এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিচারাধীন কারাবন্দি বাংলাদেশে

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২৩:৩৫; আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫ ১৬:০৫

ছবি: সংগৃহিত

দেশে ঢিমে তেতলা বিচার বিভাগের জন্য কারাবন্দী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মামলার দীর্ঘসূত্রিতায় বিচারধীন বন্দি হিসেবে দিনের পর দিন হাজতে থাকতে হচ্ছে অভিযুক্তদের। খবর বনিক বার্তার।

সরকারি হিসাবে দেশের কারাগারগুলোয় বর্তমানে এ ধরনের বন্দি রয়েছে ৬৫ হাজারেও বেশি, যা মোট বন্দির ৭৮ শতাংশ। তবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী এ হার ৮০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের কারাগারে সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ বিচারাধীন বন্দি থাকলে সেটিকে আদর্শ মান হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু দেশের কারাগারে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা আদর্শ মানের দ্বিগুণেরও বেশি। বিচারাধীন বন্দির সংখ্যায় এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে আর বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন সংস্কারের মাধ্যমে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমিয়ে আনা প্রয়োজন।

সম্প্রতি কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টি দেশের কারাগারে থাকা বিচারাধীন বন্দিদের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ (সিএইচআরআই)। সেখানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

নিয়ম অনুযায়ী, মামলার আসামি গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এ সময় ওই বন্দিকে হাজতি শ্রেণীতে কারা হেফাজতে রাখা হয়। এরপর শুরু হয় পুলিশের তদন্ত। তদন্ত শেষে অপরাধ-সংশ্লিষ্টতা পেলে আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে বিচার শুরুর আবেদন করে পুলিশ। আর অপরাধ-সংশ্লিষ্টতা না পেলে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে আসামিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করা হয়।

অপরাধ-সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে বিচার শুরু হলে প্রথমে সাক্ষ্য গ্রহণ, তারপর চলে যুক্তি-তর্ক। এভাবেই মামলাটি চূড়ান্ত রায়ের দিকে গড়ায়। বিচারাধীন বন্দিরা দোষী সাব্যস্ত হলে কয়েদি হিসেবে সাজা খাটতে শুরু করে। আর নির্দোষ প্রমাণ হলে মেলে মুক্তি। তবে দোষী নাকি নির্দোষ তা জানতে অপেক্ষা করতে হয় বিচারকের চূড়ান্ত রায়ের জন্য। এর মাঝে কেটে যায় মাস, বছর। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যাও।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের কারাগারে সর্বোচ্চ ৩৪ শতাংশ বিচারাধীন বন্দি থাকলে সেটিকে আদর্শ ধরা হয়। তবে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এ সীমা সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। তবে সিএইচআরআইয়ের হিসাবে বাংলাদেশের কারাগারের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৮০ শতাংশ, যার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর বৈশ্বিক তালিকার পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

সিএইচআরআইয়ের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিচারাধীন বন্দি বিবেচনায় কমনওয়েলথভুক্ত পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশটির কারাগারে বিচারাধীন বন্দি রয়েছে ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিচারাধীন বন্দি সবচেয়ে কম পাকিস্তানের কারাগারগুলোয়। সেখানে এ ধরনের বন্দি রয়েছে ৭০ শতাংশ।

বৈশ্বিক তালিকার প্রথমে রয়েছে মধ্য ইউরোপের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লিচেনস্টেইন। ১৬০ বর্গকিলোমিটারের দেশটির কারাগারে বিচারাধীন বন্দি রয়েছে ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সান ম্যারিনোর কারাগারে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ। কারাগারে থাকা বিচারাধীন বন্দি বিবেচনায় হাইতির অবস্থান তৃতীয়। দেশটিতে ৮১ দশমিক ৯ শতাংশ বিচারাধীন বন্দি। ৮০ দশমিক ২ শতাংশ বিচারাধীন বন্দি নিয়ে তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবন। এ তালিকার পঞ্চম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।

দেশের বিভিন্ন কারাগারে বিচারাধীন বন্দির যে তথ্য সিএইচআরআই প্রকাশ করেছে তার সত্যতা জানতে যোগাযোগ করা হয় কারা অধিদপ্তরে। তাদের হিসাবমতে বর্তমানে দেশে কারাগারের সংখ্যা ৬৮। এর মধ্যে ৫৫টি জেলা কারাগার এবং ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এসব কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৬০। এর মধ্যে হাজতি বা বিচারাধীন বন্দি ৬৫ হাজার ৩৯২ জন, যা মোট বন্দির ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া বিচারের পর সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৪৬৮।

কারাগার-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আসামির চেয়ে বিচারাধীন হাজতি আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দি আটক থাকায় কারাভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। এসব সমস্যার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিচারাধীন আসামিদের মধ্যে শুধু মাদক মামলায় গ্রেফতার আসামির সংখ্যাই মোট আসামির ৩৭ শতাংশ। আইনানুযায়ী এসব আসামির ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর শাস্তি হতে পারে। কিন্তু বিচারের অপেক্ষায় সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দিন থাকতে হয় এসব বন্দির। সুষ্ঠু কারা ব্যবস্থাপনার স্বার্থে দ্রুত এসব আসামির বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিচারকাজ শেষ করা যায় কিনা তা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কারাগারে থাকা বিচারাধীন বন্দিদের বড় একটি অংশই মাদক মামলার আসামি। এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক মামলা এবং প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাৎ মামলার আসামি। বিচারক সংকটের কারণে এ ধরনের মামলার বিচারকাজ শেষ করা সময়সাপেক্ষ। পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে বিচারকাজ গতিশীল করার পাশাপাশি আইন সংস্কারের মাধ্যমেও বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমিয়ে আনা যায়।

মামলাজট, দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা কারণে দেশের কারগারগুলোয় বন্দির সংখ্যা বাড়ছে। চেক জালিয়াতি মামলায় গ্রেফতার ইভ্যালির সিইও রাসেল এখনো কারাগারে। গুলশান থানায় দায়ের করা অর্থ আত্মসাতের মামলায় গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে রাসেল ও তার স্ত্রী ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করে র্যাব। প্রতারণা ও চেক জালিয়াতির ছয়টি মামলায় ছয় মাস কারাভোগের পর গত ৬ এপ্রিল গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন শামীমা। তবে রাসেল এখনো কারাগারে। এমন অসংখ্য মামলায় বিচারাধীন বন্দিরা কারাগারগুলোয় ভিড় বাড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে সুুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদিন মালিক বণিক বার্তাকে বলেন, কয়েকটি কারণে মূলত কারাগারে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কারণটিই হলো আমাদের দেশে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ অপরাধই জামিন অযোগ্য। অথচ যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দেশগুলোয় বেশির ভাগ অপরাধ জামিনযোগ্য। জামিন অযোগ্য হওয়ার কারণে আসামিরা সহজেই জামিন পায় না। ফলে বাড়তে থাকে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা। দ্বিতীয় কারণটি হলো অনেক মামলার ক্ষেত্রেই জেলা আদালত জামিন দেন না। উচ্চ আদালতে গেলে জামিন পাওয়া যায়। তবে জেলা পর্যায়ের বিচারাধীন বন্দিদের বেশির ভাগই হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। সে কারণেও বন্দির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এসব সমস্যার সমাধান করা গেলে বাংলাদেশের কারাগার থেকে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমানো যাবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ) সৈয়দ বেলাল হোসেন বণিক বার্তাকে জানান, বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়টি বিচার বিভাগের ইস্যু। এ বিষয়ে তার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব না। বরং তিনি সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

পরে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও বিচারাধীন বন্দিদের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তার পরামর্শ অনুযায়ী কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মো. আবরার হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে সহজেই কারাগার থেকে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমিয়ে আনা যাবে।

সাবেক এ কর্মকর্তার দাবি, ছোট অপরাধে গ্রেফতার আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। কিন্তু যারা দুর্ধর্ষ অপরাধী, কারাগার থেকে বের হলে বড় অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে তারা জামিন পায় না। তিনি মনে করেন, এসব আসামির জামিন পাওয়া উচিত নয়। এছাড়া বিচারক সংকট নিরসন করে দ্রুত বিচারকাজ সম্পাদনের মধ্য দিয়েই কেবল বন্দির সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top