8293

04/29/2024 ইতিহাসের করুণ নিয়তি : কাশিমপুরের প্রতাপ জমিদার বাড়ি এখন গোয়ালঘর

ইতিহাসের করুণ নিয়তি : কাশিমপুরের প্রতাপ জমিদার বাড়ি এখন গোয়ালঘর

মহিব্বুল আরেফিন

১৯ জানুয়ারী ২০২২ ০২:৩৯

‘উপরে এক ভগবান আর নিচে আমি আরেক ভগবান’, ‘তোদের ভগবান বলতে আমিই। আমি যা বলবো তোদের তাই করতে হবে। আমার হুকুমই শিরোধার্য।”---এভাবেই নাকি প্রজাদের বলতেন কুষ্টিয়ার প্রতাপশালী জমিদার ভগবানচন্দ্র শাহ্। কথাগুলো রূপকথার মতো শোনালেও তৎকালীন সময়ে অধিকাংশ জমিদারদের দাম্ভিকতা আর প্রজাদের উপর অত্যাচারের ছিলো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। এসময় জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে মাথা উঁচু করে চলার সাহস ছিলো না কারোই। তবে ১৯৫০ সালের আগষ্ট মাসে প্রায় ২’শ বছরের জমিদারী প্রথা থেকে বাংলার মানুষ মুক্তি পেলেও আনাচে কানাচে থেকে যায় জমিদারী রাজ-রেওয়াজ। কিন্তু কালের বিবর্তনে রাজ-রেওয়াজও বিলুপ্তি হয়ে নীরব স্বাক্ষী হয়ে বিভিন্ স্থানে দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংশপ্রাপ্ত জমিদার বাড়ি। তেমনি এক জমিদার বাড়ি রাজশাহী বিভাগের কাশিমপুর জমিদার বাড়ি।

স্থানীয়ভাবে এটি রাজবাড়ি বা পাগলা রাজার বাড়ি নামেও পরিচিত। এখন ধ্বংশপ্রাপ্ত বাড়িতে নেই কোন জমিদারির আস্ফালন। এক সময়ের প্রতাপ এই জমিদার বাড়িটি এখন শুধুই গোয়ালঘর। রাজশাহী বিভাগের অন্যতম একটি জেলা শহর নওগাঁ। আর জেলাটির রাণীনগর উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ছোট যমুনা নদীর তীরেই কাশিমপুর ইউনিয়নে প্রাচীন এই জমিদার বা রাজবাড়িটির অবস্থান। গ্রামটির নামও কাশিমপুর। বর্তমানে জমিদার বাড়িটি যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংশপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র প্রধান ফটকের কিছু অংশ আর ভগ্নপ্রায় মন্দির দাঁড়িয়ে আছে।

 ইতিহাসের করুণ নিয়তি : প্রতাপ রাজবাড়িটি এখন গোয়ালঘর হিসেবে ব্যবহৃত

জমিদারী প্রাথার নেপথ্য কাহিনী
‘মীরজাফর শব্দটি যেমন বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক, রাজাকার শব্দটি যেমন দালাল এর সমার্থক, তেমনি জমিদার শব্দটিও অত্যাচারের সমার্থক শব্দ’। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেই শব্দগুলো এই ব্যাবহারিক অর্থে পৌঁছেছে। ১৭৮০ থেকে ১৮২৩ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাংলায় চাকরিরত হ্যাংরিংটন জমিদারের সংজ্ঞায় বলেন, ‘এদেশের জমিদাররা এমন একশ্রেণীর জীব যাদের এককথায় প্রকাশের জন্য ইংরেজি ভাষায় কোন শব্দ নেই।’ তবে সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ইডিয়ট, নির্বোধ, উচ্ছৃঙ্খল, অমিতব্যায়ী, স্বেচ্ছাচারী, ডাকাত পোষক ও নিষ্ঠুর এগুলো হলো জমিদারদের বিশেষণ।’

মুাঘোলদের সময় বা তার পূর্ববর্তী শাসনামলেও বাংলায় প্রচলিত কোনো জমিদার ছিল না। যারা জমিদার হিসেবে পরিচিত পেতেন তারা ছিলেন রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির খাজনা আদায়ের কর্মচারী। জমির উপর তাদের কোনো দখলি স্বত্ত্ব ছিল না। সরকারের রাজস্ব আদায়ের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতো, যার কোন মধ্যস্বত্বভোগী ছিল না। আর জমির সত্যিকার মালিক ছিলেন কৃষক। কিন্তু ইংরেজ শাসনের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও যাচ্ছেতাইভাবে খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ও, যখন বাংলার তিনভাগের একভাগ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায় তখনও ইংরেজরা পূর্ববর্তী বছরগুলোর চেয়ে বেশি খাজনা জোরপূর্বক আদায় করতো। আর খাজনা ঠিকভাবে পরিশোধ করতে না পারলে কৃষকদের প্রতি কি রকম অত্যাচার করা হতো তার একটি তালিকা সে সময় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

জমিদারদের নিপীড়ন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী গবেষক বিনয় ঘোষ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা বইতে জমিদারদের ১৮ দফা নির্যাতনের তালিকা উল্লেখ করেন। যার মধ্যে ছিলো- ১. দণ্ডাঘাত ও বেত্রাঘাত, ২. চর্মপাদুকা প্রহার, ৩. বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন, ৪. খাপরা দিয়ে কর্ণ ও নাসিকা মর্দন, ৫. ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ, ৬. পিঠে দুহাত মোড়া দিয়ে বেঁধে বংশ দিয়ে মোচড়া দেওয়া, ৭. গায়ে বিছুটি দেওয়া, ৮. হাত পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা, ৯. কান ধরে দৌড় করানো, ১০. কাঁটা দিয়ে হাত দলন। দুখানা কাঠের বাখারির একদিকে বেধে তার মধ্যে হাত রেখে মর্দন করা ( এ যন্ত্রটির নাম কাঁটা), ১১. গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদে ইটের উপর পা ফাঁক করে দুহাত ইট দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, ১২. প্রবল শীতের সময় জলে চুবানো,
১৩. গোনীবদ্ধ করে জলমগ্ন করা, ১৪. গাছে বা অন্যত্র বেধে টানা দেওয়া, ১৫. ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে ধানের গোলায় পুরে রাখা, ১৬. চুনের ঘরে বন্ধ করে রাখা, ১৭. কারারুদ্ধ করে উপবাসী রাখা, ১৮. ঘরের মধ্যে বন্ধ করে লঙ্কা মরিচের ধোঁয়া দেওয়া উল্লেখযোগ্য।
জমিদারি নিপীড়নের বিষয়ে মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আহমেদ কামাল বলেন,‘ ঐতিহ্যগতভাবে মুসলমান কৃষকগণ যে সুপরিচিত দমন-পীড়নের শিকার হতো, তা ছিল শ্রেণীগত এবং জাতিগত বা ধর্মীয় উভয়ই। মহাজন এবং জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। ১৯৪৭ সালে বাংলায় ২২৩৭টি বড় জমিদারির মধ্যে ৩৫৮টি ছিল মুসলমান জমিদারি। মহাজনদের অধিকাংশই জাতিতে ছিলেন বণিক ও তেলি, যারা খাতক মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিপীড়নকারী বলে গণ্য হতেন। এরা ছিলেন ঋণ গ্রহণকারী মোট কৃষকগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশ। সুদের হার ছিল কম-বেশি ১২ থেকে ২৮০ শতাংশ, কখনো কখনো তারও বেশি।'' অবর্ণনীয় নির্যাতন আর নিপিড়নের পরে ১৯৫০ সালের আগষ্ট মাসে জমিদাররের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বাংলার জনগণের ভাগ্যকাশে নতুন সূর্য উদয় হয়।

ভুমি দখল আর লুটতরাজে নিশ্চিহ্ন কাশিমপুর রাজবাড়ি। অবশিষ্ট ইমারতের অংশটিও সংস্কার-সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত প্রায় ।

কাশিমপুর জমিদার বাড়ির ইতিহাস
কথিত আছে, নাটোরের রাজার উত্তরসূরি কাশিমপুরের পাগলা রাজা রাজবাড়িটি নির্মাণ করেন। নওগাঁ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার শাসনকাজ পরিচালনা করার জন্যই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। এ অঞ্চলে রাজার শাসনকাল কখন থেকে শুরু হয় তার তারিখ জানা যায়না। তবে অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ী বাহাদুর এই অঞ্চলের শেষ রাজা ছিলেন এবং তার চার ছেলে ও একজন মেয়ে ছিল এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। অন্যত্র শেষ রাজার নাম আনামী প্রাসাদ রায় চৌধুরী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কিছুকাল পরে, রাজবংশের প্রায় সবাই দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তবে ছোট রাজা শক্তি প্রসন্ন লাহিড়ী ও তার পরিবার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই রাজবাড়িতে বসবাস করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনিও রাজবাড়ি ছেড়ে ভারত চলে যান।

স্থাপত্য
তথ্য উপাত্ব থেকে জানা যায়, রাজবাড়িটি প্রায় ২ একর ১৯ শতক এলাকা জুড়ে অবস্থিত। রাজবাড়ির মূল ভবনের মাঝখানে চারটি গম্বুজ বিশিষ্ট একটি দুর্গা মন্দির ছিল। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে চুন, সুড়কি ও পোড়ামাটির ইট দিয়ে শিব, রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল মন্দির নির্মিত। রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটি অন্যান্য মন্দিরগুলোর চেয়ে বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট ছিল। দুর্গা মন্দিরের একপাশে রাজার বৈঠকখানা ছিল। মূল ভবনের পাশে একটি হাওয়াখানা ছিল। পুকুরপাড় ও নদীর ধারে কাঁচের ঘরের তৈরি একটি বালিকা বিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে প্রাচীন রাজবাড়িটির কারুকার্যগুলো প্রায় ধ্বংশ হয়ে গেছে। রাজবাড়ির কিছু অংশ কাশিমপুর ইউনিয়নের ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয় আর মন্দিরগুলোতে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ পূজাঅর্চনা ও বসবাস করেন।

বর্তমান অবস্থা
কশিমপুর রাজার শতাধীক বিঘা জমি ও পুকুর স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্ন কায়দা-কৌশলে দখলে রেখেছেন স্থানীয়দের অভিযোগ। রাজবাড়ির বেশির ভাগ জায়গা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বিভিন্ন পন্থায় উপজেলা ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে লিজ নিয়ে চাতাল তৈরি করে ব্যবসা করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া উঁচু জমি কেটে সমতল করে ধান চাষ করা হচ্ছে। যথযথ পদক্ষেপ না থাকার কারণে রাজবাড়ি ও রাজার সম্পদ থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

সম্ভাবনা
কাশিমপুর রাজবাড়ি এবং তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ যথাযথভাবে সংস্কার আর সংরক্ষণ করে এলাকাটি ঘিরে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র। পাশপাশি সকল জমি পুনোরদ্ধার করে স্বচ্ছ প্রকৃয়াতে লিজ দেয়া হলে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করা সম্ভব।

স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য
কাশিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান বাবু গণমাধ্যম কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, সংরক্ষণের অভাবে রাজবাড়িটি আজ মৃতপ্রায়। যতটুকু নির্মাণশৈলী কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা যদি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করে তাহলে এখানেও গড়ে উঠতে পারে দর্শনীয় স্থান।
এক সময়ের নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার মাহাতো গণমাধ্যম কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেন, স্থানীয়ভাবে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এসব নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব পালন করে থাকে। আমি রাজবাড়ির অবশিষ্ট এ নিদর্শন রক্ষা করার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে লিখিতভাবে জানাবো। আর নতুন করে কাউকে জায়গা লিজ দেওয়া হবে না। যে সব জায়গা লিজ দেওয়া আছে, তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।

 

 


 




 





 

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]