5298

04/20/2024 করোনার তৃতীয় ঢেউ কড়া নাড়ছে দেশে

করোনার তৃতীয় ঢেউ কড়া নাড়ছে দেশে

রাজটাইমস ডেস্ক

৯ জুন ২০২১ ১৪:০০

করোনা সংক্রমণ বাড়ছে ধীরে। সংক্রমণ হার এক সংখ্যা থেকে এক দ্বৈত সংখ্যায় (ডাবল ডিজিট) পৌঁছে গেছে। গতকাল মঙ্গলবার সংক্রমণ ছিল ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। ঈদের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে সংক্রমণ। যেসব স্থানে করোনা সংক্রমণ বেশি সেসব স্থানগুলোতে সংক্রমণ কমিয়ে রাখার এখনই পুরো মাত্রায় ব্যবস্থা নেয়া না হলে খুব শিগগিরই দেশবাসী তৃতীয় সংক্রমণ দেখবে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন।

বাংলাদেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হলে তা হবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বা ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের (ধরন) সংক্রমণ। কারণ এই ভ্যারিয়েন্টের করোনা স্বাভাবিক ভ্যারিয়েন্ট থেকে ৫০ থেকে ৬০ গুণ বেশি সংক্রামক অর্থাৎ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট স্বাভাবিকের চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি ছড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এ ব্যাপারে ব্রিটেনের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম গতকাল মঙ্গলবার বলেন, যেখানে যেখানে ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে সেসব এলাকার আক্রান্তদের কনট্যাক্ট ট্রেসিং করতে হবে অর্থাৎ আক্রান্তের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের সবাইকে খুঁজে বের করে কোয়ারেন্টিনে নিতে হবে। এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে ওই এলাকাকে কঠোর লকডাউনের আওতায় আনতে হবে।

বাংলাদেশে ভারতীয় ডেল্টা ধরনের প্রাধান্য বিস্তার প্রসঙ্গে ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, সম্প্রতি আইইডিসিআর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছে, তা সারা দেশের অবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সংক্রমণের গতি প্রকৃতি সম্বন্ধে একটি ধারণা দিতে পারে। তবে আইইডিসিআরের রিপোর্ট থেকে যা জানা যাচ্ছে তা হলো- বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে এবং সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু গবেষণার ফল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ৫০-৬০ শতাংশ বেশি দ্রুত ছড়ায়। যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট নিজেই অনেক বেশি সংক্রমণশীল এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট তার চেয়েও বেশি দ্রুত ছড়ায়। এ কারণে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটি অনেক বেশি মারাত্মক।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, খুব অল্প সময়ে ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যুক্তরাজ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে তীব্র সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, টিকা দেয়ার পরিমাণ কম বলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অরক্ষিত। এ কারণে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ তৈরি করতে পারে।

তিনি জানান, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে আক্রান্তদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা গেছে। এ কারণে বাংলাদেশে তৃতীয় ঢেউ তৈরি হলে তা আগের দু’টি সংক্রমণ থেকে তীব্র হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

দেখা যাচ্ছে ২০ মে পর্যন্ত সংক্রমণ ৮ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। ২৪ মে ছিল ৮.১৫ শতাংশ, ১ জুন ছিল ৯.৬৭ শতাংশ। এর পর থেকে সংক্রমণ পৌঁছে গেছে ডাবল জিজিটে। গত ৪ মে নমুনা পরীক্ষার সাপেক্ষে দেশে করোনা সংক্রমণ ছিল ১০.৪০ শতাংশ। এর পর থেকে প্রতিদিনই বেড়েছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
গতকাল মঙ্গলবার করোনা শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৩২২ জন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে করোনা সংক্রমণ গত ১৫ মে ছিল সর্বনিম্ন ২৬১ জনের মধ্যে। এর পর থেকে গতকালকের সংক্রমণ ছিল সবচেয়ে বেশি।

এ ব্যাপারে ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে। এটা ঢাকা ও ঢাকার পাশে নবাবগঞ্জেও পাওয়া গেছে। বর্তমানে ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি সংক্রমণ চলছে। এখনই বিপজ্জনক এই ভ্যারিয়েন্টটিকে ঠেকাতে না পারলে শিগগিরই দেশবাসীকে করোনার তৃতীয় ঢেউ দেখতে হতে পারে।
তিনি বলেন, কনট্যাক্ট ট্রেসিং এবং যেখানে বেশি সেখানকার এলাকাকে কঠোর লকডাউনের আওতায় এখনই আনতে হবে। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার লকডাউনের অঞ্চল বাড়িতে দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

করোনার চিকিৎসকেরা বলছেন, আগে করোনা যেসব ভ্যারিয়েন্টে মানুষ আক্রান্ত হতো তখন ভাইরাসটি শ্বাসনালী থেকে ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। তখন আক্রান্ত হওয়ার পর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে কিছুটা সময় পাওয়া যেত। ফলে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যেত। আগে লক্ষণ প্রকাশ পেতে কিছুটা দেরি হলেও বর্তমানের ভ্যারিয়েন্টে দ্রুত লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে এবং এখনকার ভ্যারিয়েন্টে সরাসরি রোগীর ফুসফুসকে সংক্রমিত করছে। রোগী খুব দ্রুত খারাপ অবস্থায় চলে যাচ্ছে।
ড. মেহেদী আকরাম বলেন, সংক্রমণের হার যেন না বাড়ে এবং তা যেন ঢাকামুখী না হয় সেজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি মনে করেন, এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে আবার স্বল্পমেয়াদে অথবা স্থানীয়ভাবে কঠোর লকডাউন দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কয়েক সপ্তাহ লকডাউনে থাকার পর লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। অন্য দিকে সাতক্ষীরায় লকডাউন কঠোর করা হয়েছে। নাটোরের নাটোর ও সিংড়া পৌরসভায় আজ বুধবার থেকে কঠোর লকডাউনের আওতায় যাচ্ছে।

সাতক্ষীরায় তৃতীয় দিনের মতো লকডাউন চলছে। সেখানকার প্রশাসন মানুষকে ঘরে ফেরানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাতক্ষীরায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১০৩ জনকে করোনা শনাক্ত করা হয়েছে বলে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা: হুসেইন শাফায়েত জানান। এ জেলায় করোনা সংক্রমণ নুমনার পরীক্ষার ৫৫ শতাংশ।
নাটোরে করোনা সংক্রমণ ৬৭ শতাংশ। এ কারণে নাটোর শহর ও সিংড়া পৌর এলাকায় সর্বাত্মক এবং কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
এই জেলাগুলো ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের অন্যান্য কয়েকটি জেলায় লকডাউন অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের ভারতে যোগাযোগটা বেশি আছে বলে সেখানকার মানুষের করোনা সংক্রমণ বেশি। সংক্রমণ কমিয়ে রাখার জন্য লকডাউনের বিকল্প নেই। তিনি ভারতের দিল্লির শহরের উদাহরণ টেনে বলেন, দিল্লিতে যেখানে দৈনিক ২৫ হাজার করোনা শনাক্ত হয়েছে সেখানে এখন সেই শনাক্তের পরিমাণ ৪০০-এর নিচে নেমে গেছে। মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করাটাই বড় কথা। সে জন্য লকডাউন একটি ভালো ব্যবস্থা।


রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ও উপসর্গে আরো আটজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে রাজশাহীর চারজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তিনজন ও পাবনার একজন রয়েছেন। হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রসহ (আইসিইউ) বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা: সাইফুল ফেরদৌস সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মৃত আটজনের মধ্যে তিনজন করোনা পজিটিভ রোগী ছিলেন। বাকি পাঁচজন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন।

এ দিকে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ায় রামেক হাসপাতালে দেখা দিয়েছে তীব্র বেড সঙ্কট। সঙ্কট মোকাবেলায় প্রতিটি করোনা ওয়ার্ডে এরই মধ্যে অতিরিক্ত বেড দেয়া হয়েছে। এর পরও বেড সঙ্কুলান না হওয়ায় অনেক রোগীকে মেঝেতে রাখা হচ্ছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেনের পাশাপাশি এসব রোগীকে সিলিন্ডারের মাধ্যমেও অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে তাও চাহিদার তুলনায় অনেক কম।

গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ২৫৭ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এদের মধ্যে আইসিইউতে রোগী ভর্তি আছেন ১৭ জন।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী সাংবাদিকদের জানান, পরীক্ষা ও শনাক্ত বিবেচনায় রাজশাহীতে বর্তমানে করোনা সংক্রমণের হার ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এ অবস্থায় হাসপাতালে প্রতিদিন করোনার রোগী বাড়ছেই। এতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। আর নতুনভাবে রামেক হাসপাতালে সংযুক্ত করা ১৫ জন চিকিৎসকের সবাই এখনো যোগদান করেননি। তারা সবাই কাজে যোগ দিলে করোনা রোগীদের চিকিৎসা অনেকটা স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
রাজশাহী সিভিল সার্জন ডা: কাইউম তালুকদার সাংবাদিকদের জানান, দৈবচয়ন পদ্ধতিতে করোনা টেস্টের রেজাল্ট তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া হচ্ছে। এসব বুথে সোমবার ২৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৮৪ জন পজিটিভ এসেছে। শতকরা হিসেবে শনাক্তের হার ১২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর আগে গত রোববার প্রথম দিন এর হার ছিল ৯ শতাংশ।

চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ১২৯ জনের। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে নগরের ৮৯ জন এবং উপজেলার ৪০ জন। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছেন ২ জন। গতকাল মঙ্গলবার সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামের ৯টি ল্যাবে ১ হাজার ৪৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে চবি ল্যাবে ১৫ জন, বিআইটিআইডি ল্যাবে ৩৩ জন, চমেক ল্যাবে ২৩ জন এবং সিভাসু ল্যাবে ২৪ জনের নমুনায় করোনাভাইরাসে শনাক্ত হয়েছে। এ ছাড়া শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিতে ১০ জন, মা ও শিশু হাসপাতাল ল্যাবে আটজন, জেনারেল হাসপাতালের রিজিওনাল টিবি রেফারেল ল্যাবরেটরিতে (আরটিআরএল) ছয়জন, মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালে তিনজনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। অন্য দিকে, কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ ল্যাবে চট্টগ্রামের ১০১টি নমুনা পরীক্ষা করে সাতজনের করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে।

বগুড়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুই নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন জয়পুরহাট জেলার বাসিন্দা শাহিদা (৬৮), গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার জোবেদা (৬০) এবং বগুড়া সদরের নজরুল ইসলাম (৬৯)। তারা সবাই সোমবার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭৮ নমুনার ফলাফলে নতুন করে ২৫ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন। আক্রান্তের হার ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বগুড়া স্বাস্থ্য বিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]