ঋণের টাকায় আর ভর্তুকি নয়

রাজটাইমস ডেস্ক:  | প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২২ ২২:১৩; আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ২৩:৩৬

ছবি: সংগৃহিত

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) জ্বালানি খাত সংস্কারে কঠিন শর্ত আরোপ করেছে। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে। এর মধ্যে রয়েছে এই খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বালানির বিভিন্ন উপকরণের দাম বাড়াতে হবে। দাম কমলে দ্রুত তা সমন্বয় করতে হবে।

তাদের বক্তব্য ভর্তুকির বড় অংশই আসে ঋণ থেকে। তাই ঋণের টাকায় ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। জ্বালানি আমদানির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে। প্রতিটি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানির অপচয়ে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করতে হবে। এসব শর্ত মানলে আসবে ঋণ। খবর যুগান্তরের ।

সূত্র জানায়, আইএমএফের ঋণ পেতে এই শর্তগুলো স্বল্প মেয়াদে বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছে। বাকি শর্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে অঙ্গীকার করতে হবে। একই সঙ্গে কোন সময়ের মধ্যে শর্তগুলো বাস্তবায়ন করা হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও পরিকল্পনা জানাতে হবে সংস্থাটিকে। এ বিষয়ে ঢাকা সফররত আইএমএফ মিশন অর্থ মন্ত্রণালয় ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করার কথা রয়েছে।

ইতোমধ্যে আইএমএফ অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই সেক্টরের ভর্তুকির পরিসংখ্যান, জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি আমদানির প্রক্রিয়া ও ঋণ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমদানি প্রক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে।

গত জুলাই মাসে আইএমএফের যে মিশন ঢাকায় এসেছিল তারাই এসব শর্ত দিয়ে গেছে। ওই শর্তের আলোকে গত আগস্টে সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪৯ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। গত জুনে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ২৩ শতাংশ। এলএনজির দাম প্রতি ঘনমিটার ৯ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১১ টাকা ৯১ পয়সা করা হয়েছে। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এসবের ওপর নির্ভরশীল বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এ কারণে বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) শুনানি শেষে মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি।

সরকারের হিসাবে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতে এখনো ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে আইএমএফও ভর্তুকি কমানোর শর্ত দিয়েছে। যে কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চাপও রয়েছে। কিন্তু সরকার মূল্যস্ফীতির চাপ, দেশব্যাপী তীব্র লোডশেডিং, শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংকট ও মানুষের জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় নিয়ে দাম বাড়ায়নি। কিন্তু আইএমএফ জানিয়েছে, ভর্তুকি কমাতে হলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চলতি আইএমএফ মিশন ঢাকায় আসার আগেই সরকার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এটা আইএমএফের অন্যতম শর্ত ছিল। এখন ভর্তুকির চাপ কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ালেই আইএমএফের প্রধান শর্তও বাস্তবায়ন হবে।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সব সময়ই জ্বালানি তেল, গ্যাস, রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ওঠানামা করে। করোনার সময়ে এগুলোর দাম একেবারে সর্বনিম্নে চলে এসেছিল। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ২০ ডলারে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের দাম কমার সেই সুফল দেশের মানুষ পায়নি। কেননা এগুলোর দাম সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে কমানো হয়নি।

অপরদিকে করোনার পর হঠাৎ করে চাহিদা বাড়ায় সব ধরনের জ্বালানির দাম বাড়তে থাকে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ফলে এগুলোর আমদানি খরচ বেড়ে যায়। তাতে বড় ধরনের রিজার্ভে চাপ শুরু হয়। বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতির হার। বাধ্য হয়ে সরকার ভর্তুকি দিতে থাকে।

আইএমএফের বক্তব্য, সরকার রাজস্ব বা ঋণের টাকায় ভর্তুকি দিচ্ছে। এতে রাজস্ব আয়ের টাকা উন্নয়ন খাতে চলে যাচ্ছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঋণের টাকায় ভর্তুকি দিলে অর্থনীতিতে প্রবল নেতিবাচক চাপ তৈরি হয়। ঋণের টাকায় বাজেট স্ফীত হয়। বাড়তে থাকে সুদের পরিমাণ, যা বাজেটকে বড় ধরনের বোঝায় পরিণত করে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভর্তুকি দিলে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে সরকার ব্যাংক থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের একই সময়ে নিয়েছিল ৩৪০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ। এর মধ্যে গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১০ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা আগের ঋণ পরিশোধ করেছিল। ওই সময়ে নতুন কোনো ঋণ নেয়নি। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।

আইএমএফের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের কারণে মূল্যস্ফীতিতে বেশি চাপ পড়ছে। ঋণের বড় অংশই খরচ হচ্ছে ভর্তুকিতে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় এ খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ফলে ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে।

চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৩ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ছিল ৫৪ হাজার কোটি টাকা। পণ্যের দাম বাড়ায় তা বেড়ে ৬৭ হাজার কোটি টাকা হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি আরও বাড়াতে হবে। চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানি বাবদ ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং বিদ্যুৎ খাতে ১৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ রাখা হয়েছে।

আইএমএফ মনে করে, ভর্তুকি একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে দেয় না। ভর্তুকির টাকাও কোনো না কোনোভাবে জনগণের কাছ থেকে আসে। ফলে ভর্তুকি কমিয়ে জনগণকে অন্য খাতে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোও কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেয়। ফলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিতে হলে ভর্তুকি একেবারে তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।

জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার কাঠামো এখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। আগে এটি গড়ে তুলতে হবে। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এটি হলে জ্বালানির দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। জ্বালানি তেল আমদানিতে সরকারের একটি ঘোষিত নীতি থাকা দরকার বলে মনে করে আইএমএফ। সরকার এ ব্যাপারে কাজ করছে বলে আইএমএফকে জানিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় পাবে সরকার। জ্বালানির অপচয় বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। এজন্য তেল আমদানি প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ করার কথাও বলা হয়েছে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বাড়ানো না হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের জন্য আসন্ন অর্থবছরে ৩৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। যা চলতি বছরের চেয়ে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা।

জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে তার মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের জন্য প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা আর জ্বালানি ও খনিজসম্পদ খাতের জন্য ১৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে ভর্তুকির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা গত পাঁচ অর্থবছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৪ হাজার ৯২০ কোটি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৮ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, ‘অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে জ্বালানি সংকট উত্তরণের জন্য ভর্তুকির প্রয়োজন রয়েছে। দেশে প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। এ চুরি বন্ধ করা গেলে স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কিনতে হতো না। জ্বালানির খাতে স্বনির্ভরতা অর্জনে নেতৃত্বের ব্যর্থতা রয়েছে। আমরা এখনো কয়লা ও গ্যাস অনুসন্ধানে অনেক পিছিয়ে আছি।

তিনি বলেন, ‘সরকার জ্বালানি সংগ্রহে যতটা তৎপর জ্বালানি সাশ্রয়ে তেমন নয়। ডিজেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। অথচ পরিবহণ ব্যয় বেড়েছে ২৮ শতাংশ। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top