ইউ-পাস এলসি সিস্টেমে বেকায়দায় আমদানিকারকরা
রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৩ আগস্ট ২০২২ ১৯:৫৪; আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ০২:৪০
-2022-08-23-09-53-17.jpg)
স্থিতিশীল অবস্থায় ইউ-পাস এলসি সিস্টেম আমদানিতে সুবিধা দিলেও বর্তমানে তা গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে আমদানিতে বেকায়দায় পড়েছেন আমদানিকারকরা। খবর শেয়ার বিজের।
আমদানিকারকরা সাধারণত ইউ-পাস এলসি সুবিধায় শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করে। এ সুবিধায় আমদানিকৃত পণ্যের পাওনা পরিশোধে সময় থাকে ২৭০ দিন। এ সময়ে একজন আমদানিকারক পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে পণ্য বিক্রয় করে মুনাফা তুলে নেয়, যা দিয়ে সরবরাহকারীর পাওনা পরিশোধ করে। কিন্তু সম্প্রতি ডলারে বিনিময় হার ২০ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়ায় লাভের বিপরীতে বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে দেশের শিল্পের কাঁচামাল আমদানিকারকদের।
আমদানিকারকরা জানান, দেশে ইস্পাত, সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা থাকায় আমদানিকারকরা শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। ইউ-পাস এলসির মাধ্যমে এসব কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়। এসব কাচাঁমাল ও ভোগ্যপণ্য ভ্যালু এডেড পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে একজন আমদানিকারক পণ্যের আমদানি ব্যয় তুলে নেয়। এসব কাজে কমপক্ষে ১৮০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। এরপর একজন আমদানিকারক সরবরাহকারীর পাওনা পরিশোধে ব্যাংক পেমেন্ট নিশ্চিত করে। কিন্তু করোনা সংক্রমণ, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় সময়মতো সরবরাহকারীর পাওনা পরিশোধে জটিল হয়ে ওঠে। এর মধ্যে গত দুই মাসে ডলারের দাম ৮৭ টাকা থেকে কোনো কোনো ব্যাংকে ১০৭ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এতে আমদানিকারকভেদে ১৫-২০ শতাংশ অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হয়। ফলে লাভে বিপরীতে বিপুল লোকসান গুনতে হয় কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ আমদানিকারকদের।
তারা জানান, আমদানির পুরোটায় সমুদ্র পথে আনা হয়। তবে আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনে নানা ক্ষেত্রে জটিলতার শিকার হতে হয়। এক্ষেত্রে আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে মাদার ভেসেলগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙরে আসে। আর বহিঃনোঙর থেকে লাইটার জাহাজ করে পণ্য খালাস করে তা বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। এক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণ থেকে পরিবহন পর্যন্ত সময় লাগে ১০০-১২০ দিন। এর মধ্যে এলসি নেগোশিয়েশন হয়ে বন্দরের জাহাজ আসতে সময় লাগে ৪৫-৬০ দিন এবং বন্দর থেকে পণ্য খালাসে সময় লাগে ৬০-৭৫ দিন। পাশাপাশি এসব পণ্য গুদামজাতকরণ এবং কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করতে আরও ৬০-৮০ দিন সময় লাগে। আর প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য পুরোটাই বাকিতে বিক্রয় করতে হয় বলে পাওনা আদায়ে সময় লাগে ৬০-১২০ দিন। সবমিলিয়ে পণ্যর বিক্রয় টাকা নগদায়ন অর্থাৎ টাকা ক্যাশ কনভারশন সার্কেলের সময় লাগে ২৪০-৩৪০ দিন।
বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, গত তিন মাসের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে সাড়ে আট শতাংশের বেশি। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে সাড়ে ১২ শতাংশ। অপরদিকে খোলাবাজারের ডলারের প্রায় ২৫ শতাংশেরও বেশি।
খোলাবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ১২০ টাকা ডলার প্রতি বিক্রি হলেও গতকাল এর দাম ওঠে ১০৯ টাকা। অপরদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। চলতি বছরের শুরু থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়। গত ১৬ মে ৮০ পয়সা বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় নির্ধারণ করে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। এর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাড়াতে বাড়াতে সর্বশেষ বাংলাদেশে ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, আমদানি খরচ বাড়ায় গত মে মাস থেকে দেশে ডলারের সংকট চলছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমদানি দায় শোধ করা যাচ্ছে না। এর ফলে বেড়ে গেছে ডলারের দাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম এ সময়ে ৮৬ টাকা থেকে ৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। আর রপ্তানি বিল নগদায়ন হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকায়। ফলে আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলারের জন্য ১০৭ থেকে ১০৮ টাকা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। ফলে লাভের বিপরীতে বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে দেশের শিল্পের কাঁচামাল আমদানিকারকদের।
ইউ-পাস এলসি বিষয়ে বেশ কয়েকজন সিনিয়র ব্যাংকার শেয়ার বিজকে বলেন, সাধারণত ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ইউ-পাস এলসি সুবিধা দেয়া হয় না। যদি এসব পণ্যকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে ইউ-পাস এলসি সুবিধা দেয়া হয়। এ সুবিধার আওতায় একজন আমদানিকারক পণ্যের মূল্য পরিশোধে ২৭০ দিন সময় পায়। এটাই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনকৃত নির্ধারিত সময়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমদানিকারকের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও কিছু সময় বাড়িয়ে দেয়। যদিও করোনা সংক্রমণের সময় এ সুবিধা ৩৮০ দিন করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে সময় বাড়িয়ে দিলে আমদানিকারকের লাভ হয়, তাকে মুনাফাসহ তো মূল টাকা ডলারে পেমেন্ট দিতে হবে। তাহলে তার ব্যয় বাড়বে। কমবে না।
এ বিষয়ে দেশের ইস্পাত খাতের একটি কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা সাধারণত এ-পাস এলসি’র মাধ্যমে ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানি করি। এক্ষেত্রে সরবরাহকারীর পাওনা পরিশোধে ১৮০ দিন সময় পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ করে ডলারের দাম ৮৭ টাকা থেকে ১০৭ পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে দাম বেড়ে যায়। এতে আমাদের অতিরিক্ত প্রায় ২০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এ কারণে ইস্পাত পণ্যের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ।
প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, আমি যখন এলসি ওপেন মূল খবরের লিঙ্ক করছি তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ বা ৮৭ টাকা। আর পেমেন্টের সময় ব্যাংকগুলো ৯৫ টাকা থেকে শুরু করে ১১০ টাকা পর্যন্ত নিয়েছিল। কিন্তু আমার অপরাধ কি ছিল? আমি কোনো ডলারের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করব? এ অতিরিক্ত খরচটা বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা হিসেবে আমাদের দিতে পারে। অপরদিকে ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো গ্রাহক থেকে ডলারের দাম নিয়েছিল। যা ব্যাংকিং বিজনেসের নামে ডাকাতি করেছে। এ কাজে ১২টি ব্যাংক জড়িত এখন প্রমাণিত হচ্ছে। আগের বছর একটি ব্যাংক ফরেন কারেন্সিতে ২০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে, এ বছরের ৪০০ শতাংশ মুনাফা করেছে। এটা কীভাবে সম্ভব? তারা আমাদের কাছ অন্যায়ভাবে ডলারের অতিরিক্ত মূল্য দিয়েছে। এ টাকা আমাদের ফেরত দিতে হবে। পাশাপাশি তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: