দুই টার্মিনালের সক্ষমতা অব্যবহৃত, আরো দুটি এলএনজি টার্মিনালের প্রস্তাব

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৫ আগস্ট ২০২২ ১৭:১০; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ১৪:৫১

ছবি: সংগৃহিত

দেশে বর্তমান দুই এলএনজি টার্মিনাল শতভাগ ব্যবহার না হলেও নতুন করে আরো দুইটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেট্রোবাংলা। খবর বনিক বার্তার।

দেশে এলএনজি আমদানি হচ্ছে ২০১৮ সাল থেকে। এজন্য পরিচালিত হচ্ছে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ)। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে নির্মিত টার্মিনাল দুটি পরিচালনা করছে স্থানীয় ও বিদেশী দুটি কোম্পানি। টার্মিনাল দুটির দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ১০০ কোটি ঘনফুট। যদিও এ সক্ষমতার প্রায় অর্ধেকই ব্যবহার করা যাচ্ছে না এলএনজি সংকটে। এর মধ্যেই আবার নতুন করে ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার আরো দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে নীতিগত সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে পেট্রোবাংলা।

বিদ্যমান অবকাঠামোগুলোর সক্ষমতা অনুযায়ী এলএনজি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে আবার নতুন করে টার্মিনাল নির্মাণ করতে গেলে জ্বালানি বিভাগ ভয়াবহ আর্থিক চাপে পড়বে বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এমনিতেই বিদ্যমান অবকাঠামোগুলোর সক্ষমতা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে পেট্রোবাংলা। এর ওপর একই সক্ষমতার দুটি নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করে গ্যাস সরবরাহ দিতে না পারলেও শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের অর্থ জোগান দিতে গিয়েই আর্থিকভাবে আরো বিপত্তিতে পড়ে যাবে সংস্থাটি।

দৈনিক ১ হাজার মিলিয়ন বা ১০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার এ টার্মিনাল পরিচালনা করবে স্থানীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কোম্পানি সামিট গ্রুপ ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি। এরই মধ্যে কোম্পানি দুটি তাদের এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পেট্রোবাংলার কাছে জমা দিয়েছে। এ প্রস্তাব অনুযায়ী, কক্সবাজারের মহেশখালীতে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার এলএনজির ভাসমান টার্মিনাল পরিচালনা করবে সামিট। অন্যদিকে পটুয়াখালীর পায়রায় একই সক্ষমতার টার্মিনাল পরিচালনা করবে এক্সিলারেট এনার্জি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সামিট ও এক্সিলারেটের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত কিছু হয়নি। প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা চলছে।

ভাসমান টার্মিনালগুলো নির্মাণে এমন এক সময় উদ্যোগ নেয়া হলো, যখন বিশ্বব্যাপী গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বালানির বহুমুখী উৎস তৈরি করতে অনেক দেশই এখন এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণ করছে। এরই মধ্যে জার্মানি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এ খাতের জায়ান্ট কোম্পানিগুলোকে বুকিং দিয়ে রেখেছে। এর বাইরে নেদারল্যান্ডস, ইতালির মতো দেশও এখন এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণে তোড়জোড় শুরু করেছে। সেই অর্থে এলএনজির অবকাঠামো নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে শিগগিরই টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু করা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। যদিও পেট্রোবাংলা বলছে, আগামী ২০২৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ এ দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।

টার্মিনাল দুটি নির্মিত হবে বিল্ড ওউন অপারেট ট্রান্সফারের (বুট) ভিত্তিতে। এ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করবে কোম্পানি। এ সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে সরকারের পক্ষ থেকে টার্মিনাল পরিচালনা ও রিগ্যাসিফিকেশনের ব্যয়ও পরিশোধ করা হবে। নির্দিষ্ট সময় শেষে ভাসমান টার্মিনাল দুটোর মালিকানা সরকারকে হস্তান্তরও করা হবে।

বর্তমানে কক্সবাজারের মহেশখালী টার্মিনাল দুটি দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও স্পট থেকে কেনা এলএনজির সরবরাহ নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। যদিও বিশ্ববাজারে জ্বালানি পণ্যের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে স্পট এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে জ্বালানি বিভাগ। যে কারণে জাতীয় গ্রিডে গতকালও গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ৫৮১ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বিদ্যমান এলএনজি সরবরাহ সক্ষমতার অর্ধেকের কিছু বেশি।

নির্মিতব্য টার্মিনাল দুটির জন্য শুরুতে এলএনজি আমদানিরও প্রস্তাব দিয়েছিল কোম্পানি দুটি। প্রস্তাবে এলএনজির মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতিও উল্লেখ করা হয়। সামিটের প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানটির আমদানির জন্য প্রতি এমএমবিটিইউ (মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) এলএনজির মূল্য ধরা হয় ২০ ডলার। হেনরি হাব ইনডেক্স অনুসরণের ভিত্তিতে এ মূল্যহার প্রস্তাব করেছিল কোম্পানিটি। অন্যদিকে জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া (জেকেএম), চীন ও তাইওয়ান যে দামে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনে, সে দামে বাংলাদেশের কাছে জ্বালানি পণ্যটি বিক্রির প্রস্তাব দেয় এক্সিলারেট এনার্জি। এজন্য ২০২৩ সাল থেকে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের তিন মাসের গড় মূল্য হিসাব করে সরবরাহকৃত এলএনজির দাম ধরা হবে বলে জানিয়েছিল মার্কিন কোম্পানিটি।

তবে গ্যাসের দাম স্থিতিশীল না হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প প্রস্তাবের বিভিন্ন অংশে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, সামিট ও এক্সিলারেটের সঙ্গে বুট ভিত্তিতে টার্মিনাল নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। গ্যাস আমদানির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। এখন তারা শুধু টার্মিনাল নির্মাণ করবে। এটি হওয়ার পর সে সময়ে বিশ্ববাজারে এলএনজি মূল্য পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে কত দামে এবং কোন মাধ্যমে গ্যাস আমদানি হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। পায়রায় প্রস্তাবিত এলএনজি টার্মিনালটি নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহের তৎপরতাও শুরু করে দিয়েছে এক্সিলারেট এনার্জি। কোম্পানির চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, পায়রায় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য এক্সিলারেট এনার্জি এখন সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পের জন্য কোম্পানিটি পায়রা থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের কথাও ভাবছে। প্রকল্পটিতে সরকারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চলতি মাসেই এইচএসবিসি ব্যাংককে আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে এক্সিলারেট এনার্জি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ২০২৫ ও ২০২৬ সাল নাগাদ এলএনজির বাজার নিম্নমুখী হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। সেই অর্থে এলএনজির অবকাঠামো বাড়ানো গেলে সেটি খারাপ হবে না। তবে এলএনজি সরবরাহ চুক্তিটির বিভিন্ন দিক সরকারকে ভালোভাবে পর্যালোচনা করতে হবে, যাতে এ চুক্তি আগামীতে আর্থিকভাবে বড় ধরনের কোনো ক্ষতির কারণ না হয়। কারণ আমাদের বিদ্যমান যে অবকাঠামো রয়েছে, সেখানে বড় একটি সক্ষমতা বসে রয়েছে। এর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম এখন আকাশচুম্বী। স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ৫৬ ডলারের ওপরে। ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করে সাশ্রয়ী মূল্যে এলএনজি আমদানি করা না গেলে তা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলবে জ্বালানি বিভাগকে। এছাড়া বিদ্যমান এলএনজির অবকাঠামো পুরোটাই ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বর্তমানে ৪২ শতাংশের মতো সক্ষমতা বসে আছে। টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ সক্ষমতা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর কম ব্যবহার হলে প্রতি ইউনিটের রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ ৫০ সেন্ট এবং ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে।

পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) তথ্যমতে, দেশে গ্যাস সরবরাহ কমলে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। আর এজন্য ভাসমান টার্মিনালের উদ্যোগ নেয় সরকার। এ পরিকল্পনা থেকে ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে এক্সিলারেট এনার্জি। ২০১৮ সালের ১৯ জুলাই এলএনজি সরবরাহ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার এ ভাসমান টার্মিনালের এলএনজি ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ২০৩২ সাল পর্যন্ত টার্মিনালটি পরিচালনা করবে এক্সিলারেট এনার্জি। এরপর কোনো ধরনের চার্জ ছাড়াই পেট্রোবাংলার কাছে টার্মিনাল হস্তান্তর করবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এ টার্মিনাল দিয়ে ৪ লাখ ৩৭ হাজার ৯১৬ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করেছে এক্সিলারেট।

একই রকম শর্তে ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল সামিটের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে পেট্রোবাংলা। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ শুরু করে। একই ধারণক্ষমতার টার্মিনালটি চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ করেছে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫১৭ হাজার এমএমসিএফ। ২০৩২ সাল পর্যন্ত পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি রয়েছে কোম্পানিটির।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top