বাংলাদেশের ৫১৬১টি পণ্যে শুল্ক না-নেওয়ার ঘোষনা চীনের: ক্ষুব্ধ ভারতীয় গণমাধ্যম

রাজ টাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২১ জুন ২০২০ ০৭:৩০; আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:২৯

বেশ কিছুদিন ধরেই ভারত-চীন সীমান্তে চলছে উত্তেজনা। উভয় পক্ষেরই সেনারা হয়েছে হতাহত। এর মধ্যে চীনের বাজারে নতুন করে পাঁচ হাজারের বেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। আর এ খবর নিয়ে বেশ সরব ভারতীয় গণমাধ্যম। এ খবরে ভারতীয় গণমাধ্যম চীনের প্রতি যতোটা না ক্ষোভ ঝাড়ছে চাইতে বেশি হেয় করছে বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৯ জুন জানায়, চীনের বাজারে আরও পাঁচ হাজার ১৬১টি পণ্যের শুল্কমুক্ত রফতানি সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে দেশটিতে মোট শুল্কমুক্ত পণ্যের সংখ্যা দাঁড়াল আট হাজার ২৫৬টি। এর ফলে চীনে বাংলাদেশের মোট রফতানি পণ্যের ৯৭ শতাংশই শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় এলো।

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে থাকলেও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাণিজ্যের ওই প্রাধিকারটি পেতে দীর্ঘদিন ধরে দুদেশের আলোচনা চলছিল। আর অতি সম্প্রতি এটি দিতে সম্মত হয় চীন সরকার। আগামী ১ জুলাই থেকে বেইজিং প্রদত্ত সুবিধার ওই ঘোষণা কার্যকর হতে যাচ্ছে।

তবে লাদাখের ঘটনার পরপরই চীন হতে এরকম একটি ঘোষনায় ভারতীয় মিডিয়া মনে করছে, নয়াদিল্লির সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ঢাকাকে বেইজিংয়ের বাগে রাখার ‘টোপ’ এটি। এটিকে ‘টোপ’ প্রমাণে প্রচারিত খবরে যাচ্ছেতাই শব্দের ব্যবহার করছে ভারতের অনেক আলোচিত সংবাদমাধ্যম। আনন্দবাজার পত্রিকা এবং জি নিউজের বাংলা সংস্করণ ‘২৪ ঘণ্টা’র খবরে বিষয়টিকে ‘খয়রাতি’ বলেও আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর এই ‘খয়রাতি’ শব্দটিই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তুমুল আলোচনায়। বিষয়টি ‘পরীক্ষিত বন্ধু রাষ্ট্রকে’ খাটো করার মানসে করা হয়েছে কি-না, সে প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

“লাদাখের পরে ঢাকাকে পাশে টানছে বেজিং” শিরোনামে আনন্দবাজার প্রতিকার খবরে বলা হয়েছে, “বাণিজ্যিক লগ্নি আর খয়রাতির টাকা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়ার চেষ্টা নতুন নয় চীনের। লাদাখে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত-সংঘর্ষে উত্তাপ ছড়ানোর পরে ফের নতুন উদ্যমে সে কাজে নেমেছে বেজিং।

যদিও এ প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়, “বাংলাদেশ একমাত্র প্রতিবেশী দেশ, নানা টানাপড়েন সত্ত্বেও যাদের সঙ্গে ভারতের একটা পরীক্ষিত সুসম্পর্ক রয়েছে। দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ থেকে উত্তরে নেপাল-ভুটান, কারও সঙ্গেই আর আগের উষ্ণ সম্পর্ক নেই ভারতের।”

জি নিউজের বাংলা সংস্করণ ‘২৪ ঘণ্টা’র এ সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম করা হয়, “ভারতকে চাপে ফেলতে বাংলাদেশকে 'খয়রাতি' চিনের!” প্রতিবেদনে বলা হয়, “নেপালের পর বাংলাদেশ। ভারতের সঙ্গে লড়াইয়ে পড়শিদের পাশে পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীন। বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত ৯৭ শতাংশ পণ্যকেই শুল্কমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজিং।”

এদিকে ভারতীয় গণমাধ্যমে ‘খয়রাতি’ বা ’টোপ’ এর মতো শব্দ ব্যবহারে বাংলাদেশেও অনেকেই তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী এ বিষয়ে তার ফেসবুকে আনন্দবাজার পত্রিকার সমালোচনা করে লেখেন, “খয়রাতির টাকা গ্রহণে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ যোজন যোজন দূরে!”

তিনি বিশ্বের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের আর্থিক সাহায্য গ্রহণের কিছু চিত্র তুলে ধরে সেখানে লেখেন, “খয়রাতি বা দানের টাকা হিসেব করলে দেখা যাবে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ যোজন যোজন দূরে। বিশ্বের উন্নয়ন সহায়তা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আর্থিক সাহায্য পায় (আনন্দবাজারের ভাষায় খয়রাতি) এমন দেশগুলোর মধ্যে টাকার অঙ্কে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সাহায্যপ্রাপ্ত দেশটির নাম ভারত, আার বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। জার্মানির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য যে দেশটি পেয়ে থাকে তার নাম ভারত (পরিমাণ প্রায় ১১৮২ মিলিয়ন ইউএসডি)। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে অর্থ সাহায্য পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান পঞ্চম (পরিমাণ ৪৬৬.৩৭ মিলিয়ন ইউএসডি)। জাপানের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে ভারত (পরিমাণ ২৩৭৬.৪০ মিলিয়ন ইউএসডি)। এছাড়া ফ্রান্স ও হাঙ্গেরি থেকেও মোটা অঙ্কের সাহায্য পেয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এ দেশটি।”

সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সরকারের উচিত আনন্দবাজারের এমন আচরণের প্রতিবাদ জানানো। এমন অপমানজনক সংবাদের জন্য কৈফিয়ত তলব করা।”

সাংবাদিক আতাউর রহমান আনন্দবাজারের এ প্রতিবেদনটি তার ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লেখেন, “বাংলাদেশকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার এমন ভাষা প্রয়োগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। নিজেরা বাংলাদেশ নিয়ে অসম বাণিজ্যের খেলা খেলবে, আর অন্য কোনো রাষ্ট্র সেই বাণিজ্যে সমতা আনলে সেটা খয়রাতি হয়?”

কলেজশিক্ষক দেব দুলাল গুহ ২৪ ঘণ্টার প্রতিবেদনটি তার ফেসুবক অ্যাকাউন্টে শেয়ার দিয়ে লিখেছেন, “ভারতের মিডিয়ার হেডলাইন!”

তানভীর মেহেদী নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী তার অ্যাকাউন্টে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনটি শেয়ার করে লিখেছেন, “চীন আমাদের এভাবে ভিক্ষা দিলো? মনে হইতেছে চীনের কাছ থেকে বিকাশে খয়রাতি টাকা এনে ভাত খাইতেছি। মন খারাপ হয়ে গেলো। নিজেরে ফকিন্নি ফকিন্নি লাগতেছে...!”

রাজু বড়ুয়া নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ডাইরেক্টলি আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাদেশকে খয়রাতি দেশ বলল। যদিওবা এটা ভারত সরকারের কথা নয়, তাই ভারত সরকার উচিত আনন্দবাজার পত্রিকাকে সর্তক করা। কারণ তাদের এই দুর্সময়ে প্রতিবেশীদের না খুঁচিয়ে সহযোগিতা চাওয়া উচিত কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা তা না করে উল্টো আমাদের দেশকে, দেশের জনগণ খুঁচিয়ে দিল। আনন্দবাজার পত্রিকা ভুলে গেছে কত কত খয়রাত তাদেরকে দিয়েছি, শুধুমাত্র স্বাধীনতার সময় তাদের অবদানের জন্য। না হলে তারা আমাদের কি দিয়েছে আর আমাদের কাজ থেকে কি কি নিয়েছে হিসাব করে দেখুক। নেপাল আর চীনের সাথে লেগেছেন, পাকিস্তানের সাথে আগে থেকে তো আছেই। এখন আমাদের কেন খুঁচাছেন??? এতে আপনাদের ক্ষতি বেশি হবে- আপনারা সঙ্গীহারা, মিত্রহারা হয়ে যাবেন। তাই এখন থেকে সর্তক হোন।”

পর্যবেক্ষকদের ভাষ্যে, প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চিরবৈরিতার কথা গোটা বিশ্বের জানা। এর মধ্যে নতুন করে বৈরিতা শুরু হয়েছে নেপালের সঙ্গে। দেশটির সংসদে সংশোধিত মানচিত্র পাস নিয়ে এ বৈরিতা তৈরি হয়েছে। ভারতের দাবি, তাদের কিছু অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রে যোগ করেছে নেপাল। আর কাঠমান্ডুর দাবি, এতোদিন ধরে ভারত তাদের যে অঞ্চল দখল করে রেখেছিল, সেটাকেই সংশোধিত মানচিত্রে দেখানো হয়েছে। তারপর লাদাখে চীনা সেনাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে ত্রিদেশীয় চাপে পড়ে গেছে ভারত। এর মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা ও ২৪ ঘণ্টার মতো সংবাদমাধ্যমে এমন খবর প্রচার নিজেদের ‘অসহায়ত্ব’ লুকানোর দম্ভ কি-না, সে প্রশ্নও উঠতে পারে।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top