আব্দুল্লাহ-আল-মুজাহিদ:
২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী সকল বড় বড় কর্পোরেশনের ম্যানেজারদের এক সম্মেলনে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হিউলেট-প্যাকারড (বর্তমানে এইচ পি) তৎকালীন প্রধান এক্সিকিউটিভ, মিস কারলিটন ফিওরিনা বলেন,"প্রযুক্তি শিল্প আরবীয় গণিতবিদদের অবদান ছাড়া আজকের মতো বিকশিত হতো না । ‘বিবিসিটু’তে এডাম হার্ট ডেভিসের টিভি সিরিজ "হোয়াট দি এইনশ্যান্ট ডিড ফর আস" শিরোনামের একটা সম্পূর্ণ পর্ব ছিল" হোয়াট দ্যা ইসলামিক ওয়ার্ল্ড ডিড ফর আস"; সেখানে খুবই আবেগীয়ভাবে বিশ্বে মুসলমানদের অবদানকে স্মরণ করা হয়েছিল। ম্যাঞ্চচেষ্টার ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এ্যান্ড টেকনোলজিতে ১৯৭৫ সালে লর্ড বিভি বাউডেনের উদ্যগে মুসলিমদের অবদানের উপর গবেষণা শুরুর কথা ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় আবারো প্রফেসর ডোনাল্ট কার্ডওয়েল এর উৎসাহে সেলিম টি এস আল হাসানির সম্পাদনায় প্রযুক্তি বিষয়ক বিখ্যাত এক প্রকল্প "ওয়ান থাউজ্যান্ড ওয়ান ইনভেনশনজঃ ডিসকভার দ্যা মুসলিম হ্যারিটেজ ইন আওয়ার ওয়াল্ড” নামক গবেষণামূলক সচিত্র শিক্ষামূলক বইয়ের কাজ শুরু হয় এবং তা যথা সময়ে প্রকাশ হয়। এই প্রকল্পে মুসলামানদের দ্বারা সপ্তম থেকে সতেরো দশ শতাব্দীতে ঘটা বিজ্ঞানীদের ১০০১ আবিষ্কারসমূহকে সাত অধ্যায়ে বিভক্ত করে বিশ্বের দরবারে তুলে আনা হয়েছে। ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ইতিবাচক ও গঠনমূলক ব্যবহার কিভাবে সভ্যতাকে পাল্টে দিতে পারে তার এক বড় উদাহরণ এই প্রকাশনা। বইটি প্রকাশ পাওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়। এখন অন্যান্য ভাষায় অনুবাদের চেষ্টা হচ্ছে। সবচেয়ে মোদ্দাকথা হল, মুসলিমরা তখন নিত্য নতুন এই রকম আবিস্কার কর্মের মাধ্যমে ধর্মের প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন।

কফি থেকে শুরু করে শল্যছুরি ও মানমন্দির, নগর ব্যবস্থাপনা, বায়ুকল, বাঁধ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ধারণা, কাঁচ শিল্প ও হাসপাতাল স্থাপন, রসায়ন শিল্প ইত্যাদির ধারণা ও আবিষ্কার মুসলমানদে দক্ষ নেতৃত্ব ও কোরআনের উদ্দীপনায় সম্ভব হয়।
ইবনে আল হাইথামের আলোকশাস্ত্রের অবদান অনন্য। ‘আমরা কিভাবে দেখি’ তিনি তার সূত্র আবিষ্কার করেন। তাই, তিনি দৃষ্টি ও ক্যামেরা আবিষ্কারের গুরু। আব্বাস ইবনে ফিরনাসের উড়বার চেষ্টার কথা- বেকনের বইয়ের মধ্য উল্লেখ আছে যা রাইট ব্রাদার্সের (১৯০৩) বহু পুর্বের ঘটনা। তিনি কর্ডোভায় পড়ালেখা করেছেন আর আব্বাস ছিল সেখানকার অধিবাসী।
দক্ষিণ-পশ্চিম তুরস্কের ১৩শ শতাব্দীর একজন ইঞ্জিনিয়ার আল জাহরি প্রথম স্বয়ংক্রিয় মেশিনের ধারণা দেন। তিনি যান্ত্রিক বিষয়ের উপর চমৎকার বই লিখেন' দ্যা বুক অফ নলেজ অফ ইঞ্জিনিয়াস’স মেকানিকাল ডিভাইস'। খারেজমির উত্তরসুরি মুসলিম গণিতবিদদের হাতে তার আবিষ্কৃত অ্যালজেবরা জ্যামিতিক কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে পাঠিগণিত ভিত্তিক আধুনিক অ্যালজেবরার ভিত্তি স্থাপিত হয় । তারা ০ এবং ১ এ-র তাৎপর্য নিয়ে গবেষণা করে আল্লাহর গুণবাচক ৯৯ নাম নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন। এই ০ ও ১ এখন কম্পিউটারের ভাষা। দক্ষিণ স্পেনে ১০০০ বছর আগে আবুল কাসেম খালিলি ইবনে আল আব্বাস আল জাওয়াহারি রক্তনালি, সাধারণ ও অস্থির অপারেশন সম্পর্ণ করতে পেরেছিলেন। তিনি প্রায় ২০০ শল্যচিকিৎসার যন্ত্রও তৈরি করেন। মুসলমানদের দ্বারা আবিষ্কৃত ‘আস্ট্রোলব’ যন্ত্রটি নিখুঁত ছিল। আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিদ ড. উইলিয়াম একদম একে নির্ভুল বলেছেন। আল মাওজিলি এক হাজার বছর পূর্বে , ছানি অপারেশন করার যে ফাঁকা সূচ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন; তা এ-ই একাবিংশ শতাব্দীতে এসেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
কোরআনের প্রথম বাণী ‘পড়’ এবং তারপরে অনেক জায়গায় 'তাদাব্বুর ও তাফাক্কুর" এ-র কথা গুরুত্বের সাথে বলা আছে এবং তার আলোকে জ্ঞানের যে অনুসন্ধান ও কৌতূহল সৃষ্টি হয়; তাই, এই আবিষ্কারের শক্তি। আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভি বলেন, এই শব্দগুলো কোরআনে যে অর্থে ব্যবহার হয়েছে তাকে সম্পূর্ণভাবে অনুবাদ করা যায় না; গভীর ধ্যান ( contemplatation) দ্বারা প্রকাশ হয় মাত্র; আসলে, এর অর্থ আরো গভীরে। প্রত্যেক মুসলিমদের আজ মানবের কল্যাণের জন্য আবিষ্কারের চেতনায় আলোড়িত হতে হবে কোরআনের উদ্দীপনা থেকে উৎসাহ নিয়ে, তখন আমাদের শান্তির ধর্ম আরো সার্থক হয়ে উঠবে।
এসকে