03/14/2025 আল-হাথলুলের মুক্তির পেছনে থাকা হিসেব-নিকেশ
রাজটাইমস ডেক্স
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:৫১
সৌদি আরবের অন্যতম আলোচিত নারী অধিকার কর্মী লুজাইন আল-হাথলুল প্রায় তিন বছর কারাভোগের পর বুধবার রাতে মুক্তি পেয়েছেন। তবে এটি শুধুই একজন সৌদি নারীর কারামুক্তির ঘটনা নয়।
সৌদি আরবে সম্প্রতি পর পর অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে - যার ধারাবাহিকতাকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একত্রিশ বছর বয়স্ক হাথলুল ছিলেন সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানোর অধিকারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের পুরোভাগে। কিন্তু সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আবির্ভূত হবার পর - যখন ২০১৮ সালে সত্যিই সৌদি আরবে মেয়েদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া হলো, তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই - আরো কয়েকজন নারী অধিকার কর্মীসহ - গ্রেফতার করা হয়েছিল লুজাইন আল-হাথলুলকে।
তার পর 'রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের এবং জনশৃঙ্খলা বিনষ্টের চেষ্টার' দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে একটি আদালত এবং প্রায় ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে।
ইলেকট্রিক শক, চাবুক, যৌন হয়রানি
তার পরিবার বলেছে, প্রথম দিকে তিন মাস লুজাইনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এসময় তাকে বন্দী অবস্থায় ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়, চাবুক মারা হয়, যৌন হয়রানি করা হয়। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি যদি এই নির্যাতনের কথা গোপন রাখেন - তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।
সৌদি সরকার অবশ্য নির্যাতনের সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
লুজাইনের মুক্তির খবরে তার পরিবার উল্লাস প্রকাশ করলেও জানিয়েছে যে তিনি এখনো মুক্ত নন। তাকে বিভিন্ন রকম বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে হবে এবং পাঁচ বছর তিনি দেশের বাইরে কোথাও যেতে পারবেন না।
সংস্কার নিয়ে ঢোল পেটানোর ওপর 'কালো ছায়া'
বিবিসির লিজ ডুসেট বলছেন, সৌদি আরবে ভিন্নমতের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন লুজাইন আল-হাথলুল।
তার মতো আরো অনেক নারী সৌদি আরবের জেলে পচছেন, কিন্তু তার পরিবারের সাহসিকতার কারণে এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর সার্বক্ষণিক প্রচারের কারণে লুজাইন উঠে আসেন পাদপ্রদীপের আলোয়।
সৌদি আরবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের নানা কর্মসূচিকে তুলে ধরে দেশটির এক নতুন ইমেজ তুলে ধরার প্রচেষ্টা চলছে - তখন জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডের মতোই লুজাইন আল-হাথলুলের বন্দীত্ব এর ওপর ফেলেছিল এক কালো ছায়া।
সাম্প্রতিক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করেছেন যে সৌদি আরবে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
১. কাতারের সাথে মৈত্রী পুনঃপ্রতিষ্ঠা
সৌদি আরব তাদের প্রতিবেশী কাতারের সাথে মৈত্রী পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। ২০১৭ সালের জুনে সৌদি আরব এবং তার চার ঘনিষ্ঠ আরব মিত্র - সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও বাহরাইন হঠাৎ করে কাতারের ওপর সর্বাত্মক অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল।
সৌদি আরব ও তার মিত্ররা দাবি করেছিল, কাতারকে ১০ দিনের মধ্যে ১৩টি দাবি মানতে হবে - যার অন্যতম ছিল আল জাজিরা টিভি নেটওয়ার্ক বন্ধ করা, ইরানের সাথে সম্পর্কে রাশ টানা এবং সেদেশে তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা।
কিন্তু গত মাসে আল-উলা শহরের উপসাগরীয় জোটের এক বৈঠকে কাতারের যোগদানের মধ্যে দিয়ে তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে।
কাতারকে একটি মামলা প্রত্যাহার ছাড়া আর কোন দাবিই মানতে হয়নি।
২. সৌদি আরবের বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার
কিছু দিন আগেই সৌদি আরবের বিচার ব্যবস্থায় সংস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
এত দিন দেশটিতে ইসলামী আইন বা শরিয়া ছাড়া কোনো লিখিত আইনি ব্যবস্থা ছিল না।
