আমদানি শুল্ক যৌক্তিকীকরণের ও প্রত্যক্ষ কর আহরণ জোরদারের সুপারিশ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:১২; আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ০৭:২৪

ফাইল ছবি

বাংলাদেশকে আমদানি শুল্ক যৌক্তিকীকরণ এবং সম্পূরক শুল্কহার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র বিধান অনুযায়ী নির্ধারণ করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ বা এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলি সফলভাবে মোকাবিলায়–এমন সুপারিশ করেছে 'অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ' বিষয়ক একটি উপ-কমিটি। খবর টিবিএসের।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত এই কমিটি শনিবার অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে এক কর্মশালায় এসব সুপারিশ করেছে।

শুল্ক যৌক্তিকীকরণের ফলে রাজস্বে যে ঘাটতি তৈরি হবে তা মোকাবিলায় প্রত্যক্ষ কর আহরণ জোরদার করারও সুপারিশও করেছে সাব-কমিটি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে হলে সরকারকে রপ্তানিকারকদের বিদ্যমান নগদ প্রণোদনার বিকল্প সুবিধা দিতে হবে।

এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পৃথক করার উপর জোর দিয়েছে উপ-কমিটির একটি স্টাডি গ্রুপ।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলার প্রস্তুতি, পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মনিটরিং বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি রয়েছে, যার আওতায় বিষয়ভিত্তিক সাতটি সাব-কমিটি কাজ করছে।

কর্মশালায় ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ বিষয়ক স্টাডি গ্রুপ যেসব পণ্যের আমদানি শুল্ক ডব্লিউটিও'র নির্ধারিত সীমার অতিক্রম করেছে সেগুলি কমানোর সুপারিশ করে।

সাব-কমিটি বলেছে, আন্তর্জাতিক পদ্ধতির সাথে এসব পণ্যের ওপর নির্ধারিত ন্যূনতম শুল্ক হার সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় এগুলি পর্যায়ক্রমে বাতিল করতে হবে।

কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) এর সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন। তিনি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পণ্যে ডব্লিউটিও নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা আছে, যা কমিয়ে সীমার মধ্যে নামাতে হবে'।

তিনি বলেন, 'এতে সরকার দু'দিক থেকে সমস্যায় পড়বে। একদিকে আমদানি পর্যায়ে সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাবে। অন্যদিকে, স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে'।

'সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়েই কর্মশালায় আলোচনা হয়েছে। রাজস্ব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বাড়াতে হবে। এজন্য এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সবাই'- তিনি উল্লেখ করেন।

ডব্লিউটিও'র নীতি অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হলে- বাংলাদেশ রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা দিতে পারবে না। তাছাড়া, বিভিন্ন বাজারে বাংলাদেশ যেসব শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে– সেগুলিও আর পাবে না।

ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রধান পাঁচটি রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৬৩৮ কোটি ডলার কমতে পারে বলে সরকারের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

ডব্লিউটিও'র সাবসিডি নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ গ্রাজুয়েশনের পরও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি দিতে পারবে। তবে শিল্পপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নগদ প্রণোদনা দিতে পারবে না।

এ পরিস্থিতিতে, রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে বিকল্প উপায়ে রপ্তানিকারকদের এ সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করছে কমিটি।

গত মার্চে জারি করা রপ্তানি নীতি আদেশ (২০২১-২৪)- এও একই ধরনের সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এতে বলা হয়েছে, বিদ্যমান রপ্তানি প্রণোদনা, ভর্তুকি ও অন্যান্য সহায়তাগুলি কীভাবেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বিধিমালা সম্মতভাবে অব্যাহত রাখা যায়, সে বিষয়ে সরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলির মতে, নিজেদের রপ্তানি খাতের জন্য ভিন্ন নামে এই সুবিধাগুলি প্রদান অব্যাহত রেখেছে চীন, ভারত ও ভিয়েতনাম।

যেমন 'মেক ইন ইন্ডিয়া' কর্মসূচির অধীনে কোম্পানিগুলোকে স্থানীয়ভাবে পণ্য উদ্ভাবন, উৎপাদন ও সংযোজনের উৎসাহ দিচ্ছে ভারত। এজন্য উৎপাদন খাতে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে ভর্তুকি দিচ্ছে। শিল্প ও দক্ষতা উন্নয়নের নামে অনেকদিন আগেই আর্থিক সুবিধা চালু করেছে ভিয়েতনাম। প্রযুক্তি উন্নয়নের নামে চীনও স্থানীয় শিল্পকে আর্থিক সুবিধা দিচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি আয় অর্জনকারী তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে ৫% হারে নগদ প্রণোদনা পায়। ১৯৯০ এর দশকে সরকারের ২৫% নগদ প্রণোদনা দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকখাত জায়গা করে নিতে শুরু করে। এছাড়া, চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প, পাটপণ্যসহ বিভিন্ন শিল্প পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা পান রপ্তানিকারকরা।

২০২১-২২ অর্থবছর বাংলাদেশ রপ্তানিখাতে প্রণোদনা দিয়েছে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরে এখাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

রপ্তানিতে প্রণোদনা দেয় না, এমন কয়েকটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে 'অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ ও ট্যারিফ যৌক্তিকীকরণ' বিষয়ক উপ-কমিটির আওতায় থাকা 'প্রণোদনা বিষয়ক স্টাডি গ্রুপ' বলেছে, রপ্তানিতে নগদ নগদ সহায়তা না থাকলে- দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের মাত্রা কম হবে।

তবে নগদ প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হলে, রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যেতে পারে। তাই বিকল্প কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে পর্যালোচনা করছে স্টাডি গ্রুপ।

মো. জসিম উদ্দীন বলেন, নগদ প্রণোদনার বিকল্প হিসেবে সরকার গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দিতে পারে। আবার ট্যাক্সও কমিয়ে দিতে পারে।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, বর্তমানে সরকার গার্মেন্টস রপ্তানিতে ৫% প্রণোদনা দেয়। এর বিকল্প হিসেবে একই হারে আয়কর, কর্পোরেট কর হারও কমাতে পারে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক এমএ রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, রপ্তানি প্রণোদনার সমান বিকল্প ব্যবস্থা বের করা খুব মুশকিল। এক্ষেত্রে দেখতে হবে যে, বিভিন্ন দেশ কীভাবে ডব্লিউটিও'র নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকে রপ্তানিকারকদের সুবিধা দিচ্ছে।

তিনি বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলে শুধু রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিলে তা ডব্লিউটিও'র নীতির পরিপন্থী হবে। এসব ক্ষেত্রে ছাড় দিলে তা সব ধরণের শিল্পের জন্য দিতে হবে।

তবে প্রযুক্তি উন্নতকরণ, দক্ষতা উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও নবায়নযোগ্য শক্তি উন্নয়ন- এসব নামে রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তার সাথে একমত পোষণ করে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য মোস্তফা আবিদ খান টিবিএসকে বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর কর্মসংস্থান নিরাপত্তা তহবিল বা শিল্প আধুনিকীকরণ তহবিলের মাধ্যমে রপ্তানিকারকদের সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।

'বাংলাদেশ যদি শিল্প আধুনিকায়নের জন্য সহায়তা দেওয়ার নীতি প্রণয়ন করে, তাহলে শুধু রপ্তানি খাতকে দিলে তা হবে সুস্পষ্টভাবে ডব্লিউটিও'র বিধিমালা লঙ্ঘণ। আমাদের অন্যান্য খাতকেও তা দিতে হবে'।

প্ল্যামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, 'রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চাইলে আমাদের টেকসই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবতে হবে। এজন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীনের সাথে তাদের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত রাখার আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। সরকার এসব দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সইয়ের উদ্যোগ নিতে পারে।'

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর- এর সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেন, কাস্টমস, ট্যাক্স, ডিক্লারেশন ম্যানেজমেন্ট সংস্কার না করলে– এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top