একাট্টা জামায়াতে বাড়ছে জনসমর্থন
রাজশাহী-৫: অনৈক্যে ভাঙছে বিএনপির ঘাঁটি
শাহ্ সুফি মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:০১; আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৪৩
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে বাড়ছে নির্বাচনী উত্তাপ। ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে প্রার্থীরা দিন-রাত মাঠে সক্রিয় রয়েছেন।
এখানে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির প্রবীণ নেতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল। মনোনয়ন ঘোষণার পর জনগণ থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ আখ্যা দিয়ে দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীরা রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন। ফলে আসনটিতে বিএনপির রাজনীতি চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। অন্যদিকে দলীয় ঐক্য ও সংগঠিত কর্মসূচির মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এই পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষনে দেখা যায়, অনৈক্যে ভেঙ্গে পড়ছে বিএনপির এক সময়ের শক্ত ঘাঁটি। আর একাট্টা জামায়াতে জনসমর্থন বেড়েই চলেছে।
পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৫। মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫৩ হাজার ১৭৩ জন। অতীতে এই আসন বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রয়াত নেতা অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা টানা দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পান পুঠিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল। তিনি এবারও বিএনপির দলীয় প্রার্থী।
মনোনয়ন ঘিরে বিএনপিতে তীব্র ক্ষোভ
কিন্তু চলতি নির্বাচনে রাজশাহী-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে মাঠে নামেন অন্তত হাফ ডজন প্রার্থী। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক,বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা হাবিবা,জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল,শিল্পপতি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার,পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি খায়রুল হক শিমুল,এবং প্রয়াত এমপি নাদিম মোস্তফার পুত্র জুলকার নাঈম মোস্তফা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন আবারও অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে দেওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির ভেতরে সৃষ্টি হয় চরম বিভাজন। স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
বিক্ষোভ, মিছিল ও সড়ক অবরোধ
মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের অনুসারীরা বিভিন্ন স্থানে সভা, মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। গত ২১ নভেম্বর পুঠিয়া উপজেলায় মশাল মিছিল করে তারা মহাসড়ক অবরোধ করেন।২৫ নভেম্বর দুর্গাপুরে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তোলা হয়। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতন, মামলা ও জেল-জুলুম সহ্য করে যারা রাজপথে সক্রিয় ছিলেন, তাদের বাদ দিয়ে একজন ‘জনবিচ্ছিন্ন’ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।স্বতন্ত্র প্রার্থিতা ও বিএনপির মাঠ দুর্বল এই ক্ষোভের ধারাবাহিকতায় প্রয়াত এমপি নাদিম মোস্তফার পুত্র জুলকার নাঈম মোস্তফা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। ২০ ডিসেম্বর দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় থেকে তার পক্ষে মনোনয়নপত্র উত্তোলন করা হয়।এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের সাবেক ও বর্তমান বহু নেতা-কর্মী। এতে স্পষ্ট হয়, মাঠপর্যায়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডল দলীয় সহযোগিতা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছেন। ফলে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন।
জামায়াতের সংগঠিত প্রচারণা
বিএনপির এই টালমাটাল অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে মাঠে সক্রিয় হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির একক প্রার্থী হিসেবে পুঠিয়া উপজেলা আমীর মাওলানা মুনজুর রহমান নিয়মিত গণসংযোগ ও সাংগঠনিক কর্মসূচি চালাচ্ছেন। স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচারণা চালানোয় দলটির জনসমর্থন বাড়ছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের রুহুল আমিন, খেলাফত মজলিসের মুফতি আব্দুল হামিদ, এলডিপির জহুরা শারমিন এবং জেলা এনসিপির সদস্য আবির চৌধুরী নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রচার চালাচ্ছেন।
ভোটারদের প্রত্যাশা
দীর্ঘ ১৭ বছর পর একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সুযোগ পেতে যাচ্ছেন রাজশাহী-৫ আসনের ভোটাররা। বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা। তারা দলীয় কোন্দলের রাজনীতি নয়, বরং এমন একজন প্রার্থী চান—যিনি নির্বাচিত হয়ে দল বা গোষ্ঠীর নয়, সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজশাহী-৫ আসনের ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করবে বিএনপি নিজেদের ভেতরের দ্বন্দ্ব কত দ্রুত সামাল দিতে পারে এবং জামায়াত তাদের সংগঠিত শক্তিকে কতটা ভোটে রূপ দিতে সক্ষম হয় তার ওপর। এদিকে দীর্ঘ ১৭ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ নির্মূলে সোচ্চার তরুণ ভোটাররা। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো প্রতিষ্ঠিত হোক গণতন্ত্র এমনই প্রত্যাশা তাদের। ভোটাররা চান যোগ্য প্রার্থী। যিনি নির্বাচিত হয়ে কোন দল বা গোষ্ঠির নয়, সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করবেন এই তাদের প্রত্যাশা।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: