আমদানি নিয়ন্ত্রণে, তবে এলসি নিষ্পত্তির হার বেড়ে ৬৩ শতাংশ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:০৩; আপডেট: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:০৪

ছবি: সংগৃহিত

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নীতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানির লাগাম টানতে এরই মধ্যে ঋণপত্র (এলসি) খোলায় আরোপ করা হয়েছে নানা শর্ত। এতে কিছুটা হলেও কমে এসেছে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ। তবে এলসি খোলা কমলেও এলসি নিষ্পত্তির হার বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। খবর টিবিএসের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম মাস জুলাইয়ে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। একই সময়ে এলসি নিষ্পত্তির হার ৬৩ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। জুলাইয়ের ধারাবাহিকতায় আগস্টেও এলসি নিষ্পত্তিতে প্রায় একই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল বলে জানা গিয়েছে। অথচ রেকর্ড আমদানি এলসি খোলার ২০২১-২২ অর্থবছরেও এলসি নিষ্পত্তিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৪৬ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তিতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ।

এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর পড়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া রিজার্ভ এরই মধ্যে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। গত বৃহস্পতিবার দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৯ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। আগামীকাল এ রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় পরিশোধ করতে হবে। সে হিসাবে চলতি সপ্তাহেই রিজার্ভের পরিমাণ সাড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে ডলারের বিনিময় হার কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। চলতি সপ্তাহে রিজার্ভের পরিমাণ এক ধাক্কায় দেড় বিলিয়ন ডলার কমে যাওয়ায় আবারো বিনিময় হার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এলসি খোলা কিছুটা কমলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে বলে মনে করছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন, ২০২১-২২ অর্থবছর ৩৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি অনিষ্পন্ন রয়েছে। রেকর্ড এ অনিষ্পন্ন এলসির দায় দুই বছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। একই সঙ্গে পরিশোধ করতে হবে নতুন করে খোলা এলসির দায়ও। এ অবস্থায় দেশের বাজারে চলমান ডলার সংকট শিগগিরই কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং আগামী দিনগুলোয় অনিষ্পন্ন এলসির দায় খেলাপি হয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ঋণমান খারাপ হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাইয়ে এলসি খোলা হয়েছিল ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন বা ৫১৪ কোটি ডলারের। আর চলতি বছরের জুলাইয়ে ৫৬৯ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। সে হিসাবে এলসি খোলায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছরের জুলাইয়ে ৪৭০ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হলেও চলতি বছরের একই সময়ে সেটি ৭৬৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে এলসি নিষ্পত্তির হার ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।

জুলাইয়ের মতোই চলতি বছরের আগস্টে এলসি খোলার পরিমাণ কমলেও নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে আগস্টে মোট এলসি খোলা হয়েছে ৫৯৩ কোটি ডলারের। একই সময়ে ৭০৩ কোটি ডলারের এলসির দায় নিষ্পন্ন হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে এলসির দায় নিষ্পন্নের পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ ছিল।

খুব শিগগির এলসি নিষ্পত্তির চাপ থেকে দেশের ব্যাংক খাত বেরোতে পারবে না বলে মনে করছেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, নতুন এলসি খোলা না খোলার ক্ষমতা আমাদের হাতে থাকলেও নিষ্পত্তির বিষয়টি নেই। করোনার কারণে গত দুই বছরে অনেক এলসির দায় যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়নি। মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়া ওইসব এলসির দায় এখন পরিশোধ করতে আমরা বাধ্য। আগামীতে এসব এলসির দায় পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে। পুরনো এলসি দায়ের সঙ্গে নতুন এলসির দায়ও যুক্ত হচ্ছে। প্রতি মাসে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বাবদ কী পরিমাণ ডলার দেশে আসছে, একই সময়ে আমদানি দায় পরিশোধ বাবদ কী পরিমাণ ডলার দেশ থেকে চলে যাচ্ছে, সেটি হিসাব করে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের জুলাইয়ে এলসি নিষ্পত্তির চাপ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে জ্বালানি তেল আমদানিতে। ২০২১ সালের জুলাইয়ে জ্বালানি তেলের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪২ কোটি ডলারের। চলতি বছরের জুলাইয়ে পণ্যটি আমদানিতে ১২৯ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। সে হিসাবে জ্বালানি তেলের এলসি নিষ্পত্তি ২০১ শতাংশ বেড়েছে। শুধু এলসি নিষ্পত্তিই নয়, জ্বালানি তেল আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণও জুলাইয়ে ৯৩ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে পণ্যটি আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৫০ কোটি ডলারের। চলতি বছরের জুলাইয়ে জ্বালানি তেলের এলসি খোলা হয়েছে ৯৭ কোটি ডলারের।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোয় ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ২২৩ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি। চলতি বছরের ৩০ জুন অনিষ্পন্ন এলসির স্থিতি ছিল ৩৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল ২৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার এলসি অনিষ্পন্ন রেখে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে অনিষ্পন্ন এলসির স্থিতি ৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন বছর মেয়াদি এলসি খোলা যায়। তবে বিশেষ বিবেচনায় মূলধনি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর্যন্তও সময় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলধনি যন্ত্রপাতির বাইরে অন্য সব ধরনের এলসির সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৬০ দিন। ২০২০ সালের মার্চে দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। ওই সময় নীতিসহায়তা হিসেবে সব ধরনের এলসির দায় পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে গত দুই বছরে দেশের ব্যাংক খাতে বিপুল অংকের ডেফার্ড এলসি বা বিলম্বিত ঋণপত্র দায় তৈরি হয়েছে। যে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র অনিষ্পন্ন রয়েছে, তার অন্তত অর্ধেকই বিলম্বিত ঋণপত্র বলে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যথাসময়ে এলসির দায় পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, রেকর্ড এলসি দায়ের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণও রয়েছে। গত দুই বছর দেশের ব্যবসায়ীরা এলসির দায় সমন্বয়ের জন্য বাড়তি সময় পেয়েছেন। আবার ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও শিথিলতা ছিল। এখন যথাসময়ে এলসির দায় বা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা দেশের ভাবমূর্তি সংকট তৈরি করবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশের ঋণমানও খারাপ হয়ে যেতে পারে। বিদেশী ঋণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আগামী বছরগুলোয় আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top