এর ফলে বিভিন্ন মামলায় জটিলতা, এবং রায়ে অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছিল - যার ফলে বহু সৌদি বিশেষত নারীরা দুর্ভোগে পড়ছিলেন।
কিন্তু এখন চারটি নতুন আইন তৈরি পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে সৌদি কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে দেশটি সকল আইন লিপিবদ্ধ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
৩. অধিকারকর্মীদের কারামুক্তি
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, তাদের অনেককেই সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত 'বোগাস মামলায়' আটকে রাখা হয়েছিল।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত এই বন্দীদের একজন হলে লুজাইন আল-হাথলুল।
গত কয়েক সপ্তাহে সৌদি-মার্কিন দ্বৈত নাগরিক এমন কয়েকজন আটক ব্যক্তিকেও মুক্তি দেয়া হয়েছে বা সাজার মেয়াদ কমানো হয়েছে।
জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর পরিবর্তনের সূচনা?
লুজাইন আল-হাথলুল মুক্তি পাবার পরই একে স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
তিনি বলেছেন, 'আল-হাথলুল নারী অধিকারের একজন জোরালো প্রবক্তা এবং তাকে মুক্তি দেয়াটা সঠিক কাজই হয়েছে।'
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে এক রিপোর্টে সারা দাদুশ ও করিম ফাহিম লিখছেন, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকেই সৌদি আরবকে সংশয়ের চোখে দেখা হচ্ছিল ওয়াশিংটনে।
রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকারের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে আশ্বস্ত করতে সৌদি আরব যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে - লুজাইন আল-হাথলুলের মুক্তি তার সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ।
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের সাথে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদের ছিল উষ্ণ সম্পর্ক।
সৌদি নীতির সমালোচকরা বলেন, এই সুসম্পর্কের কারণে যুবরাজ মোহাম্মদ - যাকে অনেকে বলেন এমবিএস - ইচ্ছেমত কাজ করতে পেরেছিলেন, বলছে ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট শিবির মনে করে, ট্রাম্প প্রশাসন এমবিএসকে "ব্লাাংক চেক" দিয়ে দিয়েছিল।
ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগজি ইস্তুাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে নৃশংসভাবে খুন হবার পর মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ বলেছিল যুবরাজ মোহাম্মদই ওই অপারেশনের আদেশ দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তি দেন যে এ হত্যাকাণ্ডের ফলে সৌদি-মার্কিন বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ব্যাহত হওয়াটা ঠিক হবে না।
কিন্তু ২০১৯এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পূর্ব বিতর্কে জো বাইডেন বলেছিলেন, সৌদি আরবকে এ জন্য 'মূল্য দিতে হবে' এবং তিনি সেখানে 'অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেবেন।'
বাইডেনের বিজয় বদলে দিয়েছে সবকিছু
জো বাইডেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা সেনেটের নিয়ন্ত্রণও লাভ করেছে।
বিবিসির বিশ্লেষক লিজ ডুসেট বলছেন, সৌদি কর্মকর্তারা বলেন, তারা বাইরের কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করছেন না।
কিন্তু হোয়াইট হাউসে নতুন দল আসার পর তারা মানবাধিকারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে, এবং এটা স্পষ্ট যে সৌদি আরব চাইছে - এই ইস্যুটা এজেণ্ডা থেকে দূর হয়ে যাক, বলছেন লিজ ডুসেট।
আল-হাথলুলের মুক্তি, বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ঘোষণা - এগুলো এসেছে এ সপ্তাহেই।
তা ছাড়া সৌদি কর্মকর্তারা জোর দিয়েই বলে থাকেন - মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যে কৌশলগত গুরুত্ব আছে, তার কাছে খাসোগজি হত্যার মতো অন্য সব ইস্যু চাপা পড়ে যাবে।
তবে গত বেশ কিছু দিন ধরেই সৌদি আরব তার 'ব্র্যান্ড ইমেজ' উন্নত করতে চেষ্টায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে।
সৌদি কর্মকর্তারা উল্লেখ করছেন যে সেখানে সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যাও কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
পরিবর্তন কতটা স্থায়ী হবে?
জো বাইডেনের প্রশাসন সৌদি মার্কিন সম্পর্কের খোলনলচে পুরো বদলে ফেলার অঙ্গীকার করেছে - যাতে মানবাধিকার একটা বড় ভূমিকা পালন করবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েকদিন আগেই ঘোষণা করেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র আর ইয়েমেনে সৌদি-নেতৃত্বাধীন যুদ্ধকে সমর্থন করবে না।
যদিও এর বাস্তব প্রয়োগ ঠিক কীভাবে হবে তা খুব স্পষ্ট হয়নি এখনো, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকরা বলেছেন, এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরবের জন্য এক বড় আঘাত।
কারণ ইয়েমেনের রক্তাক্ত যুদ্ধে হুতি বিদ্রোহী-বিরোধী অভিযানে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে সৌদি আরব - এবং এই নীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছেন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
জো বাইডেন প্রশাসন আরেকটি পদক্ষেপ নিয়েছে, আর তা হলো - সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করা - যদিও এর একটা পুনর্বিবেচনা হবার কথা আছে।
কিন্তু এসব পরিবর্তন কি দীর্ঘমেয়াদী হবে?
বিবিসির বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, আরব বিশ্বে আমেরিকার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা বিষয়ক সহযোগী হলো সৌদি আরব।
তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের সম্প্রসারণের মোকাবিলা করতে সৌদি আরব এক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত মিত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের এক বড় ক্রেতা।
স্টকহোম ইনস্টিটিউট অব পিস রিসার্চ বলছে, ২০১৫ থেকে ১৯ পর্যন্ত সৌদি আরব ছিল সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক। ইয়েমেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মত পশ্চিমা দেশগুলো থেকে যাওয়া অস্ত্র ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই অস্ত্র আমদানির বড় অংশই শুরু হয়েছিল বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকার সময় - যখন জো বাইডেন ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
অস্ত্র বিক্রির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান সিএএটি-র এ্যান্ড্রু স্মিথ বলেন, এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হলে মি. বাইডেনকে অনেক বেশি শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, রিয়াদের সাথে রাশিয়া ও চীনও অস্ত্র ব্যবসা করতে আগ্রহী হবে, আর তাদের সুবিধা হলো তারা মানবাধিকার নিয়ে কোন "অস্বস্তিকর প্রশ্ন" তুলবে না।
সৌদি আরব কার্যত এখন চালাচ্ছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই। তার আশপাশে যারা আছেন তারা নিশ্চয়ই দেশটির নেতিবাচক ইমেজের ব্যাপারে সচেতন।
প্রশ্ন হচ্ছে, সৌদি আরবের মানবাধিকার কতটা উন্নত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র? এটা নির্ভর করবে, হোয়াইট হাউস এ নিয়ে কতটা চাপ প্রয়োগ করতে চায় তার ওপর।
সেখানে পারস্পরিক স্বার্থের হিসেবটা গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি রাজদরবারের ভেতরের খবর রাখেন এমন একটি সূত্র বলেছেন, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত অংশীদারই থাকবে । তবে বাইডেন প্রশাসন মানবাধিকারে ওপর অনেক বেশি আলোকপাত করবেন।
"এটা এখন এজেন্ডার অংশ, তাই শুধু কথায় আর চলবে না - কাজ দরকার" - বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি