঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।নদী পাড় হয়ে এপারে এসে ঐ নিরিবিলি হোটেলে চা পান করে বিকেল চারটায় আমরা নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বাসায় পৌঁছে গেলাম। প্রায় এগারো ঘন্টার এক উপভোগ্য ভ্রমণের মূল অংশ এভাবেই সমাপ্ত হলো। পরদিন আমরা যাবো হাওর ভ্রমণে। সে কাহিনি নাহয় আরেকদিন হবে। সঙ্গে থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
 
লেখা  ও ছবি- রুমানা নাসরিন
প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]