8685

03/28/2024 আর কীসের দাম বাড়বে?

আর কীসের দাম বাড়বে?

রাজটাইমস ডেস্ক

১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৮:০৯

আমীন আল রশীদ: ওয়াসার আলোচিত (সমালোচিতও বটে) এমডি তাকসিম এ খান পানির দাম বাড়ানোর প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ভিক্ষা করে সরকারি সংস্থা চলতে পারে না।’ ঢাকা শহরে পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়াসা পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়াতে চায় বলে গণমাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার ব্যাখ্যায় সংস্থার এমডি বলেছেন, বর্তমানে প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ১০ টাকা। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনও সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। তবে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টিকে তিনি ‘উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বাজারমূল্যের সমন্বয়’ বলে উল্লেখ করেন। প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির মধ্যে গত দুই বছরে দুইবার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

গত বছরের ১৮ জুন প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম: ‘পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পানির দাম ও এমডির বেতন।’ খবরে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার পানি সংকট নিয়ে নগরবাসীর নানা অভিযোগ থাকলেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পানির দাম এবং ওয়াসার এমডির বেতন। সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যে একলাফে ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানো হয়েছে পৌনে ২ লাখ টাকা। এই বৃদ্ধির পর ওয়াসার এমডি হিসেবে তার মাসিক বেতন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। এ হিসাবে গত ১২ বছরে তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। প্রশ্ন হলো, ভিক্ষা করে যে সংস্থা চলে, তার এমডির বেতন সোয়া ছয় লাখ টাকা হয় কী করে? উপরন্তু দেশের আর কোনও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ১৩ বছরে ১৪ বার পণ্য/সার্ভিসের দাম বাড়ানোর কি নজির আছে? বিশ্বের আর কোনও দেশে এমন নজির আছে?

তবে শুধু ওয়াসা নয়, সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানোরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পেট্রোবাংলাসহ তিতাস, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে তারা গ্যাসের খুচরা মূল্য প্রায় ১১৭ শতাংশ বা দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। যেখানে রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যদিও কমিশন এটি ফেরত পাঠিয়েছে। ফেরত পাঠানোর অর্থ এই নয় যে দাম বাড়বে না। বরং নতুন করে প্রস্তাব যাবে এবং তার ওপর শুনানি হবে।

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, শুনানিতে দরকষাকষি ও বিতর্কে কোম্পানিগুলো কিছুটা নমনীয় হলেও শেষ পর্যন্ত দাম ঠিকই বাড়ে। বিপরীতে ভোক্তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, বিশেষ করে রাজধানীতে যারা পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহার করেন, তারা বেশ কিছু দিন ধরেই গ্যাস সংকটে ভুগছেন। অধিকাংশ এলাকাতেই সকাল ১০টার পরে গ্যাসের চাপ থাকে না। ফলে এই শীতের মৌসুমে একদিকে রান্না করা, খাবার গরম করা এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজে পানি গরম করা ব্যাহত হচ্ছে। অর্থাৎ রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য ভোক্তারা পর্যাপ্ত গ্যাস পাবে না, অথচ মাসে মাসে বিল দিতে হবে। সেবার মান কমিয়ে পণ্যের দাম বাড়ানো হয় কী করে?

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, গ্রাহক অসন্তোষ যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কাজ চলছে। জ্বালানির অপচয় কমাতে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অব্যাহত রাখার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কত টাকা পর্যন্ত বাড়ালে গ্রাহক অসন্তোষ হবে না? দুই চুলা গ্যাসের বিল যখন ৯৭৫ টাকা করা হলো, তখন গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হয়নি? এখন বিভিন্ন কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর শুনানি করে যদি দুই চুলা গ্যাসের মাসিক বিল ১২শ’ বা ১৫শ’ টাকাও করা হয়, সেটি কি অসংখ্য মানুষের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে না? এটি কি গ্রাহকদের অসন্তোষের কারণ হবে না?

কিছু দিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামে। ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজির দাম রাজধানীর বড় বাজারগুলোতেও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। যার মূল কারণ বলা হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া। এরমধ্যে এখন যদি আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, সেটি নতুন সংকট তৈরি করবে নানা খাতে। বিশেষ করে গ্যাসের দাম বাড়ালে একই যুক্তিতে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস।

সয়াবিন তেলের দাম মোটামুটি প্রতি মাসেই বাড়ছে। সরকার বলছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা এবং বোতলজাত লিটারে আরও ৮ টাকা বেড়েছে। এছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত তেলে ৩৫ টাকা এবং পাম তেলে ১৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এ দাম কার্যকর হয়েছে।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৯ অক্টোবর সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৩৬ টাকা নির্ধারিত ছিল। বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৭৬০ ও পাম তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১১৮ টাকা। নতুন দাম অনুযায়ী, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ৮ টাকা বেড়ে ১৬৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৭ টাকা বেড়ে ১৪৩ টাকা, বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৩৫ টাকা বেড়ে ৭৯৫ ও পাম তেলের দাম ১৫ টাকা বেড়ে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাস্তবতা হলো, করোনোর দীর্ঘ প্রকোপে যখন অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন, বেকার হয়েছেন, অসংখ্য মানুষের আয় কমে গেছে, সেই সময়ে নতুন করে গ্যাস-পানি ও তেলের দাম বাড়ানো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। একদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, আয় কমেছে, অন্যদিকে দাম বাড়ানোর এই খেলা। রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক মানুষ যখন আর্থিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি কোনোভাবেই জনবান্ধব নীতি হতে পারে না। বরং করোনার কারণে চলমান লকডাউনের সময় অনেক বাড়িওয়ালাকে দেখা গেছে বাসা ভাড়া কমিয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায় থেকে যখন এরকম মানবিক উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়, তখন রাষ্ট্র কী করে মানুষের বিপদের মুহূর্তে দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে বেশি জরুরি পানি ও জ্বালানির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়? রাষ্ট্রকে তো আরও বেশি মানবিক হতে হয়। সুতরাং অতিমারির বাস্তবতায় গ্যাস-পানি-তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো নয়, বরং কমানো উচিত।

ওয়াসার এমডির বেতন বাড়ানোর পেছনে মূল্যস্ফীতির বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি হলে তার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে যে সাধারণ মানুষের জীবনে, পণ্য বা সেবার দাম বাড়ানো হলে সেই প্রভাব যে আরও বাড়ে, সেটি নীতিনির্ধারকদের না বোঝার কথা নয়। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির যুক্তিতে কর্তারা নিজেদের বেতন বাড়াবেন, অথচ করোনার মতো অতিমারির দীর্ঘ আঘাতে যে সাধারণ মানুষ নাজেহাল, তাদের মাথায় একের পর এক বাড়তি বিলের বোঝা চাপানো হবে। কারণ, নীতিনির্ধারকরাও জানেন, ডিজেল-ভোজ্যতেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ানো হলেও তাতে আমজনতার খুব বেশি কিছু করার নেই। কয়েক দিন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হবে; টেলিভিশনের টকশোতে কিছু লোক হৈ চৈ করবেন; সোশাল মিডিয়ায় লোকেরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাবেন, তারপর নতুন ইস্যু এলে তারা জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি ভুলে যাবেন। তারা হয়তো তখন শিল্পী সমিতির নির্বাচনে জায়েদ খান ও নিপুণের ইঁদুর-বিড়াল খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।

উপসংহার:

সবকিছুর দামই বাড়ছে। তবে এর বিপরীতে কিছুই কি কমছে না? কমছে। মানুষের আত্মসম্মানবোধ কমছে (তেলবাজি বেড়েছে); সহনশীলতা ও ধৈর্য কমছে (সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই বোঝা যায়); মানুষের প্রতি মানুষের, প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সংবেদনশীলতা কমছে; সহমর্মিতা কমছে; পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব কমছে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

( লেখাটি ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ এর বাংলা ট্রিবিউন অনলাইন হতে সংগৃহীত)

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]