গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে চরমে, বৃহৎ শিল্প খাতে উৎপাদন ব্যাহত

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট ২০২২ ২২:১০; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ১৬:৩২

ছবি: সংগৃহিত

দেশে ধীরে ধীরে তীব্র আকার ধারণ করছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। ফলশ্রুতিতে বিপাকে পড়ছে দেশের উৎপাদনশীল শিল্প কারখানা। ব্যাহত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন কার্যক্রম। খবর বণিক বার্তার।

দেশে বৃহৎ শিল্পের সংখ্যা তিন হাজারের কিছু বেশি। উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত মোট কর্মসংস্থানের ৬৮ শতাংশই এ খাতে। এছাড়া কাঁচামালের ৬৩ শতাংশ ও বিদ্যুৎ-জ্বালানির ৫৬ শতাংশই ব্যবহার করে বৃহৎ শিল্পগুলো। কিন্তু বর্তমানে তীব্র গ্যাস সংকটে ভুগছে বৃহৎ শিল্পের কারখানাগুলো, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সিরামিক ও বস্ত্র শিল্পের কারখানাগুলোকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের সংকট এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে কখনো কখনো সিরামিক খাতের কারখানাগুলোয় উৎপাদন ক্ষতি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় কাঁচামাল প্রক্রিয়াকরণ কাজ চলাকালেই গ্যাসের চাপ কমে যায়, এতে প্রচুর কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে। সিরামিকের মাটি একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা পরে আর ব্যবহার করা যায় না। গ্যাস সংকটের কারণে বস্ত্র শিল্পেও উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। যার কারণে নির্ধারিত সময়ে ক্রেতার কাছে পণ্য পাঠানোর বিষয়টিও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে।

সিরামিক শিল্পোদ্যোক্তাদের অভিযোগ, জামালপুরে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে ওই এলাকাসংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানাগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলা হচ্ছে। শিল্প মালিকরা বিভিন্ন বিকল্প পন্থায় উৎপাদন সচল রাখতে চেষ্টা করছেন। তবে এ কাজে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। পরিস্থিতির কারণে বৃহৎ একটি সিরামিক পণ্যের কারখানায় টানা তিনদিন উৎপাদন বন্ধও রাখতে হয়েছে।

বাংলাদেশের সিরামিক খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান আরএকে সিরামিকস (বাংলাদেশ) লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, সরকার বিদ্যুৎকে অগ্রাধিকার দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাস সরবরাহকে প্রাধান্য দিতে গিয়েই গ্যাসের চাপ কমে যাচ্ছে। অথচ ম্যানুফ্যাকচারিং কনসার্ন যারা আছে বা যারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রয়োজন মেটানোও বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি কারণ। এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে কিন্তু পণ্য উৎপাদনে তা কাজে লাগবে না—এমন পরিস্থিতি যদি সৃষ্টি হয়, তাহলে কি উৎপাদিত বিদ্যুতের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে? তাই আমরা বলছি বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেয়ার পাশাপাশি উৎপাদনমুখী শিল্পগুলোকেও অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। এসব শিল্পেও প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা প্রয়োজন।

গ্যাসের চাপ নিয়ে সমস্যার বিষয়ে আলোচনার জন্য চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) একটি প্রতিনিধি দল পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছে।

সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডিবিএল সিরামিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, কেবল যে গ্যাসের চাপ কম তা-ই নয়, একটা নির্দিষ্ট সময় সরবরাহও বন্ধ থাকে। চাপ যখন শূন্যে চলে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়। ফলে উৎপাদন পর্যায়ে অনেক বেশি অপচয় হচ্ছে। সম্প্রতি এ সমস্যা অনেক বেড়েছে।

ভারী শিল্পের মধ্যে ইস্পাত ও সিমেন্টের মতো বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তারাও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বিদ্যুতের সমস্যার বিষয়টিকে বড় সংকট বলে জানিয়েছেন তারা। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ছুটির দিনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে খাত দুটির ওপর। অন্যদিকে গ্যাসেরও চাপ কম। অনুমোদিত পিএসআই ১৫-এর বদলে পাওয়া যাচ্ছে দুই বা তিন পিএসআই। যার কারণে প্রভাবিত হচ্ছে ইস্পাত ও সিমেন্টের উৎপাদন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) কো-চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সেক্রেটারি জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, স্বাভাবিক সময়ে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে উৎপাদন সেই ৬০ শতাংশেরও নিচে নেমেছে। ইস্পাত ও সিমেন্ট মিলিয়ে উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশের মতো।

একই ধরনের সমস্যার কথা জানিয়েছেন বস্ত্র খাতের শিল্পোদ্যোক্তারাও। তারা বলছেন, বৃহৎ শিল্পগুলোতে একধরনের মন্দা বিরাজ করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চাহিদায় ভাটা পড়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলোয় ক্রয়াদেশও কমছে। তার ওপর গ্যাসের চাপ কম হওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অব্যবহূত থাকছে। যা লোকসান বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি ফজলুল হক বলেন, গ্যাসের সমস্যা সারা দেশেই। শিল্পোদ্যোক্তাদের সবার জন্যই পরিস্থিতি খারাপ। গ্যার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন নয়, কখনো থাকে আবার কখনো থাকে না। সারা দিনে বিদ্যুৎও অনেকবার যায়। সপ্তাহে এখন নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট এলাকার কারখানা বন্ধ থাকে। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা থাকে যে বাকি দিনগুলো ভালো চলবে, কিন্তু আদতে তা হচ্ছে না। প্রতিদিনই পাঁচ-ছয়বার বিদ্যুৎ চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন সক্ষমতার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। মূলত গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণেই এ অবস্থা সৃষ্টি হযেছে।

গ্যাস সংকটের পরিস্থিতি উঠে এসেছে ময়মনসিংহ ভালুকা এলাকার বাস্তব চিত্রে। ময়মনসিংহের ভালুকায় বিদ্যুৎ লোডশেডিং, গ্যাসের সরবরাহ অপ্রতুল ও চাপ কম থাকায় শিল্প এলাকায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট এভাবে থাকলে অনেক মালিক তাদের মিল বন্ধ করে দেয়ার চিন্তাভাবনাও করছেন। ভালুকায় ভারী শিল্পের অনেক কোম্পানিতে ১০-১২ হাজার শ্রমিক কর্মরত। ফলে কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন।

ভালুকা উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নের ছোট-বড় প্রায় দুই শতাধিক শিল্প-কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে অন্তত ১২০টি কারখানা আছে যেগুলো বৃহৎ, শ্রমিক সংখ্যা ন্যূনতম ১ হাজার। প্রায় ৩০টি ডায়িং কারখানা রয়েছে। বিদ্যুৎ লোডশেডিং, গ্যাসের সরবরাহ অপ্রতুল ও প্রেসার কম থাকায় ডায়িং কারখানাগুলোয় উৎপাদন প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে পিডিবি ১২-১৪ ঘণ্টা এবং আরইবি ১৬-১৭ ঘণ্টা লোডশেডিং দিচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। দিনের বেলা গ্যাসের লাইন চালু থাকলেও প্রেসার কম থাকায় মেশিন ঠিকমতো চালাতে পারছে না মিল কর্তৃপক্ষ।

গ্যাসের অব্যাহত কম চাপ এবং সন্ধ্যা থেকে সারা রাত সরবরাহ বন্ধ থাকায় এর প্রতিকার চেয়ে উপজেলা মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের গাদুমিয়া গ্রামে অবস্থিত তাইপে বাংলা ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরোয়ার হোসেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বরাবর ১০ পিএসআই গ্যাস সরবরাহের আবেদন করেন। আগে গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মিল চালানো হতো। গ্যাসের চাপ কম থাকলে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ অথবা ডিজেলচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে মিল চালানো হতো। বর্তমানে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ ব্যাপক হারে বেড়েছে। সাড়ে তিনশ শ্রমিকের একটি মিলে আগে সারা দিনে বিদ্যুতের জন্য ১-২ লিটার ডিজেল লাগত। বর্তমানে গড়ে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ লিটার তেল লাগছে।

তাইপে বাংলা ফ্যাব্রিকস লিমিটেডের ডিজিএম আশিকুর রহমান বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে তাদের কারখানার ২৭টি মেশিনে মধ্যে দু-একটি মেশিন চালু রাখা গিয়েছে। ফলে সঠিক সময়ে পণ্য উৎপাদন করতে পারছেন না তারা। ফলে বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ হচ্ছে। এ মাসে কর্মীদের বেতন দেয়াও কঠিন হবে। কোম্পানিটি শতভাগ রফতানিমুখী হওয়ায় এটি বন্ধ হলে প্রায় ৮০০ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বেন।

শতভাগ রফতানিমুখী শেফার্ড গ্রুপের জিএম মোকলেছুর রহমান জানান, সংকটের কারণে তাদের মিলের উৎপাদন ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে। বিদেশী মিল মালিকরা ভর্তুকি দিয়ে শ্রমিকদের বেতন চালাচ্ছেন। এ সমস্যা অব্যাহত থাকলে ছোট ছোট অনেক মিল বন্ধ হয়ে যাবে।

ভালুকা পিডিবি কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এজেডএম আনোয়ারুজ্জামান জানান, গতকাল ভালুকায় ১৭ থেকে সাড়ে ১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। তার বিপরীতে পাওয়া গিয়েছে মাত্র সাড়ে ৬ মেগাওয়াট।

তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের ভালুকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ম্যানেজার প্রকৌশলী মঞ্জুর আহাম্মেদ জানান, আগে মূল সঞ্চালন লাইনে গ্যাসের চাপ ছিল ১২০-১৩০ পিএসআই। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০-৪০ পিএসআই। যেসব কারখানা মূল লাইনের কাছাকাছি তারা চাপ তুলনামূলক বেশি পায়। কিন্তু দূরের কারখানাগুলোতে চাপ কমে যায়। রাতে অপারেশন বিভাগ থেকেই গ্যাসের লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top