বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বক্ষেত্রে জামায়াতের অনুসারী বেশি: কুবি উপাচার্য

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ৩১ মার্চ ২০২৪ ১৮:৪২; আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৫৬

ছবি: সংগৃহীত

মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর বৃত্তি প্রচলন, সেশন জট দূরীকরণে কেন্দ্রীয়ভাবে একাডেমিক ক্যালেন্ডার প্রবর্তন, শিক্ষকদের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড চালু, সরকারের কোষাগারে তিন কোটি টাকা ফেরতসহ গুণগত নানা পরিবর্তন এনে ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিংয়ে ৮ নম্বর স্থান, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে (এপিএ) দশম স্থান লাভ করে নব প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এর উপাচার্যকে (ভিসি) নিয়ে চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বক্ষেত্রে জামায়াতের অনুসারীদের আধিক্য রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করেন।

এ সময় তিনি কুবির কয়েকজন নেতৃত্বাস্থানীয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক দাবি উত্থাপন করেন। আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি ও ক্লাস না করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করে বলেও অভিযোগ করেন।

ড. আবদুল মঈন বলেন, ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক পরিবেশ নিয়ে প্রশংসার পরিবর্তে বারবার নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ছিল না।

২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে লিডিং ও মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্ভাবনে নেতৃত্ব, উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা, মানব কল্যাণ এবং টেকসই প্ল্যানেট গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে আমি অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি ভিশন তৈরি করি এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করি।

পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আয় থেকে মানসম্পন্ন প্রবন্ধ প্রকাশনায় উদ্বুদ্ধ করতে শিক্ষকদের জন্য ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড ও স্বীকৃতি প্রদান, শিক্ষকদের প্রকাশনার জন্য সম্পাদকীয় প্রণোদনাসহ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস ও জিএমএটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফিস প্রদান করা, গবেষণার মান বৃদ্ধিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানের বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।

ভিসি দাবি করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতিমুক্ত প্রকিউরমেন্ট ও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যের সংস্কৃতি বন্ধ করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৯৫ শতাংশ কেনাকাটা ইজিপির মাধ্যমে করা হচ্ছে। গুণগতমানহীন আসবাবপত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কোটি টাকার টেন্ডার বাতিল করা, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ না করায় জরিমানা আরোপ করি। ফলে প্রথম বছরে সকল উন্নয়ন কাজের অতিরিক্ত ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন ব্যয় করার পরও সরকারের তহবিলে তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের কর্মের গতিশীলতা বৃদ্ধি ও তাদের পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিসহ সেবা প্রদান করার জন্য প্রফেশনাল প্রশিক্ষণ চালু করা হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পরে ছয় মাসের মধ্যে দুর্নীতির কারণে ২০১৪ সাল থেকে চলমান স্থবির একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে এই প্রকল্পের আওতায় ছাত্রীদের জন্য ‘শেখ হাসিনা’ নামে একটি হলসহ চারটি স্থাপনা করা হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ সিনিয়র পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীই স্বাধীনতার মূল্যবোধের বিপক্ষের আদর্শের অনুসারী ছিলেন। স্থানীয় প্রভাবশালীরা আদর্শের পরিবর্তে টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বক্ষেত্রে জামায়াতের অনুসারীদের আধিক্য রয়েছে। এদের অনেকেই বর্তমানে দুই দলে ভাগ হয়ে সবাই আওয়ামী লীগের লেবাস ধরেছে এবং দুইটি বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করে রাজনীতি করছে। এদের মধ্যে নেতৃত্বে রয়েছে ছাত্র অবস্থায় সরাসরি জড়িত শিবিরের সাথী কাজী কামাল, ফয়জুল ইসলাম ফিরোজ, শামীমুল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান, রেল নাশকতার মামলার আসামির ভাই ড. আবু তাহের এবং বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ব্যক্তিরা।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কুবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জয়ের পরই ড. আবু তাহের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে সমিতির নেতারা উপাচার্যকে কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে অবরুদ্ধ করে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। শিক্ষকদের পদোন্নতিতে মানসম্পন্ন প্রকাশনার শর্ত থাকলেও সমিতির নেতারা তা তুলে নেওয়ার দাবি করেন এবং অন্যথায় পদত্যাগ করার দাবি জানান। এছাড়া শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় বাধা দেন। শিক্ষক সমিতির অতীতের মত এবারও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে। শিক্ষক সমিতির এই চিহ্নিত নেতাগণ প্রত্যেক উপাচার্যের সময় একই ধরনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

তারা উপাচার্যের কাজে প্রভাব বিস্তার, নিয়োগে প্রভাব বিস্তার করে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী পদের প্রার্থীদের থেকে অর্থনৈতিক লেনদেন, টেন্ডার কাজে হস্তক্ষেপ ও অর্থ আত্মসাৎ, ভূমি বাণিজ্য অবৈধ পদ সুযোগ-সুবিধা নিতে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে উপাচার্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করার মাধ্যমে হেয় ও জিম্মি করার মতো কাজ করেছেন। শিক্ষার্থীদেরকে হুমকি, কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে খারাপ আচরণসহ অবৈধ কাজ করতে উপাচার্যকে বাধ্য করা, ক্লাস না নিয়ে কোর্স শেষ করা, ইনকোর্স নম্বর হেরফের করা, যৌন হয়রানি, মার্ক টেম্পারিংয়ের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে।

একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ও একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করার ঘটনাও রয়েছে মেহেদী হাসানের কর্মজীবনে। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সিমেন্ট কোম্পানি থেকে আয়ের এক চতুর্থাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত তিনি জমা দেননি। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে এক বছরে নির্ধারিত সংখ্যক কোর্স শেষ করতে না পারায় বাতিল করা হয় মেহেদী হাসানের ফেলোশিপ। তিনি দেড় বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য প্রথমে দুই বছরের ছুটি ভোগ করেন। পরবর্তীতে বিনা বেতনে এক বছরের ছুটি ভোগ করেন। সর্বশেষ ১০ মাস ২৬ দিনের অসাধারণ ছুটি কাটান তিনি। পরবর্তীতে তিনি আরও ছুটি চাইলে কুবির সিন্ডিকেট সভায় তা নাকচ হয়। এরপর থেকেই ছুটি বাগিয়ে নিতে উঠে পড়ে বিরুদ্ধে লাগেন তিনি।

ভিসি অভিযোগ করেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু তাহেরের নামেও আছে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ ও বিতর্ক। ২০১১ সালে ৪৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৮ দশমিক ৪ কিলোওয়াটের একটি সোলার প্যানেল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন তিনি। ওই বছরই সোলার প্যানেলটি অকেজো হয়ে পড়লেও ড. তাহের তাদের দিয়ে তা মেরামত না করিয়ে বাকি অর্থ দিয়ে দেয়। তখনই বাংলাদেশ অল্টারনেটিভ এনার্জি সিস্টেম লিমিটেড নামে নিম্নমানের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সরেজমিন অভিযানেও প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে বলে ২০২৩ সালে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছিলেন কর্মকর্তারা।

ভিসি অধ্যাপক মঈন বলেন, প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ঘিরে সাবেক উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার ড. আবু তাহের দুর্নীতির সুবিধার্থে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজে নিজের গ্রুপের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে যুক্ত করেন। এছাড়া রেজিস্ট্রার থাকাকালীন অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা ঘটে। পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিজ কোরামের শিক্ষকদের পদোন্নতি দ্রুত দিলেও অপছন্দের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতিতে গড়িমসি করতেন।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ছাড়াও কার্যনির্বাহী পরিষদে রয়েছে আরও বিতর্কিত শিক্ষক। ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন ও ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী শিক্ষকদের স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে বন্যাদুর্গতদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান দেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাৎ প্রচেষ্টায় অভিযুক্ত। এ জন্য তাদের শিক্ষক সমিতির সদস্যপদ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছিল শিক্ষক সমিতি। এছাড়া এই তালিকায় আছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামিমুল ইসলাম। এসব শিক্ষকই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এফ এম আবদুল মঈন।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top