‘ডার্করুম’ নেই, স্টুডিও তালাবন্ধ

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৩:৪১; আপডেট: ৬ মে ২০২৪ ২৩:৫৭

ছবি: প্রতীকী

এখনও যেমন ছবি তোলা ছাড়া কোন অনুষ্ঠান, উৎসব কল্পনা করা যায় না, তেমনি কয়েক দশক আগেও যে কোনও উৎসব, বিশেষ মুহূর্ত কিংবা শখের বসে মানুষ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলতেন। সময়ের বিবর্তনে, প্রযুক্তির বিকাশে তা ক্রমেই বিলীন হওয়ার পথে।

এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ছবি তোলা ছাড়া শখ করে স্মৃতি ধরে রাখতে আর স্টুডিওতে যান না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যান্ড্রয়েড ফোনের বিস্তার ও ডিজিটাল ক্যামেরা সহজলভ্য হওয়ায় স্টুডিওর কদর কমে গেছে। এখন মানুষ চাইলেই ব্যক্তিগতভাবেই মোবাইল ফোন কিংবা ডিজিটাল ক্যামেরায় ইচ্ছে মতো ছবি তুলতে পারেন। এসব ছবি প্রিন্ট করারও কোনও ঝামেলা নেই, সংরক্ষণ করা যায় ভার্চুয়াল প্লাটফর্মেই। তাই খুব একটা স্টুডিওর দ্বারস্থ হতে হয় না।

তবে এত সবের ভিড়ে এখনও বিভিন্ন শহরে কিছু স্টুডিও টিকে আছে। সেগুলোতেও মূলত অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ছবিই তোলা হয় বেশি।

স্মার্ট ফোনের বিস্তার ও ডিজিটাল ক্যামেরা সহজলভ্য হওয়ায় স্টুডিওর কদর কমে গেছে।

একসময় সেলুলয়েড ফিল্মে তোলা ছবি বিভিন্ন রাসায়নিকের মিশ্রণে পরিস্ফুটন ঘটানো হতো। আর সম্পূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করা হতো অন্ধকার একটি কক্ষে, যাকে বলা হতো ডার্করুম। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ছবি তোলার ধরনে পরিবর্তন এসেছে। সেলুলয়েডের জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল ক্যামেরা। আর এতেই হারিয়ে গেছে ‘ডার্করুম’। হারিয়ে গেছে, ‘নেগেটিভ’, ‘ফিল্ম ডেভেলপ করা’ ও ‘ছবি পজিটিভ করা’র মতো প্রাচীন পদ্ধতিগুলোও।

একটা সময় স্মৃতি ধরে রাখতে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলার প্রচলন ছিল মোটামুটি সব মহলেই। পরিবারের সদস্যরা, বন্ধু কিংবা সহপাঠীদের সঙ্গে তোলা সে সব ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকতো নানান প্রাকৃতিক দৃশ্য। স্টুডিওর দেওয়ালে আঁকা ছবিতে শোভা পেতো ফুল, লতা-পাতা। কখনও বিদেশি বিভিন্ন স্থানের ছবিও বড় করে ফ্রেমে সাঁটানো হতো। কিন্তু আজকের দিনে এমন স্টুডিও খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন।

এক সময় প্রতিটি জেলায় অসংখ্য ছবি তোলার স্টুডিও ছিল। ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে ছবি তোলার পরিমাণ বাড়লেও বর্তমানে একেবারেই কমে গেছে স্টুডিওর সংখ্যা। অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছে স্টুডিও ব্যবসা। স্টুডিওর ছবি তোলার ব্যবসা মন্দার কারণে অনেকে এই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন।অনেকে এই পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন, বেকার হয়েছেন এই পেশার সাথে জড়িত অনেক মানুষ।

কুষ্টিয়া জেলার ন্যাশনাল স্টুডিওর মালিক আনোয়ার হোসেন নিশি বলেন, ‘১৯৯৬ সালের দিকে স্টুডিও ব্যবসা শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে ব্যবসা ভালোই চলেছে। এরপর ডিজিটাল মাধ্যম আসার পর আমাদের ব্যবসায় ধস নামলো। ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি তোলা শুরু হাওয়ার পর আমাদের ব্যবসা বিলুপ্ত হয়ে গেলো।’

সে সময় খুব বেশি প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল না এবং কোনও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে স্টুডিও ব্যবসাই ছেড়ে দিয়েছি।’

একই এলাকার ‘রুপায়ন’ স্টুডিওর মালিক আব্দুস সালাম বলেন, ‘১৯৮৬ সালে প্রথম স্টুডিওতে ছবি তোলার ব্যবসা শুরু করি। ২০১০ সাল পর্যন্ত স্টুডিও ব্যবসা ভালোই চলেছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫০ থেকে ১০০ জনের ছবি তোলা হতো। এ ছাড়াও ফ্লিম বিক্রি, ক্যামেরা ভাড়া দেওয়া হতো। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব যেমন বিয়ে, জন্মদিন, সুন্নতে খৎনা, সভা সেমিনারসহ সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে ক্যামেরা ভাড়া দেওয়া হতো। সে সময় ব্যবসাও হয়েছে বেশ ভালো। তবে মোবাইল ক্যামেরার প্রচলন চালু হাওয়ার পর থেকে স্টুডিওতে এসে ছবি তোলার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেলো। ফলে অনেকে স্টুডিও ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।’

স্টুডিওতে ছবি তোলার অভিজ্ঞতা নেই নতুন প্রজন্মের অনেকেরই। কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রিপা বলেন, ‘আমি আমার একাডেমিক কাজে স্টুডিওতে পাসপোর্ট সাইজ, স্ট্যাম্প সাইজ ছবি তুলেছি। কখনোই শখের বশে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলিনি। তবে আমাদের বাসায় এখনও স্টুডিওতে তোলা কিছু ছবি রয়েছে। তবে এসব ছবির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।’

‘রূপসা স্টুডিও’র মালিক সুনিল কুমার ঘোষ বলেন, ‘আমরা আশির দশক থেকে বংশ পরম্পরায় স্টুডিওতে ছবি তোলার ব্যবসা করে আসছি। এক এময় এই ব্যবসা আমার বাবা চালাতেন। এখন সেটি আমি ধরে রেখেছি। স্টুডিওর ব্যবসা আগে রমরমা চললেও কালের বিবর্তনে এটি এখন একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মোবাইলে ছবি তোলার প্রচলন শুরু হাওয়ার পর থেকেই মানুষ সৌখিন ছবি তুলতে স্টুডিওতে আসা ভুলে গেছে।’

বর্তমানে প্রয়োজনীয় ছবি তোলার জন্য ব্যবস্থা রেখে সঙ্গে অন্যান্য সেবার ব্যবস্থা করে গড়ে উঠেছে একধরনের স্টুডিও। যেগুলোতে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলার পাশাপাশি ব্যবস্থা থাকে কম্পিউটার কম্পোজ, ফটোকপি, ছবি থেকে ছবি-সহ বিভিন্ন ধরনের সেবা। এসব স্টুডিও সবগুলোতে আবার নিজস্ব ল্যাব থাকে না। কালার প্রিন্টারে কাগজে প্রিন্ট করে দেওয়া হয় ছবি। আবার কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ক্যামেরাও ভাড়া দেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে।

কথা হয় এমনই একটি স্টুডিও স্থানীয় ‘এবিসি কম্পিউটার অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া সেন্টার’-এর পরিচালক মারফত আফ্রিদির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে মানুষ শখের বশে স্টুডিওতে এসে ছবি তুলতেন। সে সময় স্টুডিওর ভেতরে সাজসজ্জার ব্যবস্থাও রাখা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ব্যবসাটি হারিয়ে গেলো।’

কুষ্টিয়া স্টুডিও মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএম মাহমুদুল হক বাদল বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার পর থেকেই মানুষ আর স্টুডিওমুখি হতে চায় না। এখন মানুষ সহজেই তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছবি তুলতে পারেন। তাই প্রয়োজনীয় ছবি ছাড়া কেউ আর স্টুডিওতে আসেন না।

এ বিষয়ে অধ্যাপক শাহ আক্তার মামুন বলেন, আগে একটি ছবি ওঠানোর পর সেটি হাতে পেতে তিন-চার দিন, এমনকি বিভিন্ন উৎসবে এক-দুই সপ্তাহও অপেক্ষা করতে হতো। এতে সময় এবং অর্থের অপচয় হতো। প্রযুক্তির বিকাশে মানুষ আর স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তোলেন না। এখন চাইলেই মানুষ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজনীয় ছবি তুলতে পারেন। বিষয়টি শিল্প সংশ্লিষ্টদের জন্য খারাপ হলেও এটাই বাস্তবতা, মেনে নিতেই হবে।

তবে এখনও গুটি কয়েক মানুষ আসেন সেলুলয়েড ফিল্ম নিয়ে ছবি প্রিন্ট করার জন্য। হয়তো পুরতন স্মৃতি বা স্বজনকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করতে। তবে জেলা শহরতো দুরের কথা অনেক বিভাগীয় শহরও আর তাদের সহযোগীতা করতে পারে না।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top