নানামুখি প্রতিকূলতায় পরিচয় হারাচ্ছে

চারঘাটের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

আরিফুল ইসলাম অভি | প্রকাশিত: ২৪ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:২৮; আপডেট: ২৪ জানুয়ারী ২০২১ ১৮:২৯

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাচ্চারা বাড়ির আঙিনাকেই খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে
 
নব পলল দ্বারা গঠিত চারঘাটের বেশির ভাগ মাটি। হিন্দু-মুসলমানদের পাশাপাশি কিছু সাঁওতাল-পাহাড়িয়ার বাস চারঘাটে। বরেন্দ্র অঞ্চলে বাংলার বেশ কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। চারঘাটের সাঁওতাল-পাহাড়িয়া-তুরিরা কবে থেকে চারঘাট অঞ্চলে বসবাস করছে, তার সঠিক ধারণা পাওয়া বেশ কঠিন। তাদের আদি নিবাস বরেন্দ্র অঞ্চলে নাকি ভারতের বিহার রাজ্য থেকে তারা এসেছে, তার হিসাব মেলাও দায়।
 
চারঘাটে সব মিলিয়ে ৮৫২ জনের মত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বাস। উপজেলার চারঘাট, নিমপাড়া ও শলুয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে তাদের বাস। নিজেদের আত্নপরিচয় ভুলে এখন তারা হিন্দু পরিচয়ে পরিচিত হতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। চারঘাট উপজেলায় মোট ২৩২ টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টী পরিবার আছে।
 
চারঘাট ইউনিয়নের পরানপুর আর হ্যারিনি পাড়ায় থাকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কিছু পরিবার। পরানপুরে মোট ২৭ ঘর সাঁওতালের বাস। নিজেদের সনাতন ধর্মের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়েছে তারা। হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীই তাদের উপাস্য। নিজস্ব ভাষার কোন প্রচলন নেই, নেই কোন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। অন্যের জমিতে তাদের বাস। মাত্র তিনটি পরিবারের নিজস্ব জমি আছে। পাড়ার প্রধান, বাবু রাম মল্লিক। তিনি পেশায় ভ্যান চালক। পুরো পাড়া মিলে একটা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীর সন্ধান মিলেছে। আর স্কুল পড়ুয়া আছে কয়েকজন।
 
হ্যাড়িনি পাড়ার চিত্রটা একই বলা চলে। মোট ২০ টি পরিবারের বাস এখানে। চারঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব ফজলুল হকের ভাই মজিবুর মাস্টারের জমিতে তারা বসবাস করে। শিক্ষার হার এখানেও হতাশা ব্যাঞ্জক। রনো নামের একটা ছেলে রাজশাহী কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স পড়ছে। আর স্কুল পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী আছে।
 
রনো এখন পাড়ার মধ্যমনি। আমরা আসার পর তার সাথে কথা হয়। এখানে না আসলে বোঝার উপায় ছিল না, শিক্ষার আলো এখানে কতটা অধরা! আঁট-সাঁট করে তৈরি করা হয়েছে সাঁওতালদের বাড়ি গুলি। নিজের জমি নাই, অন্যের জমিতে কাজ করছে তারা। কেউ আবার বর্গা নিচ্ছে। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের আগে তাদের অনেক জমি ছিল বলে জানা যায়। যুদ্ধের সময় ও তারপরে অনেকেই দেশান্তরিত হয়েছে।
 
হ্যাড়িনি পাড়ার লোকেরা শুধু শিব পূজা করে। এখানকার সাঁওতালরা এখনো প্রকৃতির অবাধ্য সন্তান। তারা না পেরেছে নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখতে, না পেরেছে অন্যদের সাথে মিশে যেতে।
 
শলুয়ার ঘোষপাড়ার (চকগোচর) চিত্র অবশ্য আলাদা। এখানকার সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোক নিজেদের সাঁওতাল বলে পরিচয় পর্যন্ত দেয়নি। তারা নিজেদের স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে মিশিয়ে ফেলেছে। দুই-এক জনের চেহারার মাঝে সাঁওতালের ছাপ বোঝা যায়। বাকিদের দেখে সাঁওতাল বলে শনাক্ত করা দায়।
 
আসলে বহু পূর্বেই তারা স্থানীয় হিন্দুদের সাথে মিশে গেছে। নিজেরা এখন জমি কিনে বাড়ি করেছে। এই পল্লীর ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে, পুরুষরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাহলে শুধু শুধু নিজেদের সাঁওতাল পরিচয় দিয়ে কি লাভ? তারা নিজেদের মল্লিক পরিচয় দিয়েছে। আগের দু'টি পল্লীর লোকের পরিচয়ও মল্লিক বটে। কটু মল্লিক/ নিত্য মল্লিক ঘোষপাড়ায় আদিবাসীদের প্রধান। সাঁওতালরা এখন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে বিয়ে করে। এখানে মোট ১৫ টি পরিবার আছে।
 
বামনদিঘী বাজারের কাছে 'রাজশাহী সুগার মিলে'র অনেক আবাদি জমি আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানে ২৬ টি সাঁওতাল ও ১ টি পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের বাস। তবে তারাও নিজেদের সাঁওতাল বলে পরিচয় না দিয়ে কর্মকার বলে পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের শারীরিক গঠন বলে দিচ্ছে যে তাদের পূর্ব পুরুষরা অস্ট্রিক ভাষী প্রাক-অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায়। এই পল্লীর অবস্থাও ভাল না; চারঘাট ইউনিয়নের সাঁওতাল পল্লীর ন্যায় করুণ জীবনপাত এখানেও।
 
বামনদীঘি বাজার থেকে আর কিছু দূর গেলেই সরদার পাড়ায় দেখা মিলবে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের। এরা দু'বছর আগে হরিষপুর মিশনারীদের কাছ থেকে খ্রিঃ ধর্মে দিক্ষীত হয়েছে। এখানে মোট ৭-৮ টি পরিবার আছে। পেশায় তারাও কৃষি শ্রমিক। গ্রাম প্রধান বৌদ্ধনাথ পাহাড়িয়া। তাঁর বাড়িতে প্রতি শুক্রবার উপসনার ব্যবস্থা করা হয়। নিজস্ব জমি বলতে বাড়ির ভিটে টুকুই আছে। আর বামনদিঘী বাজারের কাছে ধীরেন পাহাড়িয়া থাকে সুগার মিলের শ্রমিকদের সাথে।
 
নিমপাড়া ইউনিয়নের কামনীগঙ্গারামপুর খ্রিস্টান পাড়ায় বাস করে ১৩ ঘর পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোক। তারা ধর্মান্তরিত হয়েছে অনেক আগে। অস্ট্রেলীয় ট্রাস্টের মাধ্যমে তারা কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।তাদের অনেকেই এখন ছোট চাকরী করে থাকে। এখানকান গ্রাম প্রধান ষষ্টি পাহাড়িয়া। তিনি চারঘাট উপজেলা আদিবাসী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সন্তান নন্দনগাছী কলেজ থেকে ডিগ্রী পাশ করেছে। এখন সে ঈশ্বরদী ইপিজেড-এ স্কয়ার কম্পানীতে চাকরী করে।
বাকি ৩০-৪০ জনের সবাই কৃষিকাজে নিয়োজিত।
 
আর ফকিরের মোড় দিয়ে বিজোড়ের বরকতপুর গ্রামে আছে আরো ২৫ টি পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ঘর। এক বছর পূর্বে তারা খ্রিস্টান হয়েছে। তারাও পেশায় কৃষিজীবি। সেখানকার গ্রাম প্রধান অজয় পাহাড়িয়া। উনার মা আমাদের 'মালতো' ভাষায় কথা বলে শুনান। এছাড়াও সরদহ ইউনিয়নের পাটিকান্দিতে আরো ৫টি পাহাড়িয়া পরিবারের বাস।
 
নিমপাড়া ইউনিয়নের কুঠিপাড়ায় আছে আরো ৩৬ টি 'তুরি' সম্প্রদায়ের বাস। এটি চারঘাটের সবচেয়ে বড় আদিবাসী পল্লী। এটি পুরাতন নন্দনগাছী নামেও পরিচিত। এখানকার গ্রাম প্রধান হলেন সুকুমার। তিনি চারঘাট উপজেলা আদিবাসী সমিতির সভাপতি। তারা প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে 'চৈত্র সংক্রান্তি'র পূজা ও মেলার আয়োজন করে থাকে। চরক গাছের গুড়ির সাথে 'সন্ন্যাসী'রা উপরে ঝুলতে থাকে। তাদের পিঠে ফলা থাকে। এই পূজার অনেক নিয়ম-কানুন আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, বড়াল পাড়ের এই মেলা ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় চৈত্র সংক্রান্তির মেলা! মেলার আয়োজক কমিটির প্রধান হলেন 'ষষ্টী'। এই পাড়ায় মোট ১৩৭ জনের বাস। এছাড়াও সরদহ ইউনিয়নের বড়ালের ধারে গুচ্ছ গ্রামে ১২টি পরিবার, বনকিশোর গ্রামে ৩০টি পরিবার ও হটাৎ পাড়ায় ২৩টি ঋষি সম্প্রদায়ের পরিবার বসবাস করে।
 
চারঘাটের পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের সবাই খ্রিস্টান। মূলত সুযোগ-সুবিধার জন্য তারা ধর্মান্তরিত হয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছে। তাদের অবস্থা পরানপুর, হাড়িনি পাড়া ও নন্দা খামাড়ের শ্রমিকদের চেয়ে ভাল তবে, ঘোষপাড়ার সাঁওতালদের মত অতটা উন্নত না। নিম্নবর্ণের হিন্দুর সাথে মিশে যাবার কারণে সাঁওতাল-পাহাড়িয়া-তুরি সম্প্রদায়ের স্বভাব সুলভ শারীরিক কাঠামো লোপ পেয়েছে।
 
চারঘাটের আদিবাসীদের পোশাক-পরিচ্ছদে এখন আর তেমন ভিন্নতা নাই। পুরুষরা লুঙ্গি পরে আর নারীরা পরে শাড়ি। বিবাহিত মেয়েরা হাতে শাঁখা ও মাথায় সিঁদুর পরে। এছাড়াও আর্থিক সঙ্গতি থাকলে সোনার গহনা ব্যবহার করে। পুরুষরা গলায় মালা পড়ে। শিক্ষিত পুরুষরা এখন লুঙ্গির পাশাপাশি শার্ট-প্যান্ট পরে। স্কুল-কলেজগামী মেয়েরাও সালোয়ার পরে থাকে। তবে মোটা দাগে লুঙ্গি আর শাড়িই হল পোশাক।
 
খাবারের ক্ষেত্রে এখনো কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আদিবাসীদের বেশির ভাগই অতি দরিদ্র হওয়ার কারণে তারা সর্ব সাধারণের খাবারের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবারের সন্ধান করে থাকে। অনেক বুনো সবজি ও লতা-পাতা তারা সন্ধান করে খায়। আর মাংসের জন্য তারা বিভিন্ন বন্য প্রাণী ও পাখির ওপর নির্ভর করে থাকে। বিশেষ করে বুনো খরগোশ তাদের প্রিয় খাবার। এছাড়াও গন্ধগোকুল, বিড়াল, সাপ, ব্যাঙ, বুনো কবুতর ও ঘুঘু, বুনো কোয়েল, ক্ষেত্র বিশেষে ইদুর ইত্যাদি তাদের খাদ্য তালিকায় আছে। আর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা শূকর পালন করে তার মাংস খেয়ে থাকে। সনাতন ধর্মের আদিবাসীরাও সুযোগ পেলে শূকরের মাংস খেয়ে থাকে। বিশেষ দিনে তারা 'তাড়ি' (স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত মদ) পান করে।
 
বেশিরভাগ আদিবাসীই সনাতন ধর্মের অনুসারী। হিন্দু ধর্মের সব দেবতা তাদের পূজ্য। হিন্দুদের ন্যায় তারাও পূজা অর্চনা করে থাকে। পূজা পরিচালনা করে হিন্দু ব্রাহ্মণ শ্রেণীর পুরোহিতরা; যারা সাধারণত আদিবাসী পল্লীর বাসিন্দা নয়। শিব তাদের জনপ্রিয় দেবতা আর চৈত্র সংক্রান্তি আদিবাসীদের প্রধান উৎসব। তবে হিন্দুদের অন্য পূজা অর্চনাতেও তারা অংশ নেয়। উল্লেখ্য, উঁচু শ্রেণীর হিন্দুরা সচরাচর চৈত্র সংক্রান্তি পূজোয় অংশ নেয় না। আর খ্রিস্টানরা তাদের আচার পালন করে খ্রিস্টান রীতি মেনে। তবে তাদের মধ্যে সনাতন ধর্মের অনেক প্রভাব থেকে গেছে।
 
ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, সাঁওতাল, পাহাড়িয়া, কোল, মুণ্ডা ইত্যাদি শ্রেণীর লোকদের পূর্ব পুরুষরা আর্যদের আগে এই উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে কিংবা তাদের হাত ধরেই উপমহাদেশে মানব সভ্যতার শুরু। তাদের পূর্ব পুরুষরা প্রাক-অস্ট্রেলীয় বলে পরিচিত। তারা এই ভূখণ্ডের আদি জাতি। তাদের সাথে কিরাত জাতি মিলে 'নিষাদ' জাতির উদ্ভব হয়েছিল। তাদের ভাষা ছিল 'অস্ট্রিক' তারা ছিল অরণ্যচারি, যাযাবর ও অসভ্য। কৃষিকাজ আর পাখি শিকারে তারা সিদ্ধহস্ত ছিল। পরে দ্রাবিড় জাতি এই অঞ্চলে এসে সভ্যতার শুরু করে। সিন্ধু সভ্যতা তাদেরই মহান কীর্তি। আর্যরা এদেশে আসলে দ্রাবিড়দের বিতাড়িত করে। নির্বাসিত দ্রাবিড়রা আশ্রয় নেয় সাঁওতালদের গৃহে। পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা দ্রাবিড়দের বংশধর। ভারত আর শ্রীলংকার তামিলরা দ্রাবিড়দের বংশধর। ভারতের বিহার রাজ্যে এদের বাস।
 
জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন আর কৃষিকাজের জন্য বাংলার রাজা-জমিদাররা তাদের বিহার থেকে আনত। তাদের অনেকেই বাংলাদেশে থেকে গেছে। উত্তরবঙ্গের অনেক জেলাতেই উপমহাদেশের এই আদিবাসীদের দেখা মেলে। রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলে অনেক সাঁওতালের বাস। এসব অঞ্চলে তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও সংগঠন আছে। দাবি আদায়ে তারা সোচ্চার, একতাবদ্ধ।
 
তবে চারঘাটের অবস্থা ভিন্ন। তাদের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। সাঁওতালেরা এখন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে মিশে গেছে। লোপ পেয়েছে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। হারিয়ে গেছে নিজস্ব সংস্কৃতি। শুধু পরাণপুর আর হাড়িনিপাড়ার সাঁওতালেরা চরখের মেলায় যায়। সাঁওতাল কিংবা পাহাড়িয়া, কোন সম্প্রদায়ের মাঝেই এখন নিজস্ব ভাষা কিংবা সংস্কৃতি নিয়ে আলাদা চেতনা কাজ করে না। সাঁওতাল আর তুরি সম্প্রদায়ের ভাষা এক। তারা 'সাদরী' ভাষায় কথা বলে। আর ঋষিরা বলে 'ঠার' ভাষায়, যা আজ বিলুপ্তির পথে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অনেককে এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নাই।
 
বিশুদ্ধ রক্তের চারঘাটের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধিবাসীর সংখ্যা কমে আসছে। অনেক স্থানেই নিম্নবর্ণের হিন্দুর সাথে তারা মিলে গেছে। দেশে বেশ কয়েক লক্ষ্য সাঁওতাল আছে। তবে পাহাড়িয়া আছে মাত্র ৭ হাজারের মত। সেদিক থেকে চারঘাটের পাহাড়িয়া জনগোষ্ঠী বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অথচ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে তাদের নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। অনেকেই তাদের নিজেদের ভাষা ভুলে গেছে। চারঘাটের ঠোঁট মোটা, কোকড়ানো চুল, মিশমিশে কালো, তীরন্দাজ লোকেরা এখন আর নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজন অনুভব করে না।
 
কিছু আদিবাসী পল্লীতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। তাদের দেখার যেন কেউ নেই। উপজেলা অফিসে আদিবাসীদের কোন তথ্য নেই। 'সচেতন' নামের একটি সংগঠন আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করে বলে শুনেছি কামনীগঙ্গারামপুরে। তবে জানিয়েছে যে তাদের কাছে কেউ আসে না। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মত। আদিবাসী পল্লীতে বয়স্ক ব্যক্তির দেখা তেমন একটা নজরে আসেনি। বুঝতে পারছি তাদের গড় আয়ু বেশ কম। শিক্ষার দিগন্ত এখানে প্রসারিত না। সভ্যতার আড়ালে বসবাস করে চারঘাটের অন্ত্যজরা। অন্ত্যজ নামটাই বেশ মানাচ্ছে। এই সাঁওতাল আর পাহাড়িয়ারা ভারতের বিহার রাজ্য থেকে এখানে এসেছে নাকি তারা আগে থেকেই এখানে ছিল, সেটা এখনো পরিস্কার না। ভুলে গেলে হবে না যে রাজশাহী অঞ্চল এক সময় 'পুণ্ড্র' জনপদের অংশ ছিল; আর সেটি প্রায় ২৫০০ বছরের ইতিহাস বহন করে চলেছে। আজকের বাংলাদেশ এক সময় অনার্যদের উর্বর ভূমি ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে তারা সভ্যতার লালন করে এসেছিল। এই কৃষি নির্ভর ব-দ্বীপের তারা ভূমিপুত্র।
 
আর্যরা ভারতে প্রবেশ করলেও তারা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসেছে অনেক পরে। যখন এসেছে, তখন তারাও অনার্যদের সাথে মিশে এক মিশ্র জাতির উদ্ভব করেছে। যে 'অস্ট্রিক' জাতির কথা বলেছি, তারাই বর্তমান বাঙ্গালী বা বাংলাদেশীদের পূর্ব পুরুষ। ফলে সমতলের অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীই যে আমাদের পূর্ব পুরুষ তা অস্বীকার করা যায় না। অথচ সেই জাতিসত্তার লোকেরা আজ সমাজের নিচু স্তরে ধুকে ধুকে সংগ্রাম করে চলেছে। তাদের অনেকেই আদিবাসীর তকমা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগুতে চলেছে। এই হল চারঘাটের অন্ত্যজদের অবস্থা।
 
লেখক- গবেষক ও কলামিস্ট


বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top