গত দুই দশকে পুতিনের শত্রুরা যেভাবে মারা গেছেন

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ২৭ আগস্ট ২০২৩ ০২:২১; আপডেট: ১৭ মে ২০২৪ ১৭:১৮

পুতিন সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তিনি বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেবেন। ছবি: বিবিসি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অসংখ্য শত্রু ও প্রতিপক্ষ গত দুই দশকে রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মারা গেছেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করা ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন।

তিনি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন। প্রিগোশিন মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরও তার বিমান বিধ্বস্তের কারণ এখনেও পরিষ্কার নয়।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য থেকে যেসব ইঙ্গিত করা হচ্ছে তার অর্থ হচ্ছে - এই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা যে মস্কোর দ্বারা সাজানো তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও এই ইঙ্গিত হলিউড চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো মনে হতে পারে।

কারণ এর আগেও প্রেসিডেন্টের প্রতিপক্ষ, সমালোচক বা ভিন্নমত অবলম্বনকারীদের পুরোপুরি এভাবে মুছে দিয়েছে রাশিয়ান সিক্রেট সার্ভিস

ঠান্ডা মাথায় প্রতিশোধ

কয়েক মাস আগেও প্রিগোশিন ছিলেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাদের এই ঘনিষ্ঠতা বেশ পুরনো। ভ্লাদিমির পুতিন যখন সেইন্ট পিটার্সবার্গের মেয়র ছিলেন তখন থেকে এই ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত।

তবে এই ঘনিষ্ঠতার ইতি ঘটে গত ২৩ জুন। টানা কয়েক মাস ধরে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ইউক্রেন অভিযান ঘিরে নানান সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রিগোশিন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২৩ জুন তার সৈন্যদের সীমান্তবর্তী শহর রোস্তভ-অন-ডন দখলে নিতে নির্দেশ দেন। তবে ঘটনা সেখানেই শেষ না। প্রিগোশিন তার দলকে নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করেন এবং তার দাবি ছিল প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের পদত্যাগ।

২০১৫ সালে পুতিনের বিরোধী পক্ষকে নেতৃত্ব দিয়ে আসা সাবেক ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার বরিস নেমেতসভকে মস্কোয় গুলি করে হত্যা করা হয়

যদিও বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় এই বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু তার আগে ওয়াগনার বাহিনী যেভাবে একটা শহর দখল করে রাজধানীর প্রায় প্রবেশপথ পর্যন্ত কোনো রকম বাধা ছাড়াই পৌঁছে যায়, অনেককে বেশ অবাক করে দেয়।

ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল সেই সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন তার বিরক্তি লুকাননি এবং এই বিদ্রোহকে একটা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করে এর সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির ঘোষণা দেন। একইসাথে এই বিদ্রোহ 'রাশিয়ার পিঠে ছুঁড়ি মারার মতো' এবং যারা এর নেতৃত্বে ছিল তাদের 'বিশ্বাসঘাতক' বলেন তিনি।

সে বিদ্রোহের পর থেকে প্রিগোশিন রাশিয়ার ভেতরে এবং বাইরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এর দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে প্রতিশোধ নেবার ক্ষেত্রে পুতিন তাড়াহুড়ো করতে চাননি। তিনি হয়তো বিশ্বাস করেন - 'প্রতিশোধ হলো সেই খাবার যেটি একদম ঠান্ডা করে পরিবেশন করতে হয়।'

এটি অনুমিতই ছিল

যদিও খুব দ্রুত ঘটে গেল তারপরও প্রিগোশিনের নিহত হওয়াকে অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। বিশেষ করে পুতিন ক্ষমতায় আসার পর থেকে তার অন্তত বিশজন প্রতিপক্ষ, সমালোচক বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ খুব অদ্ভুত উপায়ে রাশিয়া অথবা রাশিয়ার বাইরে মারা গেছেন।

এদের মধ্যে একেবারে প্রথমদিকে মারা যাওয়াদের একজন ভ্লাদিমির গোলোভলিয়ভ, যাকে মস্কোর রাস্তায় কুকুর নিয়ে হাঁটার সময় গুলি করা হয়। এই আইনপ্রণেতা পুতিনকে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা পর্যন্ত সমর্থন করেছেন। কিন্তু এরপরই তার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং তিনি পুতিনের সমালোচনা করতে থাকেন।

তার মৃত্যুর পূর্বে রাশিয়ার ক্ষমতাসীন দল অভিযোগ করে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর যখন সবকিছু বেসরকারিকরণ করা হয় - সে সময় গোলোভলিয়ভ অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করেন।

অনেকেই মনে করেন নির্বাসনে থেকে মস্কোর প্রতিশোধের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি অলিগার্ক বরিস বেরেজোভস্কি এর এক বছরেরও কম সময় পর আরেক লিবারেল এমপি সের্গেই ইউশেঙ্কোভকে গুলি করা হয় মস্কোর রাস্তায়।

১৯৯৯ সালে সেপ্টেম্বরে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে যে হামলা হয় তার তদন্তে গঠিত সংসদীয় কমিটির প্রধান ছিলেন ইউশেঙ্কোভ। মস্কো এই হামলার জন্য চেচেন উগ্রবাদীদের দায়ী করে।

২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে অন্যতম ঘৃণিত একটা অপরাধ ঘটে। সাংবাদিক আনা পোলিতকোভস্কায়ার হত্যা। যিনি রাশিয়ান সংবাদমাধ্যম নোভায়া গ্যাজেটায় চেচনিয়ায় ক্রেমলিন বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার নিন্দা জানান।

যদিও ২০১৪ সালে এই অপরাধে পাঁচজন কথিত লেখককে দীর্ঘ কারাবাসে পাঠানো হয়, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনই শনাক্ত করতে পারেনি যে খুনিদের কে ভাড়া করেছিল এবং ২০২১ সালে এ নিয়ে মামলা দায়ের হয়।

২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আরেকটি হত্যাকান্ডে সন্দেহ আরও জোরালো হয় যে ক্রেমলিন কৌশলে তার প্রতিপক্ষদের সরিয়ে দেয়। সে দিন সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী বরিস নেমেতসভ খুন হন। যে জায়গাটিতে তাকে হত্যা করা হয় - সেটি পুতিনের অফিস ভবনের খুব কাছে।

নব্বই দশকের শেষ দিকে নেমেতসভ ছিলেন রাশিয়ার রাজনীতিতে এক উঠতি তারকা। এই উদারমনা বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদকে ভাবা হচ্ছিল সে সময়ের প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিনের পরবর্তী উত্তরসূরী, কিন্তু যিনি পরবর্তীতে সাবেক গুপ্তচরকেই বেছে নেন।

একদম প্রায় শুরু থেকেই এই নিখোঁজ রাজনীতিবিদ পুতিনের কড়া সমালোচনা শুরু করেন, বিশেষ করে তার ইউক্রেন নীতি এবং নিজের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করে রাখার মনোভাবের জন্য। তার এই অবস্থান তাকে অন্তত তিনবার কারাগারে নেয়।

২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় তিনি পুতিনের বিরুদ্ধে নির্বাচনের চেষ্টা করেও সরে আসেন। কিন্তু এর এক বছর পর তিনি তার অন্যান্য সব পুতিন বিরোধীদের নিয়ে সলিডারিটি পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন, যাদের মধ্যে ছিলেন দাবার সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভও।

কারা সাংবাদিক আনা পোলিতকোভস্কায়াকে মারার আদেশ এবং অর্থ দিয়েছিল তা রাশিয়ায় কখনই তদন্ত করা হয়নি নেমেতসভের হত্যাকারীরা চেচেন বাহিনীর নেতৃত্বের একটা অংশ রাদমান কাদিরভের অনুসারী হলেও, এই অপরাধের সঙ্গে পুতিনের মিত্র হিসেবে স্বীকৃত কাদিরভের সংশ্লিষ্টতা কখনই তদন্ত করা হয়নি।

২০০০ সালের পর আরও ছয়জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী যারা পুতিনের সমালোচনা করেছেন রাশিয়ায় তাদের হত্যা করা হয়েছে।

নির্বাসনও নিরাপদ আশ্রয় নয়

তবে প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মারা যাওয়ার এই তালিকা শুধুমাত্র রাশিয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। যারা চলে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে রাশিয়ার বাইরে গেলে তারা নিরাপদ এমন অনেকেও আছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম সাবেক গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিতভিনেঙ্কো, যিনি ২০০৬ সালের নভেম্বরে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করে লন্ডন হাসপাতালে মারা যান। পরে এক তদন্তে জানা যায় যে সাবেক এই গুপ্তচর পলোনিয়াম ২১০-এর বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন, যা খুবই উচ্চমাত্রার একটা রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থ।

লিতভিনেঙ্কো এই শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন, তখন তিনি জানান যে তার উর্ধ্বতন তাকে অলিগার্ক বরিস বেরেজোভস্কিকে হত্যার আদেশ দিয়েছে।

প্রিগোজিনের বিমান কীভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে তা এখনেও জানা যায়নি বেরেজোভস্কি হলেন দেশের বাইরে প্রাণ হারানোদের আরেকজন। ২০১৩ সালের মার্চে এই ব্যবসায়ীর মৃতদেহ পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের দক্ষিণপূর্বে তার নিজ বাড়ি সারেতে।

কেউ কেউ বলে থাকেন যে আর্থিক দেনার কারণে এই অলিগার্ক আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু তার নির্বাসনের সময়টায় তার ওপর অনেকগুলো হামলা হয় এবং মস্কোর দ্বারা একটানা বিচারিক প্রহসনের স্বীকার হওয়ার কারণে কারো কারো ধারণা তাকে হত্যা করা হয়েছে।

ইয়েলেতসিনের শাসনামলে অঢেল সম্পদ অর্জন করেন বেরেজোভস্কি, পরে তিনি পুতিনের সঙ্গেও সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং তার প্রথমবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তহবিল যোগান তিনি। তবে মতবিরোধ দেখা দেয় যখন ক্রেমলিন তার মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল বাজেয়াপ্ত করে।

২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যে নির্বাসনে থাকা ভিন্নমতাবলম্বী আরেক রাশিয়ান মস্কোর দ্বারা হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ ওঠে। সাবেক গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপাল এবং তার মেয়ে ইউলিয়াকে এক রাশিয়ান এজেন্ট ইংলিশ শহর সালিসবুরিতে নভিচক বিষ প্রয়োগ করেন বলে জানা যায়।

স্ক্রিপাল রাশিয়ার সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট (জিআরইউ)-এর হয়ে কাজ করেন, একইসাথে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থা এমআইসিক্সের ডাবল এজেন্ট। ২০০৪ সালে রাশিয়ায় গ্রেফতার হন তিনি। তাকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে ১৩ বছরের সাজা দেয় রাশিয়ান আদালত, কিন্তু পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে আটক তাদের কিছু এজেন্টের সঙ্গে স্ক্রিপালকে বিনিময় করে মস্কো।

রাশিয়ান তেল জায়ান্ট লুকোইল সভাপতি রাভিল ম্যাগানভের মৃত্যু যেন প্রমাণ করে যে ক্রেমলিন তার বিরোধীদের ছাড় দেয় না এই হামলার পেছনে লন্ডন রাশিয়ান ইন্টিলিজেন্সের দু’জন সদস্যকে শনাক্ত করে এবং মস্কোকে তাদের হস্তান্তর করতে বলে।

কিন্তু, রাশিয়ার সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা যায়নি এবং তারা লন্ডনের অনুরোধ নাকচ করে দেয়। যে সূত্র ধরে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের আগে থেকেই তাদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল।

কোন ছাড় নেই

এই তালিকায় নিশ্চিতভাবেই আরও অন্তত ছয়জন আলিগার্ক ও সাবেক রাশিয়ান কর্মকর্তার নাম যোগ হবে - যারা ইউক্রেনে অভিযান শুরুর পর রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন।

এর মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগানো মৃত্যু হলো রাশিয়ান জ্বালানি তেলের জায়ান্ট লুকোইলের প্রেসিডেন্ট রাভিল ম্যাগানভ। তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বরে মস্কোয় যে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সেখানে ‘জানালা দিয়ে পড়ে’ মারা যান, কর্তৃপক্ষ এমনটাই জানিয়েছে।

“গত দুই দশকে পুতিনের বার্তা পরিষ্কার - প্রতিপক্ষ সহ্য করা হবে না এবং তারা চরম পরিণতি ভোগ করবে,” বার্মিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফান উলফ তার এক নিবন্ধে এমন সতর্কবার্তা লেখেন।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্টের এই পদ্ধতি ‘খুবই কার্যকর’, কারণ এটা ‘বিরোধীদের যেমন থামিয়ে দেয়’ তেমনি ‘অভ্যন্তরীণ যেকোনো চ্যালেঞ্জের’ ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পান পুতিন।

তবে সে যাই হোক, পুতিনের এই পদ্ধতির একটি অসুবিধাও আছে, তা হলো এই রাশিয়ান নেতা যাদের নিয়ে কাজ করছেন - এটা তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস আর মানসিক সন্দেহ তৈরি করবে।

সূত্র : বিবিসি



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top