গুম প্রতিরোধ দিবস: প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার মিনতি
রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০২২ ১৯:৩২; আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫ ১৬:০৪
-2022-08-30-09-32-01.jpg)
প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আকুল মিনতি। চোখের জলটুকু শুকিয়ে গেছে। কেউ হারিয়েছে সন্তান কেউ বা প্রিয় প্রিয় বাবাকে। স্ত্রী হারিয়েছেন তার স্বামী। এরপর চলে গেছে বছরের পর বছর। খবর যুগান্তর।
হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া পরিবারের প্রিয় মানুষটি জীবিত না মৃত, সেটাই অনেকে আজও জানেন না। বুকভরা হাহাকার আর চোখে অশ্রু নিয়ে হারিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলোর জন্য আজও প্রহর গুনছেন তাদের পরিবার-পরিজন। সড়কে দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন তারা। এমন বাস্তবতায় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ পালিত হবে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস।
সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০২ থেকে কাজ শুরু করে ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে জাতিসংঘ। ইংরেজিতে নাম দেওয়া হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়। তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে পালিত হচ্ছে দিবসটি।
দিবসটি উপলক্ষ্যে বাণী দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত বাণীতে মির্জা ফখরুল বলেন, এ দিনটিতে আমি হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করছি। তাদের পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। রাষ্ট্রের এই অমানবিক আচরণ সংবিধানবিরোধী। বিরোধী দলশূন্য একদলীয় শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেই গুমকে প্রধান অবলম্বন করা হচ্ছে। এই নির্দয় গুমের শিকার হয়েছেন সংসদ-সদস্য ইলিয়াস আলীসহ অনেকে। তিনি বলেন, কেবল একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার গঠন হলেই গুম, অপহরণ, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ দূর হবে, জনজীবনে ফিরে আসবে স্বস্তি। জাতিসংঘের অধীনে সব গুমের তদন্তের দাবি জানান মির্জা ফখরুল।
গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আছেন সাধারণ মানুষও। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। ফলে গুমের হাত থেকে সুরাহা পাওয়ার অধিকারটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয় এবং কাউকে গুম করে দেওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়।
চলতি বছরের ২১ মার্চ বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) তত্ত্বাবধানে করা এক গবেষণায় ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে তিন বছরে ৭১ জনের গুমের তথ্য ওঠে আসে। তাদের মধ্যে ২৩ জন ফিরে এলেও তারা নিখোঁজ থাকা অবস্থায় কোথায় কেমন ছিলেন, তা নিয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।
সংগঠনটি জানিয়েছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে ২০১৯ সালে ৩১টি, ২০২০ সালে ১৬টি এবং পরের বছর ২৪টি ‘গুমের’ ঘটনা পেয়েছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইসড অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে হয়েছিল এই গবেষণা। সংগঠনটি তখন আরও জানিয়েছিল, এই ৭১ ব্যক্তির মধ্যে ৬৫ জনের তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ২৩ জন ফিরে এসেছেন, ২২ জনকে পরে গ্রেফতার দেখিয়ে জেলহাজতে রাখা হয়েছে, ১৬ জন নিখোঁজ আর ৫ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে।
এদিকে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে উঠে দেশের মানবাধিকার ইস্যু। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গুম হয়েছেন ৭৬ জন। সরকারকে এমন একটি তালিকা দেয় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ। তালিকায় ২৪টি দেশের তিন শতাধিক গুমের ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের এক নথিতে বলা হয়, বাংলাদেশে গুমের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কয়েক বছর ধরে এ নিয়ে উদ্বেগ জানালেও বাংলাদেশ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। ১৯৯৬ সাল থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে। বাংলাদেশ কেবল একটি গুমের অভিযোগের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন সরকারের কাছে গুম হওয়া যে ৭৬ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছিল, তাদের বিষয়ে বাংলাদেশ সফরে আসা জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটকে অবগত করা হয়।
১৪ আগস্ট ব্যাচেলেটের সঙ্গে বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘৭৬ জনের মিসিং বা ডিসঅ্যাপেয়ারেন্স পার্সনের তালিকা দেওয়া হয়েছিল। আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, এই ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জন তাদের বাড়িতে এবং দুজন জেলখানায় আছেন। আমরা তাকে বলেছি, আমাদের দেশে তিনটি কারণে ডিসঅ্যাপেয়ার (গুম) হয়। প্রথম কারণ হচ্ছে ঘৃণ্য অপরাধ যারা করে, ভিডিওর মাধ্যমে আমরা দেখিয়েছি। পুলিশকে পিটিয়েও তারা হত্যা করেছে। আমরা এটাও দেখিয়েছি, কীভাবে তারা মানুষের সম্পদ ধ্বংস করেছে। যারা এগুলো করেছে, তারা সীমান্তের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। তারা ভারত বা মিয়ানমার কিংবা অন্য কোনো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। বাকিরা আমাদের সঙ্গেই আছে। আজ বিচার বিভাগ স্বাধীন, কাজেই বিচার এড়ানোর জন্যই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেটার একটা নমুনা আমরা তাকে দেখিয়েছি। কী ধরনের অপরাধ তারা করেছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণে জর্জরিতরা গা ঢাকা দেয়। হয়তো কয়েকদিন পরে আত্মপ্রকাশ করে। আবার যারা পারিবারিকভাবে অসুবিধায় পড়ে, তারাও গা ঢাকা দেয়। এ তিন ধরনের লোকদের গা ঢাকা দিতে দেখেছি। এটা কমিশনারকে বলেছি। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদের গ্রেফতার করে, তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে সোপর্দ করে দিই।’
এদিকে হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ প্রকাশিত হয়নি। ওই রিপোর্টে গুম-খুনের মতো বিশেষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেসব দেশে বিরাজমান এদের মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই।
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা বলেন, ১৬ বছরে (২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর ৬১৪ জন নিখোঁজ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ পাওয়া যায়। ৯৪ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এছাড়া ফিরে আসেন ৫৭ জন। তিনি বলেন, পরিসংখ্যান বলছে, কয়েক বছরে গুমের ঘটনা কমে গেছে।
এদিকে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত এবং গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করাসহ সরকারের কাছে ছয়টি দাবি তুলে ধরে।
‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম তুলি জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে ছয়শর বেশি মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। গুমের শিকার বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে গেছে।
দিবসটি উপলক্ষ্যে মায়ের ডাকের উদ্যোগে আজ ১০টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গুম হওয়া স্বজনদের নিয়ে প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকার সংগঠক, সাংবাদিক প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন। বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ১২টায় নাগরিক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: