নির্বাচনী হালচাল রাজশাহী-৩: একক প্রার্থীতে এগিয়ে জামায়াত

বঞ্চিতদের চাপে বেকায়দায় বিএনপি

মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:৫২; আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:০১

ডানে: জামায়াত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ, বামে: বিএনপি প্রার্থী শফিকুল হক মিলন
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজশাহী-৩ আসনের রাজনৈতিক সমীকরণ দ্রুত বদলাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনে এবার ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। একক প্রার্থী নিয়ে তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। অপর দিকে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের অসন্তোষ আর অসহযোগীতায় বেকায়দায় পড়েছে বিএনপি। প্রার্থী বদলের দাবিতে এখনও মাঠে রয়েছে মনোনয়ন প্রত্যাশীর অনুসারী নেতা-কর্মীরা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটার উপস্থিতি শতকরা ৬০ ভাগ ছাড়ালেই পাল্টে যেতে পারে ভোটের ফলাফল।
রাজশাহী-৩ আসনটি ২০০৮ সালে সিটি করর্পোরেশনের উপকণ্ঠ পবা ও মোহনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত। এখানে ভোটার ৪ লাখ ১৬ হাজার ৯’শ ৯জন। এরমধ্যে পুরুষ দু’লাখ ৭ হাজার ৮০, মহিলা দু’লাখ ৯ হাজার ৮’শ ২৪ ও থার্ড জেন্ডার ৫ জন। বিগত ১২টি নির্বাচনের বিতর্কিত ৬টি নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এছাড়া বিএনপি চার বার এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী দু’বার নির্বাচিত হন।
ত্রয়োদশ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক ও মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। আর জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়র পেয়েছেন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ও বেলপুকুর আইডিয়াল কলেজের সাবেক সহকারি অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। এই আসনটিতে শহর কেন্দ্রিক রাজনীতির অনেকটা প্রভাব পড়ে। এখানে নগর ও গ্রামের দুই ধরনের ভোটারের সমন্বয় রয়েছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, সরকারি চাকরিজীবী ও কৃষিনির্ভর জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এখানে উল্লেখযোগ্য। অতীতের নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি ছিল এবং দলীয় পরিচয়ের পাশাপাশি প্রার্থীর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ও সাংগঠনিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক সময়ে বিএনপির ঘাঁিট হিসেবে পরিচিত এই আসনে ২০০৮ সালের পরবর্তী সময় থেকে আওয়ামী লীগের দখলে ছিল। তবে এইবার আসন ফেরত চায় বিএনপি। অন্যদিকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনোনয় দিয়ে জামায়াতে ইসলামী কৌশলগত ভাবে এগিয়ে রয়েছে। জানা গেছে, জামায়াত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ গত ২৭ বছর ধরে টানা হড়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দ্বায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর কাশিয়াডাঙ্গা থানা শাখার সুরা কর্মপরিষদ সদস্য। বিগত আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির সরকারের আমলে উভয় দলের নানা কৌশল ও কারিশমা কখনো অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদকে জনতার রায় বঞ্চিত করতে পারেননি। যার কারণে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ জামায়াতের বিপক্ষে অভ্যন্তরীণ চাপে থাকা বিএনপির আসনটির জয় নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এদিকে বিএনপির দলীয় প্রার্থী ঘোষণার পরও জেলা বিএনপির সদস্য রায়হানুল আলম রায়হান ও সাবেক ভূমিপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কবির হোসেনের পুত্র নাসির হোসেনের অস্থির সমর্থকেরা প্রার্থী বদলের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। গত ১০ নভেম্বর রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের চৌদ্দপাই এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন এই আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত নাসির হোসেনের অনুসারীরা। এ সময় টায়ারে আগুন জ্বালাতে গিয়ে নিজের গায়ে আগুন লাগে ছাত্রদল নেতা শহীদুল ইসলামের। গত ১১ নভেম্বর এই শহীদুলকে ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ। একইদিনে রায়হানুল হকের অনুসারীরা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে মনোনয়ন বদলের দাবি করেন। তবে ২২ নভেম্বর সড়ক অবরোধের ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রার্থী বিতর্ক আরও তীব্র আকার ধারণ করে। তাদের অভিযোগ তিনি দীর্ঘদিন ‘নিস্ক্রিয়’ ছিলেন দলীয় সংকটে মাঠে পাওয়া যায়নি এবং স্থানীয় নেতাদের মতামত নেয়া হয়নি। তিনি দীর্ঘদিন স্থানীয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন এবং রাজশাহী-২ (সদর) আসনের ভোটার। এই কারণে তৃণমূলের মধ্যে তাঁর প্রতি ‘আস্থাহীনতা’ তৈরি হয়েছে। গুরুতর অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের উপর চাপ দিয়ে শফিকুল হক মিলন মনোনয়ন নেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঘোষণা দেন, প্রার্থী পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এনিয়ে এলাকায় চরম উত্তেজনা রয়েছে। এদিকে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রায়হানুল আলম দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। তিনি দীর্ঘ দিন রাজশাহী জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন দীর্ঘদিন। গত দুইটি সংসদ নির্বাচনে তিনি এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চান। স্থানীয় ভাবে তারও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তৃণমূল পর্যায়ে মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা-কর্মীদের একটি অংশ এখনো সক্রিয়ভাবে মাঠে নামেননি। কেউ কেউ নীরব অবস্থান নিয়েছেন, আবার কেউ কেউ বিকল্প রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এতে করে নির্বাচনী প্রচারে কাঙ্খিত গতি পাচ্ছে না দলটির। ফলে দলের বৃহত অংশের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে ঠিকমতো গণসংযোগেও মাঠে নামতে পারছেন না।
অপর দিকে জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকেই একক প্রার্থী ঘোষণা করে কেন্দ্রভিত্তিক সংগঠন শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেয়। ভোটার তালিকা বিশ্লেষণ, বাড়ি-বাড়ি যোগাযোগ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় প্রচারণা তাদের প্রস্তুতির অংশ। স্থানীয় পর্যায়ে ধর্মীয় ও সামাজিক নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে জামায়াত একটি স্থিতিশীল ভোটব্যাংক ধরে রাখার কৌশল নিয়েছে।
এই আসন থেকে নির্বাচনে লড়াই করার জন্য প্রস্তুতির কথা শোনা যাচ্ছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণসংহতি আন্দোলনের জুয়েল রানা, ইসলামী আন্দোলনের ফজলুর রহমান এবং খেলাফত মজলিসের গোলাম মোস্তফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের। কিন্তু দলগুলোর নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা বা নির্বাচন কেন্দ্রীক কোনই তৎপরতা নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি বিএনপি দ্রুত অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে, তবে একক প্রার্থীর সুবিধা নিয়ে জামায়াত ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি দ্রুত কোন্দল নিরসন করে ঐক্য গড়ে তুলতে পারে, তবে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি । আর ঐক্য ব্যর্থ হলে একক প্রার্থীর সুবিধা নিয়ে জামায়াত এগিয়ে থাকবে। তবে ভোটের ফল নির্ভর করবে ভোটার উপস্থিতি, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা এবং নির্বাচনী পরিবেশের ওপর।


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top