তুরাগ তীরে কয়লা সাম্রাজ্য, নিয়ন্ত্রণে ডিপজল

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:১৯; আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৫৬

ছবি: সংগৃহীত

এলাকাটির নাম ডিপজলনগর। বাংলা সিনেমার বহুল আলোচিত খল অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজলের নামে এই নামকরণ করেছেন ওই এলাকাজুড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কয়লার কারবারিরা। রাজধানীর গাবতলী থেকে বেড়িবাঁধ ধরে মোহাম্মদপুরের দিকে কিছুটা এগোলেই এই নগরের অবস্থান। যত দূর চোখ যায়, সারি সারি কয়লার ডিপো। এগুলো তৈরি করতে দখল করা হয়েছে সিটি করপোরেশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং তুরাগ নদের বিস্তীর্ণ এলাকা। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দখল করে ফেলা হয়েছে নদীর দুই তীর। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে তুরাগের নাব্য। খরব দৈনিক কালবেলা।

সরেজমিন জানা গেছে, এই কয়লা সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক স্থানীয়ভাবে ‘জমিদার’ হিসেবে পরিচিত মনোয়ার হোসেন ডিপজল। মাসিক কিংবা বার্ষিক চুক্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারি সংস্থার এসব জমি ভাড়া দেন তিনি। দ্বীপনগর বা ডিপজলনগর হিসেবে পরিচিত এলাকাটিতে শুধু কয়লা গদির জন্য প্রতি স্কয়ার ফুট ২৫ টাকা হিসেবে ভাড়া দিয়ে বছরে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা আদায় করেন এই খলনায়ক। বিনিময়ে অনুমোদনহীন এই অবৈধ কয়লা ব্যবসা চালিয়ে যেতে ব্যবসায়ীদের সব ধরনের সহায়তা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। একাধিক ব্যবসায়ী বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গাবতলীর বেড়িবাঁধ সড়কের পাশের জায়গাটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের থেকে ১৯৮৯ সালে ব্যবহারের জন্য নিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে তুরাগ নদের তীরের জায়গাটি বিআইডব্লিউটিএর। আর কয়েক কিলোমিটারজুড়ে দুই সরকারি সংস্থার জায়গা ভাড়া দিয়ে এই কয়লা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন ডিপজল। অবশ্য দুটি জায়গার মধ্যে ডিপজলের ব্যক্তিগত মালিকানার কিছু জমি আছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীর।

তাদের তথ্য মতে, কয়লাকে কেন্দ্র করে ডিপজলনগর এবং আশপাশের এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়। প্রতি মাসে যা দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকায়। তবে এই ব্যবসা পুরোদমে চলে ছয় মাস। বর্ষাকালে এতে কিছুটা ভাটা পড়ে। তার পরও বছরে এখানে কম-বেশি ৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, অর্থের বিনিময়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ তদারকির দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার। ফলে প্রকাশ্যে চলছে অনুমোদনহীন কয়লার রমরমা ব্যবসা। কালবেলার দীর্ঘ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই কয়লা ব্যবসার আদ্যোপান্ত।

সরেজমিন গাবতলীর ডিপজলনগর এলাকায় কয়লার গদিতে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে কয়লা আর ইট-বালুর বিশাল সমাহার। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে ধোঁয়া আর ধুলা উড়ছে। বড় বড় ক্রেন দিয়ে আনলোড করা হচ্ছে কয়লা। আবার গদি থেকে বাল্কহেড আর ট্রাকে কয়লা লোড করতেও দেখা যায়। তুরাগ নদের পাড়ে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে শতাধিক বাল্কহেড। একেকটি বাল্কহেডের ধারণক্ষমতা ২০০ থেকে ৬০০ টন পর্যন্ত বলে জানান বাল্কহেডের শ্রমিক। এ ছাড়া বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লাইটার জাহাজের মাধ্যমে কয়লা আনে বলেও জানা গেছে। নদীর তীরে তিনটি লাইটার জাহাজ ভিড়িয়ে রাখতেও দেখা যায়। এসব লাইটার জাহাজের ধারণক্ষমতা ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টন। প্রতিদিন দুই পাড়ে অন্তত ৪-৫টি লাইটার জাহাজ এবং ১২-১৫টি বাল্কহেডে করে কয়লা আসে বলে জানা গেছে বিআইডব্লিউটিএ ঘাট ইজারাদারের সূত্রে। মূলত আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসে এসব কয়লা।

জানা গেছে, ভ্যাসেলে করে প্রথমে এসব কয়লা দেশের বাইরে থেকে মোংলা বা অন্য বন্দরে আসে। এরপর সেখান থেকে বাল্কহেড এবং লাইটার জাহাজে করে গাবতলীতে আনা হয়। এখানে কয়লা আনলোড করার সময় টনপ্রতি ৬৫ টাকা করে ঘাট ভাড়া নেন বিআইডব্লিউটিএর ইজারাদার।

আর সেই ইজারাদার হলেন মনোয়ার হোসেন ডিপজল। তার হয়ে দ্বীপনগর ঘাটে ইজারার টাকা উত্তোলন করেন নুর ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তবে গত শনিবার দুপুরে ঘাট স্টেশনে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। এরপর তাকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

জানা গেছে, এখান থেকে ঢাকা এবং আশপাশের বিভিন্ন জেলার ইটভাটা ও কলকারখানায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা সরবরাহ করা হয়। দিনের বেলা এসব গদি থেকে ক্রেতারা কয়লা কিনে ট্রাকে লোড করে রাখেন। রাত হলেই ট্রাক ছেড়ে যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

নদীর তীরে হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে থাকলেও এই কয়লাযজ্ঞের কারণে তা কার্যত বন্ধ হয়ে আছে। ক্রেতা পরিচয় দিয়ে কথা হয় কয়লা ব্যবসা সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে। একটি গদির ম্যানেজার জানান, ‘৩৭ লাখ টাকা জমিদারকে (ডিপজল) অগ্রিম মাটি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন। তাই কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

জানতে চাইলে সোহাগ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, ‘এই জায়গা ডিপজল সাহেবের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছি। এক সময় এই এলাকা ঘিরে অনেক অপরাধ হতো। ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠায় এখন আর তেমনটা হয় না।’

সরকার ট্রেডার্সের ম্যানেজার রাশেদ নামে একজন বলেন, ‘এই পুরো এলাকা ডিপজল সাহেবের। আমরা তার কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছি। ব্যবসা করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মনোয়ার হোসেন ডিপজলকে ফোন দেওয়া হলে তিনি প্রশ্ন শুনে গালি দিয়ে ফোন কেটে দেন। পরে আবারও ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি নদী দখল করছি কি না সেটা মাইপা দেখেন গা। আমি মাটি ভাড়া দিছি। এখন মাটি ভাড়া নিয়ে কে কী করল, সেটা আমার দেখার বিষয় না। সেটা যারা ব্যবসা করবে তারা দেখবে।’

ফায়ার সার্ভিস কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া গড়ে ওঠা কয়লা বাণিজ্য রক্ষায় তার ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ডিপজল বলেন, ‘আমি আপনাকে চিনি না। আপনার সঙ্গে কথা বলব কেন?’

ফের সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘মোবাইলের পরিচয়ে কী পরিচয় হয়? আপনাকে আমি চিনি না, দেখি নাই; আমি আপনার সঙ্গে আর কোনো কথা বলব না।’

ধানের জমিতে কয়লা বাণিজ্য: নদীর এপার থেকে ওপারে তাকালে বিশাল কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে। নৌকা নিয়ে ওপারে গিয়ে নামতেই দেখা যায় সারি সারি স্তূপ করে রাখা হাজার হাজার টন কয়লা। পাড়ে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে কয়েকশ বাল্কহেড। এ ছাড়া চোখে পড়ে তিন-চারটি লাইটার জাহাজ। নৌকায় যেতে যেতে কথা হয় মাঝির সঙ্গে। তিনি জানান, পাশেই তার বাসা। ছোটবেলা থেকে এখানেই বড় হয়েছেন। ওপারে তাদের জমি ছিল। এক সময় সেসব জমিতে আবাদ হতো বোরো ধানের। কিন্তু হঠাৎ করে এসব জমিতে বালু ফেলে ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে কয়লা সাম্রাজ্য। ফলে পেটের তাগিদে এখন তিনি খেয়া নৌকা চালান। এ ছাড়া অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করতে না পেরে এ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বলেও জানান তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এখানকার কয়েক কিলোমিটার এলাকায় দেশের বড় বড় কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান কয়লা আমদানি করে। আর ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে পাইকারি দরে কয়লা কিনে ব্যবসা করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোও ডিপজলের কাছ থেকে জায়গা কিনে কিংবা ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছে কয়লার ব্যবসা। কয়লা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কয়েকটি সিন্ডিকেট। নতুন কেউ কয়লা কিনতে এলে তাকে ফুসলিয়ে নিজেদের পছন্দমতো দোকানে নিয়ে যান তারা। এরপর টনপ্রতি গদি মালিকের কাছ থেকে কমিশন নেন।

কয়লা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম (শাওন) বলেন, ‘এখানে মাত্র দু-তিনটি প্রতিষ্ঠান কয়লা দেশের বাইরে থেকে ইমপোর্ট করে। বাকিরা পাইকারি দরে কিনে বিক্রি করে।’

নদী দখল করে কয়লা ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (ঢাকা পোর্ট) আলমগীর কবির বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ কাউকে নদী ভরাট করার অনুমতি দেয় না। কেউ যদি বলে থাকে তাহলে সেটা মিথ্যা। আমি লোক পাঠিয়ে খবর নেব—কারা দখল করছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কম্প্রোমাইজ নেই। বিআইডব্লিউটিএ নদীশাসন এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। কেউ দখল করে থাকলে উদ্ধারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

দূষিত পরিবেশ, রোগে আক্রান্ত অনেকে: নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিসের সনদপত্র থাকার কথা থাকলেও কেউ এসবের অনুমতি নেয়নি। কেউ কেউ মুখে নিয়েছেন দাবি করলেও কাগজপত্র দেখাতে পারেনি কোনো প্রতিষ্ঠানই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান অনুমতি নেওয়া লাগে, সেটাই জানে না। সরকারের সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন এখানকার প্রভাবশালীরা। খোলা পরিবেশে কয়লা ব্যবসা পরিচালনা করায় ধুলা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। বাতাসের সঙ্গে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বায়ুতে। এ ছাড়া লোড-আনলোডের সময় নদীতে পড়েও দূষিত হচ্ছে পানি। শ্রমিকদের দেখা যায়, কোনো ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই কাজ করছেন। ফলে তারাও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক শ্রমিক।

সার্বিক বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদকে নানাভাবে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সাময়িক দায়িত্ব) শিল্পী রাণী দেবী বলেন, ‘কয়লার ব্যবসা করতে হলে অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। কারণ কয়লা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’

গাবতলী ও আমিনবাজারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আপনারা তো পত্রিকায় আছেন। রিপোর্ট করবেন বা অভিযোগ দেন। নজরে এলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার ও মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, যে কোনো দাহ্য পদার্থ মজুত বা প্রক্রিয়াজাত করলেই নিয়ম অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স নিতে হবে। যেহেতু কয়লা একটি দাহ্য বস্তু, সে ক্ষেত্রে ফায়ার লাইসেন্স নিতে হবে। তবে আমরা কাউকে নেওয়ার জন্য ফোর্স করতে পারি না। কাউকে বলতে পারি না তুমি উঠে যাও। এ ক্ষেত্রে সচেতনতাটা জরুরি। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছি।’

গাবতলী ও আমিনবাজারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি ইন্সপেক্টরকে অবগত করব। তিনি খোঁজখবর নেবেন।’




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top