কথাসাহিত্যিকদের স্মৃতিতে ভয়াল আগস্ট

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ১৪ আগস্ট ২০২১ ২৩:০৩; আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৪:৫১

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন ও জাকির তালুকদার। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসে যা কিছু ঘটে তা সবসময় মানুষ সহজে মেনে নিতে পারে না। কিন্তু সময় নির্মম, বয়ে যায়। তেমনি বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ভয়াবহ ঘটনা। বাঙালির জীবনে বেদনা-বিধুর ও বিভীষিকাময় একটি মাস। নিদারুণ বাস্তবতায় মানবতা ডুকরে কেঁদেছিল সেসময়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মানতে না পারা মানুষরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ফল হিসেবে বিশ্বাসঘাতকরা হত্যা করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে। পরবর্তীতে জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায়ও লিপ্ত হয় হায়েনারা। এতে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়।

ইতিহাস বলে এসব হত্যাকারী এবং তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীরা পরবর্তী সরকারের কাছ থেকে সুরক্ষা এবং সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। কালক্রমে ভয়ানক সশস্ত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয়। যারা নৃশংসতা চালিয়েছে, তারাই আবার বীর-দর্পে ক্ষমতায় ছিল। এই নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় সমাজে। কিন্তু কেউই প্রকাশ করেন না, সাহস পান না। টুকটাক ধারণ করেন সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষরা। অব্যক্ত কথা লিপিবদ্ধ করেন কবি-সাহিত্যিকরা। চলছে আগস্ট মাস, জাতির জনকের প্রতি দ্য ডেইলি স্টারের শ্রদ্ধা ও স্মরণের এই বিশেষ আয়োজন। আজ থাকছে তিন জন নির্বাচিত কথাসাহিত্যিকের চোখে আগস্টের ছায়া। তুলে ধরেছেন ইমরান মাহফুজ।
হাসান আজিজুল হক

কত দুর্ভাগা জাতি আমরা। একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতির কূটকৌশলধারীরা জাতির জনককে মধ্য আগস্টে সপরিবারে শেষ করে দিলো। অথচ পাকিস্তানি শাসকরা সাহস পেল না, স্বজাতিদ্রোহীরা তাকে সপরিবারে হত্যা করল। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা এখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তখন দেশের বাইরে থাকায়।

ভুলে গেলে চলবে না, ১৫ আগস্ট কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও শক্তি একরকম বিলুপ্ত হলো। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। স্বল্প সময়েই দেশনায়ক-রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু যা কিছু করে গেছেন, অর্থাৎ নবপর্বের সূচনা করেছিলেন এবং সেই সিঁড়ি বেয়েই বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি পেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। অনেক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শই আমাদের প্রেরণা।

অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রজ্ঞা-দূরদর্শিতা-সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। রূপ দিলেন আজকের বাংলাদেশের। এজন্য তাকেও কম ঘাত-প্রতিঘাত প্রতিহত করতে হয়নি। যার নেতৃত্বে একটি দেশের অভ্যুদয়, সেই দেশের বিপথগামী নাগরিকরাই হলো তার হন্তারক। ইতিহাসের চাকা থেমে থাকে না। তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ইতিহাসের কালো অধ্যায় মুছেছেন। এটা অন্তত স্বস্তির।

সেলিনা হোসেন

১৯৭৫ সালে আমরা থাকতাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পেছনে। আমি আর আনোয়ার বাংলা একাডেমিতে চাকরি করি। আমার দুই মেয়ে মুনা ও সারা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে পড়ে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে আব্বা আমাদের কাছে ছিলেন। বড় ভাইও পেশোয়ারের ওয়ারস বন্দিশিবির থেকে ফিরে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পাঁচ জন শিশুসহ বাড়িতে আমরা ১০-১২ জন ছিলাম। সবার ভোরে ওঠা আমার অভ্যাস। মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতিরও তাড়া থাকতো। আর প্রতিদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমি রেডিও'র খবর শুনতাম।

১৫ আগস্ট রেডিও ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাই মেজর ডালিমের সদম্ভ কণ্ঠস্বর, 'আমি মেজর ডালিম বলছি। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে।'

আমি তাত্ক্ষণিকভাবে হতচকিয়ে গিয়ে পরক্ষণে চিত্কার করে কাঁদতে শুরু করি। আব্বা আব্বা বলে ডাকতে থাকি। আব্বা নিজের ঘরে নামাজ পড়ছিলেন। জায়নামাজ ছেড়ে উঠে আসেন। জিজ্ঞেস করেন, কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে? বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা হয়েছে। অ্যাঁ, শব্দ করে আমার আব্বা ঘরের একটি চেয়ারে বসে পড়েন। দু'হাতে মাথা চেপে ধরে রেডিও থেকে ভেসে আসা যাবতীয় কথা শোনেন।

১০টা-১১টার দিকে আমি আর আনোয়ার রাস্তার ধারে যাই। রাস্তায় আর্মির গাড়ি ছাড়া অন্য যানবাহন নেই। নিউমার্কেটের দিক থেকে একটি খোলা জিপ আমাদের সামনে এসে থামে। কালো পোশাকধারী পাঁচ-ছয় জন বসে আছেন। হাতে রাইফেল। ধমকের স্বরে বললেন, 'রাস্তায় এসেছেন কেন? যান, বাড়ি যান।'

শহরে কী হচ্ছে তা বোঝার জন্য বের হয়েছিলাম। বুকভরা আতঙ্ক আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফিরে আসি। তারপর কত দিন চলে গেছে। সময়ের হিসাব ফুরিয়েছে। কিন্তু ফুরোয়নি বুকের ভেতরের সেই ভোরের আর্তনাদ। অনেক ভেবেছি আমার হাতে কীভাবে রূপায়িত হবে সে রাতের ঘটনা। কিন্তু না, কিছুই করতে পারিনি। করা সম্ভবও ছিল না। তারপরও অপেক্ষা করেছি নিজেকে তৈরি করার জন্য। একসময় মন স্থির করি যে, একটা কিছু লিখতেই হবে। ১৫ আগস্টের রাতকে পটভূমি করে উপন্যাস লেখার স্বপ্ন আমার ভেতরে ঘুণপোকার মতো কাটে। অনেক পরে হলেও লিখি 'আগস্টের এক রাত' শিরোনামে একটি উপন্যাস।

জাকির তালুকদার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সারাবিশ্বে বাঙালি জাতিকে কৃতঘ্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্বের মানবতাবাদীরা বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছে।'

বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলা যায়। স্বাধীনতার পর মানুষের মনে যে বিপুল প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, তা পূরণ করার মতো বাস্তব পরিস্থিতি সেই সময় ছিল কি না, তা ভাবার অবকাশ কারও ছিল না।
তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়ন করার মতো দীক্ষিত নেতা-কর্মী তার ছিল না। কিন্তু সেজন্য জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।

১৫ আগস্টের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ বন্ধ হয়ে গেছে। জাতির গতি বিপরীতমুখী হয়েছে। যা এখনো সঠিক গতিপথে ফিরতে পারেনি।

সূত্র: ডেইলি স্টার/এএস



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top