কাগজ সিন্ডিকেটের কারসাজির কবলে পাঠ্যবই মুদ্রণ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৭ নভেম্বর ২০২২ ২২:৪৯; আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০৩

ফাইল ছবি

নির্ধারিত সময়ে মুদ্রিত হচ্ছে না পাঠ্যবই। সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সংকট সৃষ্টি করে বই ছাপানো প্রক্রিয়া বন্ধ করে রাখা হয়েছে। খবর যুগান্তরের।

অন্তত চারটি সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে বই মুদ্রণের কাগজ। সংকট মাথায় রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাগজের মানে কিছুটা ছাড় দিয়েছে। সেই অনুযায়ী ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা না থাকলেও বই সরবরাহের অনুমতি দেবে সরকার।

এ ক্ষেত্রে কাগজের পুরত্ব (জিএসএম) ঠিক রাখতে হবে। এই সিদ্ধান্তের কারণে দেশে যে পরিমাণ ‘ভার্জিন’ (অব্যবহৃত) পাল্প বা মণ্ড আছে, তার সঙ্গে ‘রিসাইকলড’ (ব্যবহৃত) পাল্প মিলিয়ে পাঠ্যবই মুদ্রণের কাজ শেষ করা সম্ভব ছিল।

কিন্তু কয়েকটি মিল, কাগজ ব্যবসায়ী, রিসাইকলড পাল্প তৈরির জন্য ব্যবহৃত (পুরোনো) কাগজ সরবরাহকারী এবং আর্ট পেপার ব্যবসায়ী-এ চার পর্যায়ে অসাধুরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন মুদ্রাকররা। অগ্রিম টাকা দিয়েও অনেকে চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না।

পাশাপাশি বাড়িয়ে দিয়েছে দাম। এতে ব্যাহত হচ্ছে পাঠ্যবই উৎপাদন। ফলে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রাথমিকের বই মুদ্রণ বন্ধ করে রেখেছেন তারা। এ অবস্থায় এখন পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ বই ছাপানো সম্ভব হয়েছে। অথচ শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি আছে আর মাত্র ৩৪ দিন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বই ছাপার কাজে স্থবিরতা সৃষ্টির পেছনে খোদ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরেরও (ডিপিই) কিছু দায় আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামী বছর ষষ্ঠ-সপ্তম এবং প্রথম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই দেওয়া হবে। এগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির পাণ্ডুলিপি গত সপ্তাহে দেওয়া হয়েছে মুদ্রাকরদের।

সপ্তম শ্রেণির অন্তত ২টি বইয়ের পাণ্ডুলিপি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণ বন্ধ হয়ে আছে। প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির বই ছাপানোর চুক্তির কাজ এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি এনসিটিবি। গত বছর নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই দেওয়ার অভিযোগে মুদ্রাকরদের কারও কারও জামানত (পারফরম্যান্স গ্যারান্টি-পিজি) এখনও আটকে রেখেছে ডিপিই।

এর পাশাপাশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে বিলের একটি অংশ ছাড় করছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন মুদ্রাকররা। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে অর্থায়নের (পিজি) নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না। এসব কারণই বই ছাপা কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কারণ বলে জানা গেছে।

কাগজ সংকট দূর ও এ নিয়ে সৃষ্ট সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মুদ্রাকর ও প্রকাশকরা বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন বলে জানা গেছে।

মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মুদ্রণ বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে-দেশে ভার্জিন পাল্পের কাগজ নেই বললেই চলে। মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে এ ধরনের কিছু কাগজ আছে। সংকটের সময়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে চান-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পেপার কিনে গুদামজাত করা বা রিসাইকল পাল্প তৈরির পুরোনো কাগজের দাম বাড়ানোয় সংকট আরও তীব্র হয়েছে।

তিনি মনে করেন, ‘রিসাইকলড’ পাল্পে উজ্জ্বলতায় ছাড় দিয়ে যথাযথ মানের কাগজে বই ছাপানো অনুমোদন করা হলে এখনও ১ জানুয়ারির আগে বইয়ের কাজ শেষ করা সম্ভব হতো। এ ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশে কাগজের বড় একটা সংকট আছে। এটি মাথায় রেখে রিসাইকলড পাল্পের কাগজ মাধ্যমিকের বইয়ে গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এরপরও কাগজের সংকটের সুযোগ নিচ্ছে তিন-চারটি পক্ষ। নতুন নতুন সিন্ডিকেট হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।

‘রিসাইকলড’ মণ্ডের সংকট থেকে উত্তরণের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গোডাউনে থাকা পুরোনো পাঠ্যবই শুধু কাগজ মিলগুলোকে ৪৩ টাকা প্রতি কেজি দরে দেওয়া হবে। এটা দিয়ে তারা মণ্ড তৈরি করে কাগজ বানাতে পারবেন।

এতে হয়তো কাগজের ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু ৮২ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণ করা হবে। আর এই নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে কেউ নিম্নমানের কাগজে বা নিউজপ্রিন্টে বই দিলে ছাড় দেওয়া হবে না।

সরকার এবার প্রথম থেকে নবম শ্রেণির জন্য সাড়ে ৩৩ কোটি পাঠ্যবই মুদ্রণ করছে। এরমধ্যে প্রাথমিক স্তরে ৯ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ৮১২টি বই। তার মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকে ৬৩ লাখ ২৯ হাজার ৮৪টি এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ২ লাখ ১৩ হাজার পাঠ্যবই রয়েছে। বাকিগুলো পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।

অন্যদিকে মাধ্যমিক পর্যায়ে (স্কুল, মাদ্রাসা ও কারিগরি) ২৩ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি বই ছাপানো হবে। এর মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৭ হাজার ৩৯৪টি বই। আর বিভিন্ন উপজেলায় সরবরাহ করা হয়েছে ৬ কোটি ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ১৯৭টি। এ হার ২৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।

সরবরাহকৃত বইয়ের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের বই আছে দেড় কোটির মতো। এরপর মুদ্রাকররা এই স্তরের (প্রাথমিক) বই ছাপা কাজ বন্ধ করে বসে আছেন। এর পেছনে দুটি কারণ পাওয়া গেছে। এগুলো হচ্ছে, ডিপিই কর্তৃক মুদ্রাকরদের গত বছরের জামানতের টাকা আটকে রাখা এবং বাজারে কাগজের সংকট।

জানা গেছে, কাগজ সংকটসহ অন্যান্য বিষয় সামনে রেখে ১৬ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী, সচিব এবং ডিপিই’র মহাপরিচালক, এনসিটিবির চেয়ারম্যান মুদ্রাকরদের নিয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে জামানতের অর্থ ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়।

পাশাপাশি দেশে ভার্জিন পাল্পের কাগজ কম থাকায় রিসাইকলড পাল্পের কাগজে বই ছাপানোর অনুমতির ব্যাপারেও আলোচনা হয়। কিন্তু সেই আলোচনার কোনো বাস্তবায়ন এখন পর্যন্ত হয়নি। এজন্য মুদ্রাকররা ডিপিই’তে কর্মরত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মাহফুজা বেগমকে দায়ী করছেন। তারা আরও বলছেন, ডিপিই থেকে একটি নির্দিষ্ট মিলের কাগজ ছাড়া অন্য কোনো মিলের কাগজ ছাড়পত্র পাচ্ছে না। ওই সভার পর ২ সপ্তাহ কেটে গেলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এ ব্যাপারে মাহফুজা বেগমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

মন্ত্রণালয়ের সভায় উল্লিখিত বিষয় আলোচনা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, জামানতের অর্থ আটকে থাকায় মুদ্রাকরদের বড় সমস্যা হচ্ছে বলে তারা প্রতিমন্ত্রী-সচিবকে অবহিত করেছেন। পাশাপাশি ডিপিই’র অসহযোগিতার কথাও বলেছেন।

গতবারের পিজি নগদায়ন করতে না পারায় এবারে চুক্তি করার জন্য তারা ব্যাংকে যেতে পারছেন না। এছাড়া বৈঠকে তারা মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিকেও কাগজের উজ্জ্বলতার ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানোর দাবি করেছিলেন মুদ্রাকররা। কিন্তু এর কোনোটিই এখন পর্যন্ত ডিপিই মানেনি। এ অবস্থায় বই মুদ্রণ বন্ধ থাকায় এনসিটিবি বিপাকে পড়ে গেছে।

কাগজ সংকটের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায় প্রমা প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের স্বত্বাধিকারী মো. মহসিনের বক্তব্যে। তিনি জানান, অক্টোবর-ডিসেম্বরে বই ছাপানোর কাগজ লাগে-বিষয়টি মাথায় রেখে তারা বিভিন্ন মিল মালিককে ৪-৫ মাস আগে অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখেন। কাগজের দৈনিক চাহিদা ৪ গাড়ি থাকলেও দেওয়া হচ্ছে ১ গাড়ি। দৃষ্টান্তস্বরূপ : তখন তাদের কেউ ৯০ হাজার টাকা প্রতি টন দরে টাকা দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সংকটের কারণে এখন নগদে যারা এর বেশি দিচ্ছেন, তাদের কাগজ আগে দিচ্ছে।

 

আবার রিসাইকল পাল্পের কাগজ অনুমোদনের কথা ছিল। মাধ্যমিক থেকে পাওয়া গেলেও দিচ্ছে ডিপিই। যে কারণে প্রাথমিকের কাজ বন্ধ করে এক প্রকার হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে তাদের। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক যুগান্তরকে বলেন, সংকটকে ব্যবহার করে বিসমিল্লাহ প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপার ও ইউসুফ এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মিল থেকে কাগজ কেনে গুদামজাত করে রেখেছে।

এছাড়া তারা কাগজের দামও বাড়িয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদের অগ্রিম টাকা দেওয়ার পরও মুদ্রাকরদের চাহিদা অনুযায়ী কাগজ দিতে গড়িমসি করছে। এতে বাজারে কাগজ সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখন সরকার যদি কাগজ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে না যায় তাহলে বই মুদ্রণ বন্ধ থাকবে। আর মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, অবস্থা এভাবে চলতে থাকলে জুনেও বই দেওয়া সম্ভব হবে না।

অভিযোগ অস্বীকার করে উল্লিখিত দুই পেপার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. ইসমাইল বলেন, যার কাছ থেকে যে দরে আগাম টাকা নেওয়া হয়েছে সেই দরেই কাগজ দিচ্ছি। সব মিল ‘বুক’ করে রাখার প্রশ্নই উঠে না। দেশে ১৫-২০টি মিল কাগজ উৎপাদন করে। এরমধ্যে তিনি মাত্র তিনটি মিল নিয়ে কাজ করেন। তবে এটা ঠিক যে, রিসাইকলড পাল্পে ৮০ শতাংশ উজ্জ্বলতার কাগজ উৎপাদন করতে পারে শুধু তাদের মিলগুলো। তিনি আরও বলেন, চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি যে এক টন কাগজও গুদামজাত করিনি। ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে।

কাগজ সংকটের কারণে কাজ নিয়েও এবার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনন্দ ও এপেক্স নামে দুটি প্রতিষ্ঠান আছে। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক রাব্বানী জব্বার যুগান্তরকে বলেন, তিনি অন্তত ৫ কোটি টাকার কাজ ফেরত দিয়েছেন। বাজারে কাগজের সংকট না থাকলে হয়তো এমন সিদ্ধান্ত তিনি নিতেন না। কিন্তু এরপরও তার এখন ত্রাহি অবস্থা। কেননা, মাধ্যমিক কাজ শেষ করতে কাগজ দরকার। মিলে আগাম টাকা দিয়ে রেখেও তিনি চাহিদামতো কাগজ পাচ্ছেন না। কাগজের পাশাপাশি কালি, বাঁধাইয়ের গ্লুর দাম এবং পরিবহণ ভাড়াও বেড়েছে বলে জানান তিনি।

যুগান্তরের প্রতিবেদনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top