মানসম্মত সেবা নিশ্চিত হয়নি গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ২০:১৯; আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২২ ২০:২০

ছবি: সংগৃহিত

গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন আর পিছিয়ে নেই। শহরের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে গ্রামীণ জীবনের উন্নতি। কিন্তু সেই সাথে পর্যাপ্ত উন্নতি হয় নি গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার। টিবিএসের প্রতিবেদন।

সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায় আমিনুল ইসলামের (৫৪)। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাজেভাবে ব্যথা পেয়েছেন। অসহ্য যন্ত্রণা তো শুরু হয়েছিলই, সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারছিলেন না।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাসিন্দা আমিনুল তার এই 'ছেঁড়া লিগামেন্টের' চিকিৎসা করান স্থানীয় এক ক্লিনিকে। ওই ক্লিনিকে চট্টগ্রামের একজন অর্থোপেডিক চিকিৎসক সপ্তাহে একদিন বসেন।

কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত আমিনুলকে ঢাকায় আসতে হয় ডাক্তার দেখাতে। অনেকগুলো কনসালটেশন, সাত দিনের হোটেলবাস ও এক সপ্তাহের একটি থেরাপি সেশন নিয়ে অবশেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন আমিনুল। মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়ার জন্য এই সাত দিনে ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে তার। সঙ্গে নানা ভোগান্তি তো পোহাতে হয়েছেই।

আমিনুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নোয়াখালীতে থেরাপির ব্যবস্থা থাকলে খরচ ও ভোগান্তি দুটোই কম হতো।

'রোগ হলে চিকিৎসার জন্য টাকা খরচ করতে সমস্যা নেই, কিন্তু চিকিৎসা তো ভালো হতে হবে। গ্রামাঞ্চলে তো টাকা দিলেও ভালো চিকিৎসা মেলে না।'

দেশের সড়ক যোগাযোগ ও শিক্ষা ব্যবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। দ্রুত নগরায়নও হচ্ছে। এসবের সুবাদে দূর-দূরান্তের জেলা, এমনকি গ্রামের বাসিন্দারাও উন্নত চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে দিন দিন সচেতন হচ্ছে।

একইসঙ্গে গ্রামাঞ্চলে উন্নত জীবনধারা ও খাওয়ার ধরন কিডনি ও হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁটু ও পিঠে ব্যথার মতো নানা অসংক্রামক রোগের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্য বলছে, এসব রোগ আগের চেয়ে বাড়ছে।

এর অর্থ, গ্রামীণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা এখন ব্যাপকভাবে বাড়ছে। কিন্তু গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যসেবা—মূলত ৪৮২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স—এই রূপান্তর থেকে পিছিয়ে পড়ছে।

বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হাসপাতালেই এখনও কর্মচারী ও যন্ত্রপাতির সংখ্যা অপ্রতুল। এর ফলে মানুষ স্থানীয় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিবিড় যত্নের প্রয়োজন এমন রোগীদের রাজধানীতে পাঠাতে হয়।

রোগীর চাপে ঢাকার স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর অবস্থা এমনিতেই নাজুক। এর মধ্যেই বাইরে থেকে আসা রোগীদের চাপে ঢাকার হাসপাতালগুলো সবসময় জনাকীর্ণ থাকে। অন্যদিকে স্থানীয় ক্লিনিকগুলোর ওপর রোগীদের আস্থা যেমন কম, তেমনি সেগুলোর সেবার মানও প্রশ্নবিদ্ধ।

ফাঁকা পদ, নষ্ট যন্ত্রপাতি

খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে মেশিন গত পাঁচ বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। আলট্রাসনোগ্রাফি যন্ত্রটিও বিকল অবস্থায় রয়েছে কয়েক বছর। শিশু বিশেষজ্ঞ, গাইনি, ডেন্টিস্ট, সার্জারিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে চিকিৎসক নেই হাসপাতালটিতে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনোকলজি ও অ্যানেস্থেশিয়ার চিকিৎসক নেই। ফলে হাসপাতালটিতে বড় ধরনের কোনো অপারেশন করা যায় না।

হাসপাতালটিতে এক্স-রে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন থাকলেও ল্যাব টেকনিশিয়ান, রেডিওলজিস্ট, আল্ট্রাসনোলজিস্ট না থাকায় কোনো ধরনের টেস্ট করা হয় না। ফলে রোগীরাও এসবের কোনো সুফল পায় না।

দেশের অধিকাংশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেরই এমন হাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ৫৮ শতাংশ উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।

সংসদ সদস্য এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবদুল আজিজ টিবিএসকে বলেন, 'অল্প কয়েকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই শুধু অপারেশন করা যায়।'

গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে কেবল সাধারণ সর্দি, কাশি, জ্বর ও মাথাব্যথার চিকিৎসা দেওয়া যায়।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোকে আরও সুসজ্জিত করার এবং গ্রামীণ বেসরকারি ক্লিনিকগুলোকে ভালোমতো মনিটরিংয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হকের মতে, ইউনিয়ন-উপজেলা-জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করলে সেকেন্ডারি বা টারশিয়ারি হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ কমবে।

তিনি টিবিএসকে বলেন, 'সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক, যন্ত্রপাতি, টেকনোলজিস্ট না থাকার কারণে রোগীরা আশপাশের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে বেশি অর্থ ব্যয় করেও মানসম্মত সেবাবঞ্চিত হয় মানুষ।'

বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রমরমা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৭ হাজার ৮৫৪টি নিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায়ই একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে।

বেসরকারি ক্লিনিকের সংখ্যা, তাদের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা ও রোগীদের 'আউট-অভ-পকেট' চিকিৎসাব্যয়ই প্রমাণ দেয় যে এই খাতের উদ্যোক্তারা গ্রামীণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা শূন্যতা পূরণ করছে।

সরকারি তথ্যানুসারে, কুমিল্লায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে ৪০০-র বেশি। মধ্যে কুমিল্লা নগরীতেই আছে দুই শতাধিক। বাকিগুলো উপজেলাকেন্দ্রিক।

বরিশাল জেলার প্রত্যেক উপজেলায় অন্তত একটি ক্লিনিক ও তিন-চারটি করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে। এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক চব্বিশ ঘণ্টা সেবা দেয়।

ওষুধ প্রস্তুতকারকদের মনোযোগ সরছে গ্রামাঞ্চলে

স্বাস্থ্যসেবার শূন্যতায় অনেকেই, বেশিরভাগ নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র, নিজেরাই ওষুধ কিনে খায়।

ওষুধ বাজারের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ওষুধের ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ওষুধ প্রস্তুতকারকরা তাদের বিক্রয়ের মনোযোগ গ্রামীণ ফার্মেসিগুলোতে সরাতে আগ্রহী হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত কয়েক বছরে ওষুধের দোকানের সংখ্যা ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই ২ হাজার ৭৩৩টি নিবন্ধিত ফার্মেসি রয়েছে, লক্ষ্মীপুরে ওষুধের দোকান আছে ২ হাজার ৫০০টিরও বেশি।

নভো হেলথকেয়ার অ্যান্ড ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফরিদউদ্দিন কাওসার খান বলেন, ভাইরাল ও সংক্রামক রোগ, অ্যালার্জি এবং গ্যাস্ট্রাইটিসের ওষুধের ভোক্তাবাজার শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে দ্রুত বাড়ছে।

তবে বিক্রির ধরন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কারণ অসংক্রামক রোগের ওষুধের চাহিদা এখন গ্রামাঞ্চলেও বেশি।

ফরিদউদ্দিন বলেন, দেশের সব এলাকাজুড়ে তাদের একটি দক্ষ বিপণন চ্যানেল রয়েছে।

'ঢাকায় নভোর যে ওষুধ পাওয়া যায়, নিঝুম দ্বীপ, সেন্টমার্টিনেও সে ওষুধ পাওয়া যায়,' টিবিএসকে বলেন তিনি।

৭০ শতাংশ রোগীকে দোরগোড়ায় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব

চলতি বছরের মে মাসে পরিচালিত একটি সমীক্ষা বলছে, গ্রামীণ হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ডাক্তার ও যন্ত্রপাতি থাকলে ৭০ শতাংশ রোগীকে তাদের দোরগোড়ায় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।

'বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত: বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ নির্দেশিকা' শীর্ষক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে উপজেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত সেবা নেই এবং মানুষ মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাচ্ছে না।

এতে বলা হয়, তৃণমূল পর্যায়ের হাসপাতালগুলো পর্যাপ্ত ও মানসম্মত চিকিৎসা দিতে পারলে ঢাকার হাসপাতালে রোগীর চাপ অনেক কমে যাবে।

প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যনীতি বিকেন্দ্রীকরণ এবং উপজেলা হাসপাতালগুলোকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্য সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, তারা গ্রামীণ হাসপাতাল পরিদর্শন করছেন এবং সেসব হাসপাতালে কী কী প্রয়োজন, তা নোট করছেন।

তিনি টিবিএসকে বলেন, 'হাসপাতালগুলোর ম্যাক্সিমাম লেভেলের যে সক্ষমতা, তা কীভাবে অর্জন করা যায় সে চেষ্টা করছি আমরা। এছাড়া ক্যান্সার, কিডনিসহ বিশেষায়িত কিছু হাসপাতাল বিভাগীয় শহরে করা হচ্ছে, যাতে ঢাকার ওপর চাপ কমে।'

রোগীরা যাতে বেসরকারি হাসপাতালে মানসম্মত সেবা পায়, সেজন্য বেসরকারি হাসপাতালগুলোও মনিটর করা হবে বলে জানান তিনি।

নভেম্বরে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে এক ভার্চুয়াল প্রোগ্রামে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও বলেন যে, তারা ইতিমধ্যে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় স্থানীয় হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করেছেন। ধীরে ধীরে অন্যান্য অঞ্চলের হাসপাতালও পরিদর্শন করবেন।

মন্ত্রী বলেন, 'অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারদের অনুপস্থিত পাওয়া গেছে। যন্ত্রপাতিও নষ্ট ছিল। এটি গ্রামীণ এলাকায় জনস্বাস্থ্যসেবার প্রধান সংকট।'

জাহিদ মালেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলেন, 'যদি কোনো শূন্য পদ থাকে বা কোনো মেশিন কাজ না করে, তাহলে দয়া করে আমাদের জানান।'

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন টিবিএসের খুলনা প্রতিনিধি আওয়াল শেখ, কুমিল্লা প্রতিনিধি তৈয়বুর রহমান সোহেল, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি সানা উল্লাহ সানু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি আজিজুল সঞ্চয়, নেত্রকোনা প্রতিনিধি সঞ্জয় সরকার ও সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম।

টিবিএসের প্রতিবেদনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top