7392

04/23/2024 প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বুয়েট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বুয়েট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

রাজটাইমস ডেস্ক

২২ নভেম্বর ২০২১ ১০:২০

রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের তদন্তে নাম আসা বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে নিখিল রঞ্জন ধরকে।

রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভিসি সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন ফাসের অভিযোগ ওঠায় তাকে (নিখিল রঞ্জন ধর) বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

‘পাশাপাশি এ বিষয়ে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধরকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র কল্যাণ পরিচালক (ডি এস ডব্লিউ) অধ্যাপক মিজানুর রহমান।

মিজানুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু উনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ এসেছে তাই সেটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তাকে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বিভাগীয় প্রধানরা আমাদের ভর্তি কমিটির সদস্য থাকেন। তাই উনাকে সেখানে থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’

এই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য কোন সভা হয়েছে কী না জানতে চাইল তিনি বলেন, ‘এটির জন্য সভা করা লাগে না। ভিসি মহোদয় নিজেই এটি করতে পারেন। সিদ্ধান্তের বিষয়ে অফিসিয়াল অর্ডার অভিযুক্ত শিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে যেহেতু উনাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে সুতরাং এই পদে বিভাগের আরেকজন শিক্ষক ফেরদৌস সারওয়ারকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসছে একের পর এক জড়িতদের নাম।

প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট থাকা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি আহ্‌ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে কর্মরত একাধিক ব্যক্তির সম্পৃক্ততা মিলেছে। পরে প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধরের বিরুদ্ধে।

নিখিল রঞ্জন বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ছাপাখানায় প্রশ্নপত্র ছাপা হওয়ার পর তিনি একটি বা দুটি সেট নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। তবে এই প্রশ্নপত্র ব্যাগে নিয়ে কী করতেন, সেটি এখনও জানা যায়নি।

প্রশ্নপত্র ছাপাখানা থেকে নিয়ে নিখিল কোনো পরীক্ষার্থীকে দিতেন কি না, সেটি যাচাই করছে তদন্তকারী সংস্থা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ।

শুক্রবার ডিবির তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে আমরা অনেকের নামই পাচ্ছি। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনায় তাদের কী ভূমিকা থাকত, সেটি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটিকে জানাব।’

তিনি বলেন, ‘কমিটির বক্তব্য ও আমাদের তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’ ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র নিজের ব্যাগে নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর।

তিনি দাবি করেছেন, চেক করার পর ওই প্রশ্নের সেটগুলো তিনি ময়লার স্তূপে ফেলে আসতেন। ওই ময়লার স্তূপ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন আহসানউল্লা ইউনিভার্সিটির লোকজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় ৬ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এক হাজার ৫১১টি পদের বিপরীতে এই পরীক্ষায় অংশ নেন এক লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন।

পরীক্ষা শেষে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তোলেন পরীক্ষার্থীরা। ডিবির তেজগাঁও বিভাগ বিষয়টি তদন্তে নেমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পায়।

পরীক্ষার দিন ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পুলিশ পাঁচজনকে আটক করে। তারা হলেন মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন।

১১ নভেম্বর আরও তিনজনকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ। তারা হলেন এমদাদুল হক খোকন, সোহেল রানা ও ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী এবি জাহিদ।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৭ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে আহ্‌ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির অফিস অ্যাটেনডেন্ট দেলোয়ার হোসেন ও আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের কাটিংম্যান রবিউলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আহসান উল্লাহর ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পারভেজ মিয়াকে। আদালতে জবানবন্দি দেয়ার পর তাদের তিনজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।

তদন্ত সংস্থা ডিবি জানিয়েছে, দেলোয়ার হোসেন ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আহসানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার কাজী শফিকুল ইসলামের অফিসে পিওন হিসেবে চাকরি করতেন। কয়েক মাস পর জানতে পারেন, ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা ও পরীক্ষার টেন্ডার পায় আহসানউল্লা। যেহেতু ট্রেজারার পরীক্ষা কমিটিতে থাকতেন, সেহেতু তাকে প্রশ্ন ছাপার বিভিন্ন কাজে নেয়া হতো।

ডিবি জানিয়েছে, এ কাজে নিয়মিত আশুলিয়ায় আহসানিয়া মিশনের নিজস্ব ছাপাখানায় যেতেন দেলোয়ার। সেখানে নজরদারি ও নিরাপত্তার অভাব ছিল। সেই সুযোগে দেলোয়ার লুকিয়ে প্রশ্ন নিয়ে বের হতেন।

বাহিনীটি বলছে, দেলোয়ার জিজ্ঞাসাবাদে তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অল্প টাকায় পরীক্ষার টেন্ডারগুলো আনতেন বুয়েটের শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর। তিনিই সব কাজ করতেন এবং সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিবার প্রশ্ন ছাপার পর দুই সেট প্রশ্ন তিনি ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতেন। তিনি নিজেও অনেকবার নিখিলের ব্যাগে প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কোনো প্রশ্ন বা শব্দ করলে দেলোয়ারের চাকরি খা্ওয়ার হুমকি দিতেন নিখিল ধর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর বলেন, ‘আমি বলি শোনেন, কোশ্চেন প্রিন্ট হওয়ার পর সেগুলো চেক করে কোথায় রাখব দুইটা প্রশ্ন? তখন সেগুলো ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে আসার সময় ওয়েস্টেজে ফেলে আসি। আমি বুয়েটের শিক্ষক, আমি কেন প্রশ্ন নিয়ে আসব?’

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করে আহ্‌ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। এ কাজে বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে আপনি কীভাবে জড়িত এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ওরা টেকনিক্যাল সাপোর্ট চায়, আমি তখন যাই। সিট ও সেন্টার অ্যারেজমেন্টটা আমি করে দেই।’

নিখিল বলেন, ‘উনারা পরীক্ষাটা নেয়ার জন্য কন্ট্যাক্ট করত। আমার কাছে হেল্প চাইত, আমি হেল্প করতাম। এখন সবই টেন্ডার। আমার কাছে হেল্প চায়, আমি হেল্প করেছি। সবকিছু উনারাই করেন।’

‘পরীক্ষার চারদিন আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে প্রেসের কাটিংম্যান’

ডিবি পুলিশকে দেলোয়ার জানিয়েছেন, তাকে এই কাজে লোভ দেখান আহ্‌ছানউল্লার টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান এবং ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়া। তাদের অনুরোধে তিনি কমপক্ষে চার-পাঁচটি পরীক্ষার প্রিলি ও রিটেনের প্রশ্ন এনে দিয়েছেন। প্রতিবার তারা দেলোয়ারকে ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন।

ডিবিকে তিনি জানিয়েছেন, এদের সঙ্গে শ্যামল নামে একজন ছিল। এছাড়াও তিনি আহ্‌ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলডিসি হারুনুর রশিদ এবং তার ভগ্নিপতি মুবিন উদ্দিনকেও প্রশ্ন এনে দিয়েছেন। সর্বশেষ পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্ন ছাপার কাজে তাকে রাখা হয়নি।

দেলোয়ার ডিবিকে জানিয়েছেন, তবে মুক্তার ও পারভেজ খুব অনুরোধ করায় তিনি প্রেসের কাটিংম্যান রবিউলকে ডেকে আনেন। রবিউলের সঙ্গে পারভেজ এবং মুক্তারের এক লাখ টাকায় চুক্তি হয়। রবিউল বৃহস্পতিবার চক্রের সদস্যদের প্রশ্ন এনে দেন।

ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল জানান, তিনি আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনসের কাটিংম্যান। তার হাতের আঙ্গুলের আঁচিলের জন্য আহ্‌ছানউল্লা ইউনিভার্সিটির সহকারী দেলোয়ারের কাছে ওষুধ চেয়েছিলেন। ওষুধ দেয়ার কথা বলে দেলোয়ার তাকে ফোন করে কামারপাড়া গিয়ে মুক্তার ও পারভেজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ওইদিন মুক্তার ও পারভেজ তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পাঁচটি ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ পদে চাকরির জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রস্তাব দেন।

ডিবিকে রবিউল জানান, মুক্তার পারভেজকে তার ছোট ভাই বলে পরিচয় দেন। মুক্তার পারভেজের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। মুক্তার তাকে জানান, আহছানিয়া প্রেসে এমসিকিউ প্রশ্ন ছাপা হবে আশুলিয়ায়।

ডিবিকে রবিউল জানান, কাজটি তিনি করবেন না বললে মুক্তার ও পারভেজ তার হাতপা ধরে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে রাজি করায়। ২ নভেম্বর প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপা হয়। ওইদিন প্রশ্নটি রবিউল লুকিয়ে রাখেন। দুই দিন পর ৪ নভেম্বর বিকেলে নবীনগর স্মৃতিসৌধের পাশে মুক্তারের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন রবিউল।

পারভেজ মিয়া জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি এবং মুক্তার মিলে দেলোয়ারের সঙ্গে কথা বলে প্রেসের রবিউলের সাথে এক সপ্তাহ আগে দেখা করেন। ৪ নভেম্বর নবীনগর স্মৃতিসৌধের পাশ থেকে মুক্তার এবং পারভেজ রবিউলের কাছ থেকে পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র নিয়ে আসেন।

 

 

সূত্র: নয়া দিগন্ত

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]