কাঁচামাল আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার!

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ আগস্ট ২০২২ ১৭:৩৭; আপডেট: ৪ আগস্ট ২০২২ ১৭:৩৮

ফাইল ছবি

স্মরণকালের সংকটে বাংলাদেশ। বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি প্রত্যক্ষ করেছে জাতি। এ ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। অথচ কয়েক বছর আগে দেশের মোট আমদানিই ছিল এর সমপরিমাণ বা তার চেয়ে কম। আর যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার ৭০ শতাংশের বেশি রপ্তানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমদানি হওয়া কাঁচামালের সঙ্গে মূল্য সংযোজন হয়ে তা রপ্তানি হয়। সেই মূল্য সংযোজনের গড় হার ৩০ শতাংশের কম নয়। অর্থাৎ ১০০ টাকার কাঁচামাল আমদানি করা হলে তার বিপরীতে ১৩০ টাকার পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা। সেটি হলে এত বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি হওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই বিপুল পরিমাণ মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির বিপরীতে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আর সে সন্দেহ পোষণ করেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। খবর শেয়ার বিজ

গতকাল সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে কথা বলেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমরা কাঁচামাল এনে এগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করি। কাঁচামালের সঙ্গে প্রক্রিয়ার খরচ যোগ করে (মূল্য সংযোজন) সেটা যদি রপ্তানি করা হয়, তাহলে আমদানির চেয়ে রপ্তানির পরিমাণ কম হতে পারে না। বিশেষ কারণে একবার দুবার কম হতে পারে। সে জন্য আমরা সব সময় আশা করি, আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হবে।’

দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে বিভিন্ন দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলেন, ‘কতটা দুর্নীতি হয়, আমার কাছে তথ্য নেই। কিন্তু আমরা অনুমান করে বলতে পারি, দুর্নীতি হচ্ছে। তা না হলে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হবে না কেন? আমদানির চেয়ে রপ্তানি যদি বেশি না হয়, তাহলে আমরা রপ্তানিটা কেন করব? এই প্রশ্নটা কিন্তু খুব সহজেই এসে যায়।’

গত অর্থবছর যে আমদানি ব্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা খুবই অস্বাভাবিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থবছরটিতে মোট আমদানি ৮৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। প্রকৃতপক্ষে এত বিপুল পরিমাণ অর্থমূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ আমদানির আড়ালে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা, মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লে কর্মযজ্ঞ বেড়ে যাওয়ার কথা। আর কর্মযজ্ঞ বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কর্মসংস্থান কভিড-পূর্ববর্তী সময়ের মতো বা তার চেয়ে বেশি বেড়েছে কি না, তার নজির নেই। সে কারণে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় এ ধারণা আরও প্রবল হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘দেরিতে হলেও অর্থমন্ত্রী আমদানির আড়ালে অর্থ পাচারের বিষয়টি অনুধাবন করেছেন, বিষয়টি ইতিবাচক। এখন সরকারের উচিত হবে অর্থ পাচারকারীদের খুঁজে বের করে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা। কিন্তু এ খাতে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে, তারা অর্থ পাচার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে না বা রাখতে পারছে না। বিএফআইইউ, এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের সিআইডি ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সমন্বয়ে অর্থ পাচার রোধ করার কথা। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। কারণ যারা অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত, তারা অনেক প্রভাবশালী। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতারও অভাব রয়েছে। সবমিলিয়ে অর্থ পাচার রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।’

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদনের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সাল নাগাদ দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচার হচ্ছে। বর্তমানে এ পাচার ১১ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার হয়ে যেতে পারে। আর এ পাচারের ৭০ শতাংশের বেশিই হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির ইনভয়েস জালিয়াতির মাধ্যমে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের মূলধনি যন্ত্রপাতির পেছনে বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৩৮২ কোটি ডলার।  বিদায়ী অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৫৪৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছর থেকে ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য মূলধনি পণ্যে ১৯ শতাংশ বেড়ে এক হাজার ৯৭ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এছাড়া কাঁচামাল আমদানির পেছনে বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার, যা বিদায়ী অর্থবছরে ৪৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৫১৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৫৮ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৫ কোটি ডলার হয়েছে। অন্য কাঁচামাল আমদানিতে খরচ ৬৪ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৪৯৪ কোটি ডলারে উঠেছে। এর মধ্যে সার আমদানিতে খরচ ২২৩ শতাংশ বেড়ে ৪৩৯ কোটি ডলার হয়েছে। তবে গত অর্থবছর পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে ব্যয় ১১ শতাংশ কমে ৭৯৯ কোটি ডলারে নেমেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৩০৮ শতাংশ আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশের মোট আমদানি ছিল ৩৬ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে তা ১৪৮ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। লোহা, ইস্পাতসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতু আমদানি ব্যয়ও ৬২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৯৩ কোটি ডলারের ধাতু আমদানি হলেও গত অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি।

এতে আরও দেখা যাচ্ছে, বিদায়ী অর্থবছরের গম আমদানি ১৭ শতাংশ বেড়ে ২১৪ কোটি ডলার হয়েছে, যা এর আগের অর্থ বছরে ছিল ১৮২ কোটি ডলার। তবে চালে ৫০ শতাংশ কমে ৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ৮৫ কোটি ডলার। ভোগ্যপণ্য আমদানিতে সামগ্রিকভাবে ৩৯ শতাংশ বেড়ে ৫৭৮ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে শুধু মসলায় ১০ শতাংশ কমে ৩৬ কোটি ডলারে নেমেছে। এছাড়া ভোজ্যতেলে ৫০ শতাংশ বেড়ে ২৮৯ কোটি, ডালে ২২ শতাংশ বেড়ে ৮৩ কোটি, চিনিতে ৬০ শতাংশ বেড়ে ১২৮ কোটি এবং দুধ ও ক্রিমে ২২ শতাংশ বেড়ে ৪২ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ২৫০ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরের চেয়ে যা ৩৬ শতাংশ বেশি। এ সময়ে রপ্তানি আয় ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৯২৫ কোটি ডলার। রপ্তানি আয় অনেক বাড়লেও আমদানির সঙ্গে ব্যবধান বেড়েছে। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৫ কোটি ডলার। গত অর্থবছর রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। রেমিট্যান্স ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারে নেমেছে। আগের অর্থবছর যেখানে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। এতে করে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে ১ হাজার ৮৭০ কোটি ডলারে উঠেছে। আগের অর্থবছর যেখানে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল মাত্র ৪৫৮ কোটি ডলার। ঘাটতি বেড়েছে তিনগুণের বেশি।

খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top