বাংলা সালতানাত মধ্যযুগের বাংলার একটি রাজ্য ভাষা
আহসান হাবীব | প্রকাশিত: ৭ মার্চ ২০২৫ ১২:১৪; আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫ ১৮:১৮

বাংলা সালতানাত, শাহি বাংলা বা সুলতানি বাংলা (ফার্সি: سلطنت بنگاله، شاهی بنگاله، سلطانی بنگاله, প্রতিবর্ণীকৃত: Salṭanat-e-Baṅgālah, Shāhī Baṅgālah, Sulṭānī Baṅgālah)ছিল ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মাঝামাঝি বঙ্গ অঞ্চলে স্থিত একটি শেষ মধ্যযুগীয় সালতানাত। বাংলা সালতানাতকে 'শাহী বাঙ্গালা' নামেও অভিহিত করা হতো। গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে এটি ছিল প্রভাবশালী শক্তি।
সালতানাতের রাজ্য জুড়ে ছিল অসংখ্য টাকশাল। ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্ত রাজ্য গড়ে তোলার মাধ্যমে বাংলা সালতানাত তাদের অঞ্চল বিস্তৃত করেছিল। দক্ষিণ-পশ্চিমে ওড়িশা, দক্ষিণ-পূর্বে আরাকান ও পূর্বে ত্রিপুরা পর্যন্ত তাদের প্রভাব ছিল।হোসেন শাহী বংশের শাসনামলে বাংলা সালতানাত নিজের শক্তির শীর্ষে পৌঁছায়। সুলতানি আমলে নেপাল থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা (বর্তমানের আসাম) আর জৌনপুর ও বারাণসী পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
বঙ্গসহ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ বানিজ্যিক অঞ্চল হিসেবে তখন বাংলা সুপরিচিত ছিল। সুরি সাম্রাজ্যের হস্তক্ষেপের পর থেকে ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে বাংলা সালতানাতের শক্তি। মুঘল বিজয় ও ভেঙে পড়ার মাধ্যমে অবশেষে সুলতানি শাসনের সমাপ্তি ঘটে। বাংলা সালতানাত ছিল একটি সুন্নি মুসলিম শাসিত রাজ্য যেখানে বাঙালি, তুর্কী-পারস্য, আফগান এবং আবিসিনিয়ান অভিজাত শ্রেণীর প্রভাব লক্ষ্য করা যেত।
সর্বাধিক পরিচিত বংশগুলির মধ্যে ছিল ইলিয়াস শাহী, গণেশ বংশ এবং হোসেন শাহী বংশ। সালতানাতের আমলে ধর্মীয় বৈচিত্র্য ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোও শান্তি-সহাবস্থানের অধিকারী ছিল। ফারসি ভাষা রাষ্ট্রীয়, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হত। বাংলা ভাষা প্রথমবারের মতো সুলতান আমলেই দরবারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলা সালতানাতের যেসব শহর টাকশালের কাজে ব্যবহৃত হত সেগুলোকে 'মিন্ট টাউন' বলা হতো।
এখানেই ঐতিহাসিক 'টাকা'র প্রচলন ঘটে। মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের সৌন্দর্যে সজ্জিত ছিল এই শহরগুলো। ষোড়শ শতাব্দীতে, রাজধানী শহর গৌড় ছিল পৃথিবীর পঞ্চম জনবহুল নগরী। অর্থনৈতিক কেন্দ্র সোনারগাঁও, মসজিদের শহর বাগেরহাট এবং সমুদ্র বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র চট্টগ্রামও ছিল বাংলা সালতানাতের গুরুত্বপূর্ণ শহর। সামুদ্রিক ও স্থলপথের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং ইউরোপের সাথে বাংলা সালতানাত সুসম্পর্ক রাখত। উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে বঙ্গোপসাগরের তীরে বাংলা সালতানাত গড়ে ওঠে। সারা বিশ্ব থেকে তখন বণিক ও অভিবাসীরা বাংলায় আসত। মালদ্বীপ, চীন, মালেকা অঞ্চলের সাথেও বাঙালি জাহাজ ও ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক ছিল।
সমসাময়িক ইউরোপীয় এবং চৈনিক পরিব্রাজকদের বর্ণনায় বাংলাকে সম্পদশালী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রচুর পণ্য সম্ভার এবং বৈচিত্রের কারণে তখন বাংলাকে 'ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ দেশ' হিসেবে বর্ণনা করা হতো। স্থাপত্য ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবেও বাংলা সালতানাত চিরস্মরণীয়। এসকল স্থাপত্যে বিদেশি প্রভাবের পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র বাঙালি রীতিও লক্ষণীয়। বাংলার ইতিহাসে স্বাধীন মুসলিম শাসিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলা সালতানাত ছিল সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী।১২০০-এর দশকে বাখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে গৌড় বিজয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলাকে দিল্লি সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয়।
মুহাম্মদ ঘোরির রাজত্বকালে ১২০২ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এ বিজয় সংঘটিত হয়েছিল। এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে তুর্কি-আফগানদের উত্থানের সূচনা। বাখতিয়ার খলজী ঘুরি শাসক মুহাম্মদ ঘোরির একজন সেনাপতি ছিলেন। তিনি বাংলায় খলজি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ১২০৬ সালে খলজি বংশেরই সেনানায়ক আলী মর্দানের হাতে বাখতিয়ার খলজির মৃত্যু হলে বাংলার শাসনভার খলজি গোত্রের বিভিন্ন মালিকের কাঁধে চলে আসে (আলি মর্দান নিজেই খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ক্ষমতা দখল করেন)। সেই সময় দিল্লির সুলতান ইলতুতমিশ বাংলাকে দিল্লির প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তার ছেলে নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে বাংলা পাঠান।
১২২৫ খ্রিস্টাব্দে ইলতুতমিশ বাংলাকে দিল্লির একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। দিল্লি সালতানাত নিয়োজিত গভর্নরদের মাধ্যমে বাংলা শাসনের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দিল্লি থেকে বাংলার বিস্তর ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে তাতে সফলতা মেলেনি। বরং উচ্চাকাঙ্ক্ষী গভর্নররা বিদ্রোহ করে স্বাধীন শাসকের মর্যাদা নিয়ে বাংলা শাসন করেছেন। দিল্লি সালতানাতের সেনাবাহিনীর হাতে তাদের দমন করা হলেও এসব বিদ্রোহীদের মধ্যে যুজবক শাহ (১২৫৭), তুগরল খান (১২৭১-১২৮২) ও শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২) এর মতো দক্ষ শাসকদের উপস্থিতি ছিল।
বিশেষ করে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সিলেট জয় করে পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন। ১৩২৫ সালে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক পুরো বাংলা প্রদেশকে পুনঃসংগঠিত করে তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করেন - সোনারগাঁও (পূর্ব বাংলা), গৌড় (উত্তর বাংলা) এবং সাতগাঁও (দক্ষিণ বাংলা)। কিন্তু এই ব্যবস্থাও টেকেনি। ১৩৩৮ সালের মধ্যে এই তিনটি অঞ্চলের স্বাধীন সুলতানের উত্থান ঘটে - সোনারগাঁওয়ে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ, গৌড়ে আলাউদ্দিন আলী শাহ এবং সাতগাঁওয়ে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ।
১৩৪০ সালে ফখরুদ্দিন চট্টগ্রাম দখল করেন এবং ১৩৪৯ সালে তার পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ ক্ষমতায় আসেন। অন্যদিকে, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ আলাউদ্দিন আলী শাহকে পরাজিত করে গৌড়ের নিয়ন্ত্রণ নেন, এরপর সোনারগাঁওয়ের ইখতিয়ারউদ্দিনকেও হারিয়ে দেন। ১৩৫২ সালের মধ্যে বাঙালি সুলতানদের মধ্যে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বা ইলিয়াস শাহ বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।ইলিয়াস শাহ পাণ্ডুয়াতে তার রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর ব-দ্বীপ একত্রিত করে বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পূর্ব উপমহাদেশের বেশ কয়েকটি নগর রাষ্ট্র ও রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও আক্রমণ চালান। তিনি পূর্ববঙ্গ ও উত্তর বিহার জয় করেন।
ইলিয়াস শাহ নেপালে প্রথম মুসলিম সেনাবাহিনী নিয়ে যান, কাঠমান্ডু উপত্যকায় অভিযান চালান এবং প্রচুর ধনরত্ন নিয়েবাংলায় ফিরে আসেন। তার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল পূর্বে আসাম থেকে পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে ১৩৫৩ সালে একদলা দুর্গের অবরোধের সময় বাংলা-দিল্লি সালতানাত যুদ্ধে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের কাছে ইলিয়াস শাহ পরাজিত হন। বাংলা দিল্লির সুলতানকে কর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইলিয়াস শাহ অনেক জয় করা অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারালেও বাংলার শাসনভার নিজের দখলে রাখতে সক্ষম হন।
ইলিয়াস শাহ ইলিয়াস শাহী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন, যা দেড়শ বছর ধরে বাংলা শাসন করে। তার পুত্র এবং উত্তরসূরি সিকান্দার শাহ ১৩৫৯ সালে একদলা দুর্গের দ্বিতীয় অবরোধের সময় দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলককে পরাজিত করেন। দিল্লি ও বাংলার মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যেখানে দিল্লি বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে। ফিরোজ শাহ তুঘলক সিকান্দার শাহকে আনুমানিক ৮০,০০০ টাকার একটি সোনার মুকুট উপহার দেন। এই শান্তিচুক্তি দুই শতাব্দীর জন্য বাংলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।
সিকান্দার শাহের রাজত্ব তিন দশক স্থায়ী হয়। তার রাজত্বকালে আদিনা মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদের নকশা দামেস্কের বিখ্যাত মসজিদের আদলে করা হয় - যে রীতিটি নতুন অঞ্চলে ইসলাম প্রবর্তনের সময় অনুসরণ করা হত। এই সময়ের মধ্যে অধিকাংশ কৃষিজমি হিন্দু জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যা মুসলিম তালুকদারদের সাথে উত্তেজনা সৃষ্টি করে।
বাংলা মধ্যযুগীয় ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পূর্ব সীমান্ত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৪শ শতাব্দীতে ইসলামী রাজ্যসমূহ পশ্চিমে মুসলিম স্পেন থেকে পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাজ্যগুলোতে বহুজাতিক অভিজাত শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল। স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ফারসি ও আরবি ব্যবহৃত হত। ফারসি কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত। ধর্মযাজকদের জন্য ধর্মীয় ভাষা ছিল আরবি। বাংলায়, মুসলিম শাসনের অধীনে বাংলা ভাষা একটি দরবারী ভাষায় পরিণত হয় এবং প্রধান কথ্য ভাষা ছিল।
তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বিদেশে বাংলার প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। তিনি মিং চীনে দূতাবাস পাঠাতে শুরু করেন, যা তার উত্তরসূরিদের রাজত্বকালে একটি প্রথা হিসাবে অব্যাহত থাকে। গিয়াসউদ্দিন আরবেও নির্মাণ প্রকল্পে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি ফারসি কবি হাফিজের সাথে চিঠি ও কবিতা আদান-প্রদান করতেন। বাংলার সুলতানগণ কায়রোর আব্বাসীয় খলিফার কাছে নামেমাত্র আনুগত্যের অঙ্গীকার করতেন। বাংলা সুলতানদের মুদ্রায় প্রায়শই সমসাময়িক আব্বাসীয় খলিফার নাম খোদাই করা থাকতো।
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ পাণ্ডুয়ার পাশাপাশি মধ্য বাংলার শহর সোনারগাঁওয়ে তার দরবার অনুষ্ঠিত করতেন। চীনা দূতদের ভ্রমণ বিবরণে উল্লেখ আছে যে সুলতান সোনারগাঁওয়ের নদীবন্দরের কাছে একটি প্রাসাদে বাস করতেন। নদীবন্দরের চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সাথে জাহাজ চলাচলের সংযোগ ছিল। ১৪০৬ সালে, মা হুয়ান সোনারগাঁওকে একটি বড় মহানগর হিসেবে বর্ণনা করেন। অন্যান্য চীনা দূতরা একটি দুর্গপ্রাচীর বেষ্টিত শহরের বিবরণ দিয়েছেন। সোনারগাঁও ছিল সুফি শিক্ষা ও ফারসি সাহিত্যের কেন্দ্র এবং আজম শাহ এমনকি হাফিজকে সেখানে বসতি স্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
দিল্লি সালতানাতের সময় আবু তাওয়ামা যেসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন, তার উত্তরসূরিরা বাংলা সালতানাতে তা বজায় রাখেন। এর মধ্যে সুফি প্রচারক ইব্রাহিম দানিশমন্দ, সৈয়দ আরিফ বিল্লাহ মুহাম্মদ কামেল, সৈয়দ মুহাম্মদ ইউসুফ এবং অন্যান্যরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।পনেরো শতকের শুরুর দিকে, ইলিয়াস শাহি শাসনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন একজন শক্তিশালী হিন্দু জমিদার রাজা গণেশ। তিনি তার ছেলেকে (ইসলাম ধর্মান্তরিত), জালালউদ্দিন মুহাম্মদ শাহকে সিংহাসনে বসাতে সক্ষম হন। জালালউদ্দিনের রাজত্ব তুলনামূলকভাবে স্বল্পস্থায়ী কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
তিনি একজন আরাকানি রাজাকে আরাকান পুনর্দখল করতে সাহায্য করেছিলেন। পাশাপাশি জালালউদ্দিন ফতেহাবাদ দখল করেন। সুলতানি শাসনে তিনি আরো স্থানীয় বাঙালি উপাদানের প্রবর্তন করেন। প্রথমদিকে আব্বাসীয় খলিফার প্রতি অনুগত থাকলেও পরবর্তীতে নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করে বাঙালি মুসলিমদের স্বায়ত্তশাসনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ১৪৩২ সালে ইলিয়াস শাহি বংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
পান্ডুয়া থেকে এক দশকের বেশি সময় ধরে নয়জন রাজা বাংলা শাসন করেছিলেন। তারা প্রাসাদ, দুর্গ, সেতু, মসজিদ এবং সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। চীনা দূত মা হুয়ান সেই সময়ে তার ভ্রমণ বিবরণে পান্ডুয়া শহরের বর্ণনা করেন। তার বর্ণনায় উল্লেখ আছে - "শহরের দেয়ালগুলি খুবই দর্শনীয়, বাজারগুলি সুসজ্জিত, পাশাপাশি দোকানগুলি, সুশৃঙ্খল সারিতে স্তম্ভগুলি সাজানো, নানা ধরনের পণ্যে পরিপূর্ণ "।
পান্ডুয়া কাপড় এবং ওয়াইন রপ্তানির একটি কেন্দ্র ছিল। কমপক্ষে ছয় ধরনের সূক্ষ্ম মসলিন এবং চার ধরনের ওয়াইন পাওয়া যেত পান্ডুয়ায়। পান্ডুয়ার তুঁত গাছের ছাল থেকে উন্নতমানের কাগজ তৈরি করা হত। ১৪৫০ সালে সুলতান মাহমুদ শাহ বাংলার রাজধানী পান্ডুয়া থেকে গৌড়ে স্থানান্তর করেন। এই স্থানান্তরের সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে একটি ছিল কাছাকাছি নদীর গতিপথের পরিবর্তন।
মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে সুন্দরবন নিয়ন্ত্রণ আরো সুদৃঢ় হয়। সুন্দরবনের গভর্নর খান জাহান আলী খলিফাতাবাদ নামক টাকশাল শহর নির্মাণ করেন। অন্যান্য অনেক কর্মকর্তার মতো, তৈমুরের দিল্লি দখলের পর খান জাহান বঙ্গদেশে বসতি স্থাপন করেছিলেন। রুকুনউদ্দিন বারবক শাহের রাজত্বকালে ম্রক-উ রাজ্য চট্টগ্রাম দখল করে।
পনেরো শতকের শেষদিকে আবিসিনীয় ভাড়াটে বাহিনী থেকে চারজন সুলতান ক্ষমতা কেড়ে নেয়। বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রায়শই সালতানাতকে প্রভাবিত করেছিল।প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৪৯৪ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলার নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ হোসেন শাহী বংশ প্রতিষ্ঠা করেন, যার উৎপত্তি ছিল আরব বা আফগান সৈয়দ বংশ থেকে। তিনি অস্থিরতার যুগের অবসান ঘটান। সুলতান হিসেবে হোসেন শাহ ১৫১৯ সাল পর্যন্ত শাসন করেন।
তিনি যে বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করে। হোসেন শাহী বংশের শাসনামলে মুসলিম ও হিন্দুরা যৌথভাবে রাজকীয় প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করে। এই যুগকে প্রায়শই বাংলা সালতানাতের স্বর্ণযুগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে বাঙালি অঞ্চলগুলির মধ্যে ছিল আরাকান, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা ও আসামের অংশবিশেষ। হোসেন শাহের নির্দেশে শাহ ইসমাইল গাজী কামতা বিজয়ের সময় বাঙালি বাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং আসামের বড় অংশ জয় করেন। হিন্দু খেন রাজবংশকে উৎখাত করার পর, রাজকুমার দানিয়ালকে নতুন অঞ্চলের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।
১৫১২-১৫১৬ সালে বাংলা সালতানাতের সাথে ম্রক-উ রাজ্যের যুদ্ধের পর, হোসেন শাহ চট্টগ্রাম ও উত্তর আরাকানে বাঙালি সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। হোসেন শাহ "কামরূপ, কামতা, যাজনগর এবং উড়িষ্যার বিজেতা" ঘোষণা করে মুদ্রা তৈরি করেছিলেন। ১৫১৩ সালের সোনারগাঁওয়ের একটি শিলালিপি অনুসারে, হোসেন শাহ ত্রিপুরা রাজ্যের বড় অংশগুলি সংযুক্ত করেছিলেন। প্রতাপগড় রাজ্য বাঙালিদের আধিপত্যের অধীনে আসে।
হোসেন শাহ উড়িষ্যার গজপতি শাসকদের বিরুদ্ধেও বেশ কয়েকটি অভিযান চালান এবং উত্তর উড়িষ্যার নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করেন। হোসেন শাহ পশ্চিমে বাংলার অঞ্চলকে বিহারের বাইরে জৌনপুরের সারান পর্যন্ত প্রসারিত করেন। দিল্লির লোদি রাজবংশের আক্রমণের পর জৌনপুরের সুলতান বাংলায় আশ্রয় নেন। দিল্লির সুলতান জৌনপুরের সুলতানকে অনুসরণ করে বাংলা আক্রমণ করেন। তেমন কোন পদক্ষেপ করতে ব্যর্থ হয়ে দিল্লির সুলতান বাংলার সাথে শান্তি চুক্তি করে প্রত্যাহার করেন। নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহের অধীনে, সালতানাত মিথিলা অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ওইনিওয়ার রাজবংশকে ১৫২৬ সালে সংযুক্ত করে, যুদ্ধে ওইনিওয়ার শাসক লক্ষ্মীনাথসিংহকে হত্যা করা হয়।
ক্যালিকট রাজ্যে ভাস্কো দা গামার অবতরণের পর পর্তুগীজ ভারতের দূতাবাসগুলি প্রায়শই বাংলার রাজধানী গৌড় পরিদর্শন করে। অনেক পর্তুগিজ বণিকের বসবাসের রেকর্ড পাওয়া যায় বাংলা সালতানাতের রাজধানী গৌড়ে।
পর্তুগিজদের সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ গৌড়েই রূপায়িত হতো। পর্তুগীজরা গৌড়ের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তারা লিসবনের সাথে গৌড়ের সমৃদ্ধির তুলনা করেছে। শহরটির মধ্যে ছিল একটি দুর্গ, একটি রাজপ্রাসাদ ও দরবার, মসজিদ, ধনীদের জন্য বাড়ি, এবং জমজমাট বাজার। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ কাস্টেনহাডা দে লোপেজ গৌড়ের ঘরগুলিকে আলংকারিক ফ্লোর টাইলস, উঠান এবং বাগান সহ একতলা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। গৌড় ছিল আঞ্চলিক রাজনীতির কেন্দ্র। বাংলার সুলতান চট্টগ্রামে পর্তুগিজ বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। আইবেরিয়ান ইউনিয়নের সময়, চট্টগ্রামের উপর পর্তুগীজদের কোন আনুষ্ঠানিক সার্বভৌমত্ব ছিল না। পর্তুগিজ পোস্টটি জলদস্যুদের দ্বারা পূর্ণ ছিল, যারা বাংলার বিরুদ্ধে আরাকানিদের সাথে মিত্রতা করেছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে বাংলার সংযুক্তি ছিল একটি ধীরগতির প্রক্রিয়া। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ঘাঘরার যুদ্ধে সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহের নেতৃত্বে বাংলার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন শের শাহ সুরির আক্রমণের সময় বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে হুমায়ুন পারস্যের সাফাভিদ সাম্রাজ্যে আশ্রয় নেন। শের শাহ সুরি বাংলা জয় করতে সফল হন এবং গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড সংস্কার শুরু করেন। সুরি সরকার বাংলা শাসনের জন্য পরপর গভর্নর নিয়োগ করেন। ইসলাম শাহ সুরির মৃত্যুর পর তৃতীয় গভর্নর মুহাম্মদ খান সুর স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলা সালতানাত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
পাশতুন কররানী রাজবংশ ছিল সালতানাতের শেষ শাসক বংশ। রিয়াজ-উস-সালাতিন অনুসারে, সুলতান সুলাইমান খান কররানী ১৫৬৫ সালে রাজধানী গৌড় থেকে টান্ডায় স্থানান্তরিত করেন। সুলাইমান খান কররানী উড়িষ্যার বৃহৎ অংশ দখল করেন। তার রাজত্বকালে বাংলা সালতানাতের অঞ্চল উত্তরে কোচবিহার থেকে দক্ষিণে পুরী এবং পশ্চিমে সোন নদী থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুঘলরা বাংলা সালতানাতের সম্প্রসারণবাদকে রুখতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল, কারণ তারা বাংলার ঐশ্বর্য দখলের আকাঙ্ক্ষী ছিল। উড়িষ্যার টুকারোইয়ের যুদ্ধে আকবরের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী বাংলা সালতানাতের সর্বশেষ সুলতান দাউদ খান কররানীর নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে পরাজিত করে এবং এর ফলে কটকের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। মুঘল শাসন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় রাজমহলের যুদ্ধের মাধ্যমে যখন বাংলার শেষ সুলতান আকবরের বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। ফলে বাংলা সুবা নামে মুঘল প্রদেশ সৃষ্টি হয়।
পূর্বের ব-দ্বীপীয় ভাটি অঞ্চল সতেরো শতকের গোড়ার দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুঘল নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। এই ব-দ্বীপটি সালতানাতের সাবেক বারোজন অভিজাত ব্যক্তির একটি ফেডারেশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো, যারা বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত ছিলেন। তাদের নেতা ছিলেন ঈশা খাঁ, যিনি একজন জমিদার এবং তার মা সৈয়দা মোমেনা খাতুনের মাধ্যমে সালতানাতের একজন সাবেক অভিজাতও ছিলেন। ফেডারেশনটি ক্ষুদ্র রাজ্য দ্বারা গঠিত ছিল। মুঘল সরকার অবশেষে ভাটি এলাকার স্বাধীন রাজ্যগুলোকে দমন করে এবং সমগ্র বাংলাকে পূর্ণ মুঘল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
লেখক: আহসান হাবীব শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: