মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়া সংঘাতের শেষ কোথায়?
রাজ টাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৩১; আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২৫ ০১:০৫

মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ক্রমশই বাড়ছে এবং তা ছড়িয়ে পড়ছে। ফিলিস্তিনের পর এবার ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে যুক্ত হয়েছে লেবানন ও ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বেশ পুরনো। তবে টানা অনেক বছর ধরেই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত কিছু আড়ালে পড়ে গিয়েছিল।
এতে মনে হয়েছিল, এবার সবকিছুর মোড় ঘুরে যাবে। কিন্তু এক বছর আগে ৭ অক্টোবর থেকে আবারও শুরু হয় ইসরায়েলি আগ্রাসন। ওইদিন ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী হামাসের হামলার প্রেক্ষিতে জোরালো হয় এই আগ্রাসন।
নতুন করে শুরু করা ইসরায়েলের এই ধ্বংসযজ্ঞের আগে ২০২৩ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংঘটিত সেই হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, ‘গত দুই দশকের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য আজ অনেকটাই শান্ত।’
কিন্তু জ্যাক সুলিভানের ওই বক্তব্যের পর আজ এক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে। এই সময়ে ৪১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন। গাজার দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন আরও ৬০০ জন।
এই ধ্বংসযজ্ঞের রেষ ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননেও। সেখানে ইসরায়েলি হামলায় দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও অন্তত ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী হামাসের হামলা ইসরায়েলে চালায়। সেই হামলার প্রথম দিনেই এক হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত হন। এরপর গাজায় ৩৫০ জনের বেশি ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন।
গাজার কাছাকাছি ও লেবাননের উত্তর সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত প্রায় দুই লাখ ইসরায়েলি নাগরিক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওইসময় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে রকেট হামলা চালিয়। এতেও প্রায় ৫০ জন সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
ইরাক ও ইয়েমেনের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত শুরু হয়। শুধু তাই নয়, ইসরায়েল ও ইরানের মাঝে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এটি সহসা থামবে বলে মনে হচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতে যে আরও ঘটবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের প্রভাব আগের চেয়ে তুলনামূলক কম বলে মনে হচ্ছে।
গত বছরের ৭ অক্টোবরের আগে গাজার বাসিন্দাদের জীবন কেমন ছিল, তা মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে। কারণ, গণমাধ্যম ক্রমাগত মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ আশঙ্কার কথা বলছে।
হামাস যাদেরকে জিম্মি করে নিয়ে যায়, তাদের একজন নিমরোদ কোহেন। তার বাবা ইয়েহুদা কোহেন গত সপ্তাহে ইসরায়েলি কান নিউজকে বলেন, ‘আমাদেরকে একপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
কোহেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করে বলেন, দেশকে একটি ‘অর্থহীন যুদ্ধের দিকে’ ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েলি নাগরিকদেরকে সম্ভাব্য শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি নেতানিয়াহুকে দায় দিয়েছেন।
অবশ্য সব ইসরায়েলি যে ইয়েহুদা কোহেনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত, বিষয়টা তেমন নয়। অনেকে হামাসের ওই আক্রমণকে অন্যভাবে দেখেন। তারা মনে করেন, ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েলের শত্রুদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল সাতই অক্টোবরের ওই হামলা।
তবে পেজার বিস্ফোরণ, বিভিন্নজনকে লক্ষ্য করে হত্যাকাণ্ড, দূর থেকে বোমা হামলা চালানো এবং গোয়েন্দাদের নেতৃত্বাধীন অভিযান পরিচালনাসহ আরও নানা উপায়ে ইসরায়েলও পাল্টা আঘাত করেছে। এসব পদক্ষেপের মাঝ দিয়ে দেশটি তার এক বছর আগে হারিয়ে ফেলা আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করেছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে এখন এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে ইসরায়েল পৌঁছাতে পারে না।’
৭ অক্টোবরের হামলার পর নেতানিয়াহুর জনসমর্থন (ভোট রেটিং) তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু এখন ফের তা ধীরে ধীরে বাড়তে দেখছেন তিনি। তার জন্য এটি হয়তো আরও বড় কোনও দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের একটি ছাড়পত্র।
মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে?
সম্প্রতি বিবিসির টুডে পডকাস্টে ইরানে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত সিমন গাস বলেন, ‘আমরা কেউ-ই জানিনা এই সংঘাত কখন থামবে এবং সেসময় আমরা সবাই কোথায় থাকব।’
এই সংকট মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলার সাম্প্রতিক সময়ের ইসরায়েল সফর দেখে মনে হয়, কূটনৈতিক উপায় খোঁজার চেয়ে ব্যবস্থাপনার দিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি মনোযোগী।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বাকি আর মাত্র চার সপ্তাহ। এখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে বিষাক্ত অবস্থায় আছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কোনও সাহসী ও নতুন উদ্যোগ নিবে বলে মনে হয় না। আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হলো বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ধারণা, গত সপ্তাহে ইরান ইসরায়েলের ওপর যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, সেটির জবাব দেওয়ার অধিকার আছে ইসরায়েলের, এটি ইসরায়েলের কর্তব্যও।
ওই হামলায় কোনও ইসরায়েলি নিহত হয়নি। হামলার ধরন দেখে মনে হয়, সামরিক ও গোয়েন্দা লক্ষ্যবস্তু নিশানা করেছিল ইরান। কিন্তু নেতানিয়াহু ওই হামলার কঠোর জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।
সরাসরি ইরানের জনগণকে উদ্দেশ্য করে দেওয়া ভাষণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেছেন যে তেহরানের সরকারে পরিবর্তন আসছে। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত ইরান যখন মুক্ত হবে, তখন সবকিছু পাল্টে যাবে। সেই সময়টি এত তাড়াতাড়ি আসবে যে তা মানুষের ধারনারও বাইরে।’
২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের আগে মার্কিন নব্যরক্ষণশীলরা এমনভাবেই কথা বলতো। নেতানিয়াহুর বক্তব্য যেন তাদের কথারই প্রতিধ্বনি বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনার জন্য দুর্বল হলেও কিছু বাধা এখনো রয়ে গেছে।
ইরানে সরকার পরিবর্তনের যে আশঙ্কা, তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এজেন্ডা বা লক্ষ্যের মাঝে নেই। এমনকি, ভাইস প্রেসিডেন্টের এজেন্ডাতেও তা নেই।
২০১৯ সালের জুনে ইরান একটি মার্কিন সার্ভেইল্যান্স ভূপাতিত করার পর এক পর্যায়ে মনে হয়েছিল যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানে হামলা করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটেন। যদিও এর সাত মাস পর তিনি ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আজ থেকে এক বছর আগে খুব কম মানুষই কল্পনা করেছিলো যে, মধ্যপ্রাচ্য এতটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দশকের মাঝে এমনটা আসেনি। মধ্যপ্রাচ্যের পথে পথে এখন অনেক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এখনও উদ্বেগজনক গতিতে নানান ধরনের ঘটনা ঘটছে সেখানে। নীতিনির্ধারকসহ সবাই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
গাজা যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পড়েছে। এই যুদ্ধ যখন শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হবে, তখন গাজাকে কিভাবে পুনর্গঠন ও পরিচালনা করা হবে, তা নিয়েও এখন কোনও কথাবার্তা হচ্ছে না। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের চলমান বিরোধ সমাধান নিয়ে আলোচনাও বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও একদিন যদি ইসরায়েলের মনে হয় যে তারা হামাস ও হিজবুল্লাহর যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে বা যখন মার্কিন নির্বাচন শেষ হবে, তখন হয়তো সংকট সমাধানের সুযোগ আসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, সংকট সমাধানের পথ আরও অনেক দূরে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: