গবেষণায় প্রতারণার হিড়িক, প্রত্যাহার রেকর্ড

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৩; আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৯:৩৬

ছবি: সংগৃহীত

পদ্ধতিগত ত্রুটি এবং চৌর্যবৃত্তির কারণে চলতি বছর রেকর্ড ১০ হাজারের বেশি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে। সংখ্যাটি এত বড় যে ভুয়া নথিপত্র এবং পিয়ার রিভিউ জালিয়াতি সরিয়ে ফেলতে প্রকাশকদের বেগ পেতে হচ্ছে। বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি গবেষণাপত্র তৈরি হয়—এমন দেশগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গবেষণাপত্র প্রত্যাহার হয়েছে সৌদি আরব, পাকিস্তান, রাশিয়া ও চীনা গবেষকদের। দুই দশকের মধ্যে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। খবর আজকের পত্রিকা।

২০২৩-এর বাতিল হওয়া গবেষণাপত্রের বেশির ভাগই গবষেণা প্রকাশনা সংস্থা ‘হিন্দাউই’-এর। এই প্রকাশনা সংস্থাটি লন্ডনভিত্তিক প্রকাশক উইলির সহযোগী প্রতিষ্ঠান।

অভ্যন্তরীণ সম্পাদকদের অনুসন্ধান এবং গবেষণার সততা বিশ্লেষণে অসংলগ্ন টেক্সট ও অপ্রাসঙ্গিক রেফারেন্স (উদ্ধৃতি) নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর হিন্দাউই এখন পর্যন্ত আট হাজারেরও বেশি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করেছে। হিন্দাউই থেকে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়ায় প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া’ এবং ‘প্রকাশনা পদ্ধতি ও পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার’।

হিন্দাউইয়ের বেশির ভাগ গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের পেছনে বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। সাধারণত এসব কারণ আগে কখনো চিহ্নিত হয়নি। গবেষণাপত্রের বেশির ভাগ নিবন্ধ গেস্ট এডিটর বা অতিথি সম্পাদকেরা তত্ত্বাবধান করেছেন। নিম্নমানের বা দ্রুত জাল কাগজপত্র তৈরি করতে প্রতারকেরা এ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়।

৬ ডিসেম্বর উইলি ঘোষণা করে, তারা হিন্দাউই ব্র্যান্ড নামটির ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করবে। এর আগে চারটি ক্ষেত্রে হিন্দাউই ব্র্যান্ড নাম প্রত্যাহার করেছে তারা। ২০২২ সালের শেষের দিকে বিশেষ (ত্রুটিপূর্ণ বা জাল) প্রকাশনাগুলো স্থগিত করা হয়। তবে বিদ্যমান গবেষণাপত্রগুলোতে নিজস্ব ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করবে উইলি। উইলির অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান নির্বাহী ম্যাথিউ কিসনার বলেছেন, এই করতে গিয়ে চলতি অর্থবছরে প্রকাশক প্রতিষ্ঠানটি ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৪ কোটি ডলার রাজস্ব হারাতে পারে।

উইলির একজন মুখপাত্র বলেন, আরও অনেক গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করতে হতে পারে। তবে নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা তিনি জানাননি।

সংস্থাটি মনে করে, ‘বিশেষ (ত্রুটিপূর্ণ বা জাল) প্রকাশনাগুলো গবেষক সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।’ অর্থাৎ এগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ঝুঁকি এড়াতে গেস্ট এডিটরদের পরিচয় নিশ্চিত হতে এবং পাণ্ডুলিপি তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে আরও কঠোর নিয়ম চালু করেছে উইলি। এরই মধ্যে শত শত সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গেস্ট এডিটরের ভূমিকায় ছিলেন। সেই সঙ্গে গবেষণার সততা বিশ্লেষক দলে সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রকাশক এবং গবেষণার তথ্য-উপাত্ত ও টুল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারকদের বিষয়ে তথ্য শেয়ারের জন্য ‘আইনগত প্রক্রিয়া’ দাঁড় করাচ্ছে উইলি।

ফ্রান্সের টুলুস বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী গুইলাম ক্যাবানাক বলেন, ‘হিন্দাউইয়ের প্রত্যাহার করা গবেষণাপত্রের বেশির ভাগই বানোয়াট। তবে সেগুলো এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজারেও বেশিবার বিভিন্ন গবেষণায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।’

গুইলাম ক্যাবানাক মূলত গবেষণাপত্রে নানা ধরনের সমস্যা শনাক্তকরণের কাজ করেন। তাঁর কাজের মধ্যে রয়েছে—চৌর্যবৃত্তি (প্লাজিয়ারিজম) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তৈরি কনটেন্ট শনাক্তকরণ টুলকে ফাঁকি দিতে গবেষণাপত্রে ‘অদ্ভুত শব্দচয়ন’। গুইলাম বলেন, ‘এ ধরনের সমস্যাজনক গবেষণাপত্র কিন্তু রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

ইদানীং গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের হার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তা বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র তৈরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের মোট সংখ্যা ৫০ হাজার পেরিয়ে গেছে। অবশ্য বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব সময় যে অসদুপায় অবলম্বনের জন্য গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করা হয় এমন নয়; কখনো কখনো গবেষক নিজেই ভুল স্বীকার করে তাঁর গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করান।

গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের ঘটনা সংকলনের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক ডেটাবেজ তৈরি করে মিডিয়া সংস্থা রিট্র্যাকশন ওয়াচ। তারা ২০২৩ সালে প্রত্যাহার করা গবেষণাপত্রগুলো এখনো তাদের ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করেনি।

ডেটাবেজের প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে নেচার ম্যাগাজিন ৪৫ হাজার গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের তথ্য সংগ্রহ করেছে। ক্রসরেফ নামের একটি অলাভজনক সংস্থা ডাইমেনশনস নামে আরেক সংস্থার সহায়তায় গত সেপ্টেম্বরে এই তথ্য উন্মুক্ত করে। ওই ডেটাবেজের মধ্যে হিন্দাউই ও অন্য প্রকাশকদের পাঁচ হাজার গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের তথ্য রয়েছে।

গবেষণাপত্র প্রকাশের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রত্যাহারের অনুপাতও ব্যাপকভাবে বাড়ছে। নেচারের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক দশকের মধ্যে গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের হার তিন গুণ হয়েছে। ২০২২ সালে প্রকাশ ও প্রত্যাহারের অনুপাত দশমিক ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

নেচার ম্যাগাজিনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে দেশগুলো থেকে দুই দশকে এক লাখেরও বেশি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে সৌদি আরবের হার সর্বোচ্চ। প্রতি ১০ হাজার গবেষণাপত্রের মধ্যে ৩০টি প্রত্যাহার করা হয়েছে। কনফারেন্স পেপার বাদে এই সংখ্যা হিসাব করা হয়েছে। আর যদি কনফারেন্স পেপার অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে চীন শীর্ষ অবস্থানে থাকবে। অন্তত একজন লেখক চীনা এমন গবেষণাপত্রগুলো এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

চীনা গবেষকদের যেসব গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার অধিকাংশই করেছে নিউইয়র্ক শহরের ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইই)। এই সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারে ৩০টির বেশি।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রত্যাহারের মোট সংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ কনফারেন্স পেপার এবং সেগুলোর বেশির ভাগই প্রত্যাহার করেছে আইইই। গত দুই দশকে প্রায় ১০ হাজারের বেশি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রত্যাহার করা গবেষণার কোনো রেকর্ড রাখে না প্রতিষ্ঠানটি। তবে দেখা গেছে, এসবের বেশির ভাগই ২০১০ ও ২০১১ সালের মধ্যে প্রকাশিত।

এ ধরনের প্রতারণা ঠেকানোর উপায় কী। এ নিয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। যদিও এরই মধ্যে প্রযুক্তিগত উন্নতি এ ধরনের প্রতারণা প্রতিরোধে যথেষ্ট কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

আইইইয়ের করপোরেট কমিউনিকেশনের ডিরেক্টর মনিকা স্টিকেল বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মান রক্ষিত হয় না—এমন গবেষণাপত্র শনাক্তে তাঁরা সক্ষম বলে তাঁর বিশ্বাস।

তবে কেমব্রিজের হার্ভার্ড ল স্কুলের প্রযুক্তি আইনজীবী ক্যাবানাক ও কেন্দ্রা আলবার্ট দেখেছেন, গত কয়েক বছরে আইইই প্রকাশিত শত শত গবেষণাপত্রে প্রতারণামূলক শব্দ চয়ন, উদ্ধৃতি জালিয়াতি ও প্লাজিয়ারিজমের মতো সমস্যা পাওয়া গেছে। রিট্র্যাকশন ওয়াচ চলতি বছরের শুরুতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

স্টিকেল বলেন, আইইই সেই গবেষণাপত্রগুলো পর্যালোচনা করেছে এবং এর মধ্যে ৬০টির কিছু কম গবেষণাপত্র মানসম্মত নয় বলে শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩৯টি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই ৫০ হাজার বা বিশ্বব্যাপী প্রত্যাহারের যে হিড়িক দেখা যাচ্ছে ,তার আসলে একটি নগণ্য অংশই প্রকাশ্যে এসেছে। অনেকে বলছেন, ভুয়া গবেষণার সংখ্যা লাখ লাখ হতে পারে।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